দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরোঃকলকাতা সুন্দরীদের নগরী। বারে বারে বাঙালি নারী সুন্দরীর খেতাব ছিনিয়ে নিয়ে সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। তবে বর্তমানে বাঙালির মনে সুস্মিতা সেন , লারা দত্ত থেকে ঐশ্বর্য রাই বচ্চন এরা বিরাজ করলেও প্রথম কলকাতার মেয়ে তথা প্রথম ভারত সুন্দরীর শিরোপা নিজের মাথায় পরা ‘এস্টার ভিক্টোরিয়া অ্যাব্রাহাম’ কে বাঙালী আজ প্রায় ভুলে গিয়েছে বললেও চলে। ১৯১৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এক রক্ষণশীল বাগদাদী ইহুদি পরিবারে। ১৯৪৭ সালে ভারতের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই এর হাত থেকে তিনি মিস্ ইন্ডিয়ার সম্মান গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স ছিল ৩১, শুধু তাই নয় তিনি তখন গর্ভবতী ও ছিলেন। আসলে সে সময় এই সব প্রতিযোগিতায় দৈহিক সৌন্দর্য্যের থেকে সুন্দর মুখশ্রী অনেক বেশি প্রাধান্য পেত।
তার বাবা ছিলেন কলকাতার এক নাম করা বিখ্যাত ব্যাবসায়ি। জন্ম থেকে বড়ো হয়ে ওঠা কলকাতায়। সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি প্রচুর প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন তিনি । খেলাধুলা, আঁকা, নাচ থেকে অভিনয়ে সমান পারদর্শী। আর্ট এর জন্য তিনি কেমব্রিজ থেকে ডিগ্রি পেয়েছিলেন। আবার হকিতেও তিনি ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। তার স্কুল জীবনের প্রথম অধ্যায় কাটে ক্যালকাটা গার্লস স্কুলে এবং পরবর্তীতে সেন্ট জেমস্ স্কুলে। যদিও পুরানো চিন্তাভাবনার রক্ষণশীল পরিবার , তার উপর একজন নারী, তাই আত্ম স্বাধীনতা ছিল না খুব একটা। তবে পরিবারের লোকজন ঘরোয়া পরিবেশে নাচ গানের আসর বেশ পছন্দ করতেন। তাই নাচের জগতে প্রথম প্রবেশ, এর পর কিছু নাট্য ব্যাক্তিত্বের সাথে পরিচয় ও মঞ্চে প্রবেশ।


এর পর অল্প বয়সেই এক মাড়োয়ারী অভিনেতার সঙ্গে প্রণয় ও বিয়ে।যদিও সে বিয়ে খুব বেশি দিন টেকেনি, তাই ছেলে মরিস কে বাবা মায়ের কাছে রেখে তিনি পাড়ি জমান বম্বেতে। সেখানে পারস্যের এক ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হলেন, প্রজেক্ট পরিবর্তনের মাঝে ১৫ মিনিটের বিরতিতে নাচের মাধ্যমে দর্শকদের মনোরঞ্জন করা ছিল তার কাজ।
প্রথম দিকে তাঁর ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হওয়ার কিন্তু তার সফলতা হাতছানি ছিল অন্য পথে। একদিন ফ্লিম লাইন এ যুক্ত থাকা তার তুত বোন ‘রোজ এজরার’ সঙ্গে তিনি দেখা করতে এসেছিলেন তার বোম্বের ফ্ল্যাটে। সেখানে পরিচালক আর এস চৌধুরী তার “দ্য রিটার্ন অফ দ্য তুফান মেইল” সিনেমার জন্য রোজ এর সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন।সেখানে এস্টার কে দেখেই তার চেহারার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঠিক করেন তার এই সিনেমার নায়িকা হবেন এস্টার।তারপর পরিচালক ও প্রযোজকরা এস্টার ভিক্টোরিয়া অ্যাব্রাহাম এর নতুন নাম দিলেন প্রমীলা, পরবর্তীতে তিনি প্রমীলা নামেই জনপ্রিয় হলেন। “দ্য রিটার্ন অফ দ্য তুফান মেইল” সিনেমা সে ভাবে জনপ্রিয় না হলেও, হিন্দী সিনেমার দুনিয়ায়, সফর শুরু হলো সুন্দরী প্রমীলার। তিনি স্ট্যান্ট অভিনেতা হিসাবেও নাম করেছিলেন, সে সময় সিনেমাতে তিনি স্ট্যান্ট করেছেন । আর বেকোসুর, বিজলি, উল্টি গঙ্গা, জঙ্গল কিং এর মতো প্রচুর সিনেমাতে তিরিশ থেকে পঞ্চাশের দশকে পর্দায় দাপিয়ে অভিনয় করেছেন।


তবে তার জীবন প্রবাহ খুব একটা মসৃণ ছিল না। প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি অভিনেতা সৈয়দ হাসান আলী জায়েদী যিনি অভিনয় জগতে ‘কুমার ‘ নামে পরিচিত ছিলেন তাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তাদের চার সন্তান ছিল। ১৯৬৩ সালে জায়েদী তার প্রথম স্ত্রী ও পরিবারের কাছে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন প্রমীলা দেবী সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তার সন্তানদের নিয়ে ভারতে থেকে যাবেন এবং অভিনয় ও প্রযোজনার কাজে নিজেকে নিযুক্ত রাখবেন।
তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা প্রযোজিকা। প্রথম দিকে স্বামীর সাথে প্রযোজনার কাজ করলেও পরে তিনি একাই প্রযোজনার কাজ করতেন, তাঁর নিজের প্রযোজনা কোম্পানি ‘ সিলভার প্রোডাকশন ‘ এ তিনি ১৬ টি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন এবং এই কাজের জন্য তিনি ভারতে প্রথম বৃহত্তর মহিলা চলচ্চিত্র নির্মাণকারী হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।


এত সাফল্যের পাশাপাশি তা র গায়ে লেগেছিল বিতর্কের দাগ, তাকে পাকিস্তানি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন মোরারজি দেশাই। কিন্তু পরে জানা যায় তিনি পাকিস্তানে যেতেন তার চলচ্চিত্রের প্রচারের জন্য এবং তিনি নির্দোষ ।
শুধু তিনি নন, তার ছেলে মেয়েরাও বিখ্যাত মায়ের সন্তান হিসাবে নিজেদেরকে প্রমাণ করেছে। তার কন্যা ‘নাকি জাহান’ ১৯৬৭ সালে মায়ের মিস ইন্ডিয়া হওয়ার ২০ বছর পর নিজেও মিস ইন্ডিয়ার সম্মান অধিকার করেন। তিনিও অনন্য সুন্দরী, দেশের সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারিণী মা ও মেয়ে, এই বিরল রেকর্ড আজও একমাত্র তাদের কাছেই আছে। তার ছেলে হায়দার আলী,যিনি একজন লেখক। তিনি বিখ্যাত সিনেমা ‘যোধা আকবর ‘ এর চিত্রনাট্যকার।
প্রমীলা দেবী শেষ বয়স পর্যন্ত সিনেমার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। ২০০৬ সালে তার অভিনীত শেষ ছবি, অমল পালেকর পরিচালিত ‘ থাং ‘ মুক্তি পায়। এবং ২০০৬ সালের ৬ই অগাস্ট ৯০ বছর বয়সে প্রমীলা দেবী প্রয়াত হন। এই অনন্য প্রতিভাবান বাঙালি নারী প্রচারের বিমুখ হলেও তার কার্যকলাপ বর্তমান প্রজন্মের মনেও প্রভাব ফেলতে সক্ষম। তিনি মডেলিং থেকে ফ্যাশন দুনিয়া কোথাও পিছিয়ে থাকেননি। তার চেহারার সৌন্দর্য্য এবং কাজ দর্শক মনে বরাবর ই রেখাপাত করেছে।
লেখা – তানিয়া তুস সাবা