দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: আজ এই শোক প্রকাশের কোনো শব্দ নেই ঠোঁটে । রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার শ্রুতি নাটকে’র ‘অমিত’ হয়ত দৃপ্ত কন্ঠে সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবে ‘প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি, খাসা তোর চ্যাঁচানি’ কিনবা কোল্ট হাতে ‘মগজ অস্ত্র’টাকেই প্রথমে ব্যবহার করবে ‘ফেলুদা’ কিন্তু ছেলেকে কাঁধে করে ‘অপু’র দিগন্তে হারিয়ে যাওয়ার মতই আজ বুকের ভেতরটা এক লহমাতে ফাঁকা হয়ে গেল তাঁর চলে যাওয়ার খবরে। তিনি নেই। সেই ৬’ই অক্টোবর থেকে বীরের মত লড়তে লড়তে আজ এই মূহুর্তে তিনি আর নেই। ২০২০ সত্যিই বিষাক্ত একটি বছর। এর কামড়ে একে একে কত নক্ষত্রর যে হারিয়ে যাওয়া। আজ দুপুর ১২:১৫ মিনিটে চলে গেলেন ‘ভারতীয় চলচিত্রের চেহারা পরিবর্তণকারী’ অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
উলেখ্য, গত নবমীর দিন সকাল থেকেই শারীরিক অবস্থার অবনতি শুরু হয়েছিল। অভিনেতার মস্তিষ্কের কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই তাঁকে আবার ভেন্টিলেশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কারণ, সেই মুহূর্তে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেওয়া ছাড়া চিকিত্সকদের সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা ছিলনা। ওইদিন রাতে বিশেষ মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, আবার তাঁকে ইনভেসিভ সাপোর্ট দেওয়া হবে। তবে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ফের একদফা স্নায়ু বিশেষজ্ঞ এবং কিডনি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হয়। এরপরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন বেলভিউ’র মেডিক্যাল বোর্ড।
হাসপাতাল সূত্রে চিকিত্সক অরিন্দম কর জানিয়েছিলেন “সৌমিত্রবাবুর মস্তিষ্কের সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা ক্রমশ কমছে। শেষ ৪৮ ঘণ্টায় তাঁর বেশ অনেকটাই অবনতি হয়েছে। কোনও কিছুতেই তিনি সাড়া দিচ্ছেন না। করোনা সংক্রান্ত এনসেফালোপ্যাথি অর্থাত্ মস্তিষ্কের স্নায়ু সংক্রান্ত সমস্যাই এখন ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে। এর ফলে শরীরে ইউরিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মাত্রাও অস্বাভাবিকস্তরে ঘোরাফেরা করছে। এই সমতাও বজায় রাখা যাচ্ছে না।”তবে সেই মূহুর্তে অভিনেতার বাকি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এখনও সঠিকভাবে কাজ করছে এমনটাই দাবি করেছিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তবে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং ক্রমশই আরও জটিলতর হতে থাকে। হাসপাতালের তরফ থেকে সৌমিত্রের পরিবারের সদস্যদেরও কাউন্সেলিং করা হয় আর এর পাশাপাশি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশের সেরা স্নায়ু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। উল্লেখ্য, প্লাজমাফেরেসিস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল পরিশেষে কিন্তু সেটাও বিফলে যায়।
তাঁর পরিবারের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স বিদ্যালয়ে। উনি বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন হাওড়া জিলা স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর সর্বপ্রথম কাজ প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়-এর অপুর সংসার ছবিতে যা ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়। ছবিটি পরিচালকের ৫ম চলচিত্র পরিচালনা। তিনি এর আগে রেডিয়োর ঘোষক ছিলেন এবং মঞ্চে ছোটো চরিত্রে অভিনয় করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি সত্যজিৎ রায় নির্মিত বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয় যে তাকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্টগুলো লেখা হয়। সত্যজিৎ রায়-এর দ্বিতীয় শেষ চলচিত্র শাখা প্রশাখা-তেও তিনি অভিনয় করেন।
তার অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ‘ফেলুদা’র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তার অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি সোনার কেল্লা বের হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে, তার চেয়ে ভালো অভিনয়ে ফেলুদার চরিত্র আর কেউ ছবিটিতে করতে পারতনা।
তিনি বাংলা ভাষাতে সর্বমোট ২১০ টি ছবিতে কাজ করেছিলেন। পেয়েছিলেন দুটি জাতীয় পুরস্কার সহ ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি ফ্রান্সের শিল্পীদের জন্যে প্রদত্ত সম্মানীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার “কম্যাংদীয়র দে আই অর্ড্রে ডেস আর্টস ডেস লেট্রেস” দ্বারা সম্মানিত প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। এছাড়া ফ্রান্স সরকার তাঁকে ‘লিজিয়ন দ্য ওনার’ পুরস্কারেও সম্মানিত করে। ভারত সরকার ২০০৪ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করেছিল; পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারও। তিনি ১৯৯৮ সালে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন, যা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্য একাডেমী কর্তৃক প্রদত্ত। ২০১৩ সালে আইবিএন লাইভ তাকে “ভারতীয় চলচ্চিত্রের চেহারা পরিবর্তনকারী পুরুষদের একজন” হিসেবে নামকরণ করে।
সৌমিত্র যে সময়ে অভিনয়ে এসেছিলেন সেই সময়ে উত্তম কুমার ছিলেন মেন স্ট্রীম ছবির ‘সূর্য’। কিন্তু উত্তম কুমারের ক্যারিসমা তাঁর অভিনয় প্রতিভাকে ম্লান করতে পারেনি একটুও বরং তাঁর বাংলাভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে মহানায়ক ও সুযোগ ছাড়েন নি। ‘ঝিন্দের বন্দী’তে ‘ময়ূরবাহন’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় হলিউডের সেই সময়ের বিখ্যাত অভিনেতাদের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। তাঁর বিশেষ উল্লেখ্য ছবির মধ্যে ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’, ‘তিন ভুবনের পারে, ‘অপু ট্রিলজি’, ‘ফেলুদা সিরিজ’, ‘নষ্ট নীড়’, ‘অভিযান’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মঞ্চ অভিনয় ও আবৃত্তিতে তাঁর সম গোত্রীয় কেউ ছিল না। তাঁর মঞ্চ নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাপসী, নামজীবন, রাজকুমার, ফেরা, নীলকন্ঠ, ঘটক বিদায়, দর্পণে শরৎশশী। তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি বেশ কয়েকটি নাটক রচনা ও পরিচালনা করেছেন, কয়েকটি অনুবাদ করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা, এবং টিভি ধারাবাহিকেও অভিনয় করেছেন।
উল্লেখ করা ভালো, ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বাংলায় অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের “নাম সৌমিত্র” বইটি আরকাদীপ কর্তৃক প্রকাশিত বাংলায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনী। এছাড়াও তাঁকে জানার জন্যে ‘অপু ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ২০টি প্রিয় চলচ্চিত্র ভূমিকা ‘ অমিতাভ নাগ এই বইটিও বিশেষ উপকারী। হাসপাতালে ভর্তির আগে তিনি অভিনয় করছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনাতে একটি তথ্যচিত্রে। ১৯৩৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত এই ৮৫ বছরের পথচলা তাঁকে করে তুলেছিল জীবন্ত কিংবদন্তি। আজ দেবী বিসর্জনের মতই বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার এক দেব পুরুষের বিসর্জন হলো। দেবীর তাও প্রতিবছর ফিরে আসা আছে, কিন্তু আর কখনো ফিরবে না ‘ক্ষীদ্দা’।