সকাল থেকেই গুজব শুনছিলেন। ‘ক্ষিদ্দা’ আর নেই, কোনি নিশ্চিত হলেন দুপুরে। সেই থেকেই ‘মন ভাল নেই’ কোনির। মাত্র একটি সিনেমায় অভিনয় করেই ‘কোনি’ মানে একদা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি বিশাল খ্যাতি অর্জন করেছিলন। পেয়েছিলেন একাধিক পুরস্কার। ‘ক্ষিদ্দা’ মানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বলা তিনটি শব্দ ‘ফাইট, কোনি ফাইট’ তো বাঙালির জীবনে মিথ হয়ে গিয়েছে। সৌমিত্র যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, শ্রীপর্ণা নিজের মনেই কতবার ওই তিনটি শব্দ একটু পরিবর্তন করে বলেছেন, ‘ফাইট, ক্ষিদ্দা ফাইট’। অবশেষে রবিবার দুপুরে শেষ হয়ে গেল কোনির সেই ক্ষিদ্দার ‘ফাইট’। কসবার বাড়ি থেকে ফোনে শ্রীপর্ণা বলছিলেন, ‘সৌমিত্রদাকে ঘিরে কত কাহিনী। সব মনে পড়ছে। স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে।’
শুরু করলেন ‘কোনি’-র শুটিংয়ের সময় থেকে। শ্রীপর্ণা বললেন, ‘খুব মজার মানুষ ছিলেন। অভিনয়ে আমি তো ছিলাম একেবারেই আনকোরা। কিন্তু সৌমিত্রদা উৎসাহ দিতেন। নজর রাখতেন যাতে আমার কোনও অসুবিধা না হয়। অভিভাবকের মতো আগলে রাখতেন। তিনি যে নামী মানুষ, সেটা বুঝতেই দিতেন না। শুটিংয়ে যাওয়ার পথে কবিতা শোনাতেন, গল্প বলতেন। কোথা দিয়ে সময় কেটে যেত, বুঝতেই পারতাম না। সত্যি ওঁকে ঘিরে কত স্মৃতি!’ কোনির যখন শুটিং হয়, শ্রীপর্ণা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বললেন, ‘আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা অনেকে শুটিং দেখতে আসত। ওদের সাথেও গল্প, মজায় মেতে উঠতেন। মনে হত আমার বন্ধুরাও ওঁর কতদিনের পরিচিত।’


কোনিতে অভিনয় করে একাধিক পুরস্কার পেয়েছিলেন শ্রীপর্ণা। ওই পুরস্কার যখন দেওয়া হয় তা নিতে শ্রীপর্ণা উপস্থিত থাকতে পারেননি। বললেন, ‘আমার স্বামীর (তরুণ মুখার্জি) চাকরির জন্য তখন ব্যাঙ্গালোরে ছিলাম। আসা হয়নি। একসঙ্গে আমরা পুরস্কার নিতে পারিনি। পরে আমার পুরস্কার পাঠিয়ে দিয়েছিল।’ কোনির পর শ্রীপর্ণা আর সিনেমার জগতে থাকেননি। সাঁতারেও নয়। অনেক বছর ধরেই তিনি সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা। এখন নার্সারি বিভাগের টিচার ইনচার্জ। একেবারে অন্য জগতে চলে যাওয়ায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। আবার একেবারে বিচ্ছিন্নও ছিলেন না।
শ্রীপর্ণা বললেন, ‘অনেক জায়গাতেই অনেকবার দেখা হয়েছে। আগের মতোই গল্প, মজায় মাতিয়ে রেখেছেন। ওঁর বেশ কিছু নাটক দেখতে গিয়েছি। নাটক শেষ হলে গ্রীনরুমে গিয়ে দেখা করে এসেছি। আমাদের লাইফ সেভিং সোসাইটিতে, লেক ক্লাবে অনেক অনুষ্ঠানে এসেছেন। দেখা হয়েছে। অনেক সময় এমনও হয়েছে, আমি ওখানে আছি জেনে ডেকে পাঠিয়েছেন। একবার বললেন, কীরে একটা ফোনও তো করতে পারিস। আমরা কাছে তখন সত্যি ওঁর ফোন নম্বর ছিল না। এটা শুনেই নিজে লিখে দেন নম্বরটা। বলেন, এবার থেকে মাঝেমাঝে ফোন করবি।’
একটা মজার ঘটনা শোনালেন শ্রীপর্ণা, ‘একটা নাটক দেখতে গেছি। নাটক শেষ হতে ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য গ্রীনরুমের দিকে যাচ্ছি। আমারও তো বয়স হয়েছে। যাঁরা আমাকে সিনেমায় দেখেছেন, তাঁদের এখন চেনার কথা নয়। ওঁর মেয়েও গ্রীনরুমের সামনে ছিলেন। অনেকদিন পর বলে ওঁর মেয়েও আমাকে প্রথমে চিনতে পারেননি। আমাকে দেখা করতে দেবেন না। কোথা থেকে এসেছি, কেন দেখা করতে চাই, জানতে চান। আমি মুখ দিয়ে একটা শব্দ, কোনি বলতেই সব সমাধান হয়ে যায়। ওঁরাই নিয়ে যান ভেতরে সৌমিত্রদার কাছে। তারপর কত গল্প।’ শেষ দেখা বছর আড়াই আগে এক অনুষ্ঠানে।
ওই একটা সিনেমায় অভিনয় করার সূত্রেই তো আসল নাম প্রায় হারিয়ে বাঙালির কাছে শ্রীপর্ণার পরিচয় শুধুই ‘কোনি’। এখনও এটা ‘এনজয়’ করেন সাউথ পয়েন্টের শিক্ষিকা। এই জনপ্রিয়তার কৃতিত্ব অনেকটাই যে ‘ক্ষিদ্দা’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য সেটা মানেন ‘কোনি’ শ্রীপর্ণা ব্যানার্জিও। কোচ আর ছাত্রীর পর্দার জুটিটা আজ ভেঙে গেল। তাই শ্রীপর্ণা বলছিলেন, ‘মনটা আজ ভীষণ খারাপ। দেখা হলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন, কীরে কেমন আছিস? ওই তিনটে শব্দের মধ্যে থাকত গভীর আন্তরিকতা।’