দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো:আজ অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর নটরাজ উদয় শঙ্করের ১২০ তম জন্মদিন। তবে তিনি শুধুমাত্র একজন ভারতীয় নৃত্যশিল্পী নন সেইসাথে নৃত্য পরিকল্পক, এবং অভিনেতাও ছিলেন।যা আজও ভারতের সংস্কৃতি জগতকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। উদয় শঙ্করই প্রথম যিনি ভারতীয় ঘরানার শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী, ইউরোপীয় নৃত্যশৈলী এবং একইসাথে লোকনৃত্য এই তিনের মেলবন্ধন ঘটান। এই কারণে তিনি ভারতীয় আধুনিক নৃত্য জগতের জনক হিসাবে পরিচিত। যাঁর উপস্থিতি আজও উজ্জ্বল ভারতীয় নৃত্যশিল্পীদের কাছে।
আদতে বাঙালি পরিবারের সন্তান হলেও ১৯০০ সালের ৮ ডিসেম্বর রাজস্থানের উদয়পুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পুরো নাম উদয় শঙ্কর চৌধুরী। তাঁর বাবা ছিলেন বাংলাদেশের যশোর জেলার বাসিন্দা পন্ডিত শ্যাম শঙ্কর। বাবার বদলির চাকরির জন্য কখনও নুসরতপুর,তো কখনও গাজীপুর, আবার কখনও বারাণসী কিংবা ঝালওয়ারের মতো একাধিক স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি।তবে বাল্যকালের বেশীরভাগটাই তাঁর মামাবাড়িতে কাটে বলে জানা যায়।


তবে নৃত্যশিল্পের জগতে তাঁর হাতেখড়ি হয় তাঁর বাবা পন্ডিত শ্যাম শঙ্করের হাত ধরেই।তবে নৃত্য জগতে আসার আগে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উদয় শঙ্করের সংগীত ও ফটোগ্রাফির মত অন্যান্য শিল্পের সাথে সখ্যতা জন্মায়। তাঁর বাবা পন্ডিত শ্যাম শঙ্কর ছিলেন শিল্পবোদ্ধা প্রাজ্ঞজন। তাঁর কাছে নৃত্যকলা ছিল একাধারে শিল্প এবং পুজা ও উপাসনা। আর উদয় শঙ্করজির নাচের প্রতি প্রথম আকর্ষণ জন্মায় শৈশবে একবার দোল উৎসবে এক গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের “আদিবাসী নাচ” দেখতে গিয়ে।
সেই নাচ দেখে তিনি এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে সেসময় মাঝে মাঝেই কাওকে না জানিয়ে একা একাই ওই ধরনের নাচের অনুষ্ঠান দেখতে বেরিয়ে পড়তেন বালক উদয় শঙ্কর। নৃত্যশিল্পের পাশাপাশি চিত্রকলার প্রতিও এক অদ্ভুত ভালো লাগা ছিল তাঁর।পরবর্তীকালে চিত্রকলা ও নৃত্যকলা নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনের রয়েল কলেজ অব আর্টসে যান তিনি।সেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিত্রাঙ্কন এবং নৃত্যের ওপর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় বিষয়েই প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর চিত্রাঙ্কনের ওপর আরও প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তিনি রয়েল কলেজ অব আর্টসের বৃত্তি নিয়ে রোমে যান।
এরপর বিদেশে থাকাকালীন ইউরোপের সমসাময়িক একাধিক শিল্পীদের সংস্পর্শে আসেন তিনি।সেসময় তিনি সেখানে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি নৃত্যশৈলী তৈরি করেন। যেটা ছিল চাঁদের আলোয় পোট্রেট আঁকার সাথে সাথে একটি নাচ।সেই নাচ সকলের এতটাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে পরবর্তীকালে রাশিয়ার বিখ্যাত ব্যালে নৃত্যশিল্পী আন্না পাভলোভা ‘ঈশ্বর বন্দনা’ এবং ‘হিন্দুবিবাহ’ এ দুটি বিষয়ের ওপর দুটি নৃত্য তৈরির দায়িত্ব দেন তাঁকে। উদয় উল্লিখিত বিষয়ের ওপর যে দুটি নৃত্য তৈরি করেন তাতে তাঁর বিস্ময়কর কল্পনাশক্তি, প্রজ্ঞা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রকাশ ঘটে।


এরপর থেকেই তিনি নিজের স্বতন্ত্র নৃত্য ধারা নিয়ে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকেন। এরফলে খুব সুন্দর ভাবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য নৃত্যধারার পাশাপাশি লোকনৃত্যেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটান তিনি।যার মধ্যে অন্যতম হল বিশেষ অঙ্গ সঞ্চালন, পোশাক, ভাব ও সাজসজ্জা এবং সঙ্গীত ও নৃত্যের সংমিশ্রণে তৈরি আধুনিক অথচ মার্জিত ভারতীয় ব্যালে ।পরবর্তীকালে ভারতে আসার পর কেরালার স্থানীয় লোকনৃত্য ‘কথাকলি’ তিনিই গোটা ভারতে, বিশেষকরে বাংলায় জনপ্রিয় করে তোলেন। উদয় শঙ্করের এই আধুনিক নৃত্য শৈলী আজও তাঁর পুত্র আনন্দ শংকর, কন্যা মমতা শংকর এবং পুত্রবধূ তনুশ্রী শংকরের হাত ধরে দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আজও শুধু জনপ্রিয় নয় বরং দিনে দিনে আরও বিস্তার লাভ করছে তার একাধিক শাখাপ্রশাখা
আরো পড়ুন: টুইটারে স্মৃতি রোমন্থন করে “আদরের ফেলুদাকে” শেষ শ্রদ্ধা জানালেন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট!
১৯৪২ সালে উদয়শঙ্কর তার নাচের সঙ্গী অমলা শঙ্করের সঙ্গে বিবাহ করেন। চারের দশক থেকেই উদয় শঙ্কর ও অমলা শঙ্কর জুটি সারা বিশ্বে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। উদয় শঙ্কর পরিচালিত কল্পনা-তে উমার চরিত্রে অমলা শঙ্করের নৃত্যাভিনয় প্রশংসিত হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবেও। তাঁদের প্রথম সন্তান, আনন্দ শঙ্কর এবং দ্বিতীয় সন্তান কন্যা মমতা শংকর।
জানা যায় উদয় শঙ্করের নাচের সাথে সঙ্গত করতেন তাঁর ছোট ভাই ও কিংবদন্তী সিতার পন্ডিত রবি শংকর।কাওকে কোনরকম নকল না করেই সম্পূর্ণ নিজস্ব কল্পনা শক্তির ওপর ভর করে কখনও জলতরঙ্গের ওপর মিউজিক তৈরি করে নাচ করেছেন আবার কখনও সূর্য প্রণামের ওপর এক অভিনব, আধুনিক নৃত্যশৈলী দিয়ে মুগ্ধ করে তুলতেন দর্শকদের। কয়েক দশক ধরে দর্শক দের মনজয় করার সাথে সাথে উদয় শঙ্কর পেয়েছিলেন একাধিক পুরস্কার।তারমধ্যে রয়েছে “ক্রিয়েটিভ ডান্স”এরর জন্য “সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার”, রয়েছে “সঙ্গীত নাটক একাডেমী ফেলোশিপ”সেইসঙ্গে ১৯৭১ সালে, পদ্মবিভূষণ, পুরস্কার লাভ করেন তিনি।এছাড়া ১৯৭৫ সালে, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান দেসিকোটটাম পুরস্কার,সম্মানিত হন তিনি।
তথ্য সাহায্য : মধুরিমা সেন আচার্য্য (নৃত্যশিল্পী)