দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: প্রথাগত প্রশিক্ষণ না নিয়েও গানের জগতে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। শিল্পীর মৃত্যু হয় না। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে তার পরেও তাঁরা হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকেন। মানুষের স্মৃতিতে, মনে, ভালো লাগায়, খারাপ লাগায়। এমনই এক জন চিরস্মরণীয় শিল্পীর আজ জন্মদিন। কিশোর কুমার। আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায় থেকে কিশোর কুমার। জার্নিটা খুব সহজ ছিল না। যে কোনও প্রতিকুল অবস্থাকে শুধু হাসি মজায় উড়িয়ে ভারতীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন এই মানুষটি।তাঁর গান শুনেই যেন আলোর গতিতে পৌঁছে যাওয়া যায় পুরনো দিনে। মরচে পড়া স্মৃতিকে যেন জলজ্যান্ত করে তোলে তাঁর গান।
১৯২৯ সালের ৪ অগাস্ট মধ্যপ্রদেশের এক বাঙালি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন কিশোর কুমার। আজ তাঁর ৯১ তম জন্মবার্ষিকী। বম্বে টকিজ ছবিতে দাদা অশোক কুমেরের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন। সেই সময়ে নিজের কিশোর নামটাই ব্যবহার করেছিলেন তিনি। পরে সেই নামটাই থেকে যায়।
১৯৪৮ সালে জিদ্দি ছবিতে প্রথম একটি গানে প্লেব্যাক করেন তিনি। কিশোর কুমার কে এল সায়গলকে নিজের সবচেয়ে বড় আদর্শ মানতেন। বাংলা, হিন্দি, ভোজপুরি, অসমিয়া-সহ মোট ২০০০-এরও বেশি গান গেয়েছেন কিশোর কুমার। ৮ বার পেয়েছেন ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড।তাঁর গানে লিপ দিয়েছেন অমিতাভ বচ্চন, উত্তম কুমার, রাজেশ খান্না, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-সহ আরও অনেক অভিনেতা। তবে শুধু গান নয়। অভিনেতা হিসেবেও যে তিনি পারদর্শী, তা প্রমাণ করেছেন কিশোর। এমনও হয়েছে, শরারত ও রাগিনী ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। আর তাঁর লিপে গান হেয়েছেন মহম্মদ রফি। তাঁর অভিনীত বেশ কিছু ছবি হিট ছিল বক্স অফিসে। তাঁর বিপরীতে বৈজন্তিমালা, মধুবালা ও সায়রা বানুর মতো অভিনেত্রী কাজ করেছেন।
কিশোর কুমারের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও আলোচনা কিছু কম হয়নি। তাঁর মহিলা অনুরাগীর সংখ্যা কিছু কম ছিল না। তিনি মোট ৪ বার বিয়ে করেছেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী হলেন রুমা গুহঠাকুরতা। এর পরে ১৯৬০ সালে মধুবালাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে মধুবালার মৃত্যু হয়। ১৯৭৬ সালে অভিনেত্রী যোগিতা বালির সঙ্গে বিয়ে হয়। সেই বিয়ে দু বছর টেকে। এর পরে লীনা চন্দভারকারকে বিয়ে করেন তিনি। লীনা কিশোরের মৃত্যুর সময় পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন।
ছন্ন ছাড়া পাগল পাড়া এক মানুষের পিছনে লুকিযে থাকা পরিশ্রমী, একমুখী মানুষ। যিনি কখনও এক বিন্দুও মদ্যপান করতেন না। বাড়িতে নেমতন্ন করলে বা পার্টি দিলে, তাতে মধ্যপানের আয়োজন থাকত না। থাকত নিখাদ বাঙালি খানা। লুচি, বেগুনভাজা, আলুর দম। আর নিজে কোথাও খেতে গেলে, বিশেষত বাঙালি পরিবারে, যেচে বলে রাখতেন মাছের একাধিক পদ করে রাখতে। কলকাতা থেকে বম্বে ফেরার সময় শচীনদেব বর্মন, শক্তি সামন্তরা কিশোরকুমারের জন্য নিয়ে যেতেন ইলিশ মাছ। বহু পরিচালক–প্রযোজকই জেনে গিয়েছিলেন কিশোরকুমারের এই মাছ–প্রীতির কথা। ডেট পাচ্ছেন না। মাছের ঝোল কিংবা ঝাল ভেটকি গেলেই কেল্লা ফতে!
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দ’ ছবির নাম–চরিত্রের জন্য ভেবেছিলেন কিশোরকুমারকে। সেই মর্মে ‘পাবলিসিটি’ও শুরু হয়েছিল। অভিনয় করবেন। গানও গাইবেন। শেষমেশ পিছিয়ে গেলেন কিশোর। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল কিশোরের। রুমাদেবীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে তা পরিণত হয়েছিল পারিবারিক বৈবাহিক সম্পর্কে। ‘পথের পাঁচালী’র জন্য অর্থ সাহায্যও করেছিলেন একটা পর্বে। অথচ এই সত্যজিতের ছবিতেই অন্তত দুবার অভিনয়ের প্রস্তাব ছেড়ে দেন কিশোর। প্রথমবার ‘পরশপাথর’–এ। সম্ভবত পরেশবাবুর যুবক সেক্রেটারির চরিত্রে কিশোরকে ভাবেন সত্যজিৎ। আর পরেরবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’–এ ‘গুপী’ চরিত্রে ও গানে।
অনেকেই হয়তো জানেন না, মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি এবং নাম নেন করিম আবদুল।যত বড় পরিচালকই হোক না কেন, সম্পূর্ণ পারিশ্রমিক না পাওয়া পর্যন্ত গান রেকর্ডিং করতেন না। লতা মঙ্গেশকরের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন। তাঁর সম্মানে সব সময় পারিশ্রমিক নিতেন লতার চেয়ে ১ টাকা কম।তাঁর অভিনয়ে পাগলামির ছাপ ছিল স্পষ্ট, যা তিনি ইচ্ছা করেই তৈরি করেছিলেন। এমনকি খান্ডোয়ায় তাঁর বাড়ির সামনে নিজেই ‘মেন্টাল হসপিটাল’ লেখা সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন।