বৌভাতের পর দিন। বিয়ের শাড়ী ল্যাহেঙ্গা তখনও আলমারী তে ওঠেনি, হাতের মেহেন্দি গুলো তখনও স্পষ্ট , হঠাৎ ঘরে শাশুড়ি মা এলেন।
” বৌমা! আজ তোমার রান্না ঘরে প্রথম দিন। কি রাঁধবে ভেবেছো ? আমার ছেলে আবার পাতে নুন কম বেশি হলে নাক কুঁচকায়। আমি রান্না ঘর গুছিয়ে রেখেছি, তাড়াতাড়ি স্নান টা সেরে রান্নাঘরে চলে এসো। “
আমি নীরবতা পালন করে সব শুনলাম। শাশুড়ি মা আমার টেনশন দেখে একটা মৃদু হাসি হাসতে বাধ্য হলাম। দ্রুত স্নান সেরে এক গাছা সিঁদুর পরে রান্না ঘরের দিকে এগোলাম। এটা এখন আমার নতুন রান্নাঘর। এখানে বাসন থেকে কৌটো সবটাই আমার কাছে অপরিচিত। মনে মনে ভাবলাম একদিন অভ্যাস হয়ে যাবে। পরিচিত হয়ে যাবে।
পাশে ঘর ভর্তি লোক। পিসি শাশুড়ি থেকে শুরু করে মাসি, মেস, মামা শ্বশুররা সবাই এসেছেন। একটু ভয়ও হলো বটে । বিয়ের পর একটা মেয়ের কাছে সব কিছুই অপরিচিত থাকে। ঘর। লোকজন। আসবাব পত্র। নিজের নাম, এসব ভাবতে ভাবতেই যা: রান্না ঘরের মশলার থালা টা খুঁজে পেলাম না। কী উপায়!
না পারতে শাশুড়ি মা কে ডাকলাম। উনি এসে দেখিয়ে দিলো এক এক করে, কোথায় মশলা থালা, কৌটো এসব রাখা হয়। সবজির ডালি রাখা হয়। ছুড়ি। আরো সব। এ সব কিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে উনি আবার পাশের ঘরে চলে গেলেন। একটু সময় লাগলো।
কিছুক্ষন বাদে আমি আমার নতুন বাড়ির নতুন রান্না ঘরে রান্না সেরে খাবারের থালা নিয়ে পাশের ঘরে এলাম। যেখানে সব অতিথিরা গোল বৈঠক করছিলেন। ঘরে ঢোকার মুখে শুনতে পেলাম,
“আজকাল কার মেয়েরা আবার রান্না করতে জানে না। সারাদিন ওই ঘন্টার মোবাইলে ফেসবুক সেলফি যত সব ন্যাকাচন্ডী। আমাদের বাবা এসব ছিলো না। “
দেখলাম পাশেই দাঁড়িয়ে আমার ননদ একের পর এক সেলফি তুলে যাচ্ছে। একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আমি ঢুকতেই সবাই কেমন চুপ হয়ে গেলো।
শাশুড়িমা এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে বিশালাকার থালা ভর্তি মালপোয়া টেবিলের ওপর রাখলেন। বেশ নিশ্চুপ হয়ে গেল ঘর টা। আমি বললাম,
“আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি বানাবো। তাই একটু মালপোয়া করেছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। “
এটা বলার পর দু পা পিছিয়ে গেলাম। বিয়ের আগে ‘ও’ আমায় যখন দেখতে গিয়েছিলো তখনও এতো ভয় লাগেনি। আজ খুব ভয় লাগছে। দেখলাম এক এক করে সবাই মালপোয়া নিয়ে মুখে দিলো। এক কামড় । দু কামড়। কেউ কিছু বলছে না। খেয়েই যাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে আমি শুকিয়ে যাচ্ছিলাম। হটাত্ পিসি শাশুড়িমা বলে উঠলেন –
” বৌমা ! তুমি হঠ্যাৎ মালপোয়া কেনো করলে ? আরো তো কত কি ছিলো। পায়েস ,সুজির হালুয়া, গাজরের হালুয়া ? “
এই রে ! মালপোয়া বুঝি ভালো হয়নি। কি বলবো খুঁজে পেলাম না। নিচু গলায় বললাম “আমার মা বলেন জোড় করে অন্য কাজ করতে যেও না যেটা তুমি পারোনা,বরং সেটাই করো যেটাতে তুমি বেস্ট। পিসিমা, আমি মালপোয়া টা খুব ভালো পারি। মশলার থালি টা হাতে নেবার পর হলুদ নুন জিরে দেখে মনে এলো আমার উনি আবার নুন কম বেশি হলে নাকি , “
শাশুড়িমা আমায় থামিয়ে দিয়ে সবাই কে আরেকটা করে মালপোয়া যাঁচলেন। আমার বর তৎক্ষণাৎ ঘরে এসে মালপোয়া নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন –
“অসাধারণ । এক্সিলেন্ট ! চুমু মালপোয়া একদম। কে বানালো ?
আমি লজ্জায় রান্না ঘরে দৌড়ে এলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস। যাক! মালপোয়া আমার সন্মান রেখেছে। ধীরে ধীরে নূন হলুদের মাপ টা শিখে নেবো। পিসিশাশুড়ি চেঁচিয়ে বললেন – ” বৌমা ! তোমার এই মালপোয়ার রেসিপি টা একটু বলো দেখিনি “।
“ওই তো দুধ, চালের গুঁড়ো, মৌরি, চিনি,অল্প নূন…” ধীরে ধীরে গল্পে হারিয়ে গেলাম।
আমার নতুন রান্না ঘর, ভালোবাসার ছোট্ট আদরের ডাক, মালপোয়া সুখে যত্নে রাখুক।