দেখতে দেখতে ১৪ বছর পার হয়েছে। জার্মানী আর ইংল্যান্ড হয়ে অনিকেত বাড়ি ফিরেছে আজ সকালেই। বন্ধুদের কাউকেই কিছু জানায়নি। সন্ধ্যা বেলায় অঝোর বৃষ্টির মধ্যেই একটু বেরিয়েছিল পাড়াতেই। একটা আবছা অথচ খুব পরিচিত গানের গলা ভেসে আসছিলো সামনের বাড়িরই চিলেকোঠার ঘর থেকে। চিনে নিতে খুব একটা অসুবিধা হোলো না অনিকেতের। অন্বেষার গানের গলাটা চোদ্দ বছরে একটুও বদলায়নি।
কি যে হলো অনিকেতের ! ছাতা জুতো ফেলে পাশের কাঁঠাল গাছ দিয়ে সোজা অন্বেষার চিলেকোঠার ঘরে। অনিকেতকে দেখে ভুত দেখার মতো চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো অন্বেষা। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো
-কি করে এলি উপরের ঘরে ?
-ছোটবেলায় যে ভাবে তোর ঘরে আসতাম, তোদের কাঁঠাল গাছ বেয়ে। অনিকেত স্মিত হেসে উত্তর দিলো।
অনিকেত দেখলো অন্বেষা আগের থেকে একটু রোগা হয়েছে , মুখে দু একটা ব্রণর দাগ। চিন্তার চাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। আধো অন্ধকারে স্কুল বেলার অন্বেষাকে মনে পড়লো অনিকেতের। স্কুল পালিয়ে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, বাবুর বাগানে পিয়ারা চুরি করে খাওয়া সব কিছুই। আজ চোদ্দ বছর পরে এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।
দুজনের চোদ্দ বছর কোনো যোগাযোগ না থাকলেও ওদের অনুভূতিগুলো আজও একই রকম আছে তা অনুভব করলো। ওদের দুজনের প্রেম নিয়েই যত অশান্তি ছিল দুই বাড়িতে। অনিকেতের বাবা মেনে নিলেও অন্বেষার বাবা ওদের সম্পর্কটা মেনে নেয়নি । সেই অশান্তির জল গড়িয়েছে সাত সমুদ্দুর পার করে। বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করার সাহস অন্বেষার হয়নি কোনোদিন।
-কিরে তুই এখনো বিয়ে করিসনি ? নিরবতা ভেঙে অনিকেত জিজ্ঞাসা করলো। অন্বেষা মাথা নাড়িয়ে বললো ‘না’।
-তা তুই বিয়ে করিসনি এখনো ? অন্বেষা পাল্টা প্রশ্ন করলো অনিকেত কে। অনিকেত হাসতে হাসতে বললো
-বেশ কয়েকবার প্রেমে পড়লেও বিয়ে করতে পারিনি।
-সে বুঝলাম কিন্তু তুই এখন যা এখান থেকে। মা এসে পড়বে যখন তখন।
অন্বেষার মুখের কথা শেষ হলোনা দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। অনিকেতের দিকে কৌতুহল ও ভয় জড়ানো চোখে অন্বেষা তাকাতেই, অনিকেত চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করতে অন্বেষা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুললো। দরজার ওপারে অন্বেষার মা।
অনিকেতকে এই ঘরে দেখে অন্বেষার মা বেশ খানিকটাই অবাক হলেন, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ না করেই খুব শান্ত স্বরে জানতে চাইলন,
-কিরে অনিকেত? কেমন আছিস ?
অনিকেত ও শান্ত স্বরে উত্তর দিলো
-ভালো আছি।
ব্যস এটুকুই। তিনি আর তেমন কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। অন্বেষার দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন
-তোরা কথা বল।
বলেই বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। অনিকেত অবাক হলো অন্বেষার মায়ের বৈধব্য বেশ দেখে। অনিকেতের চোখে মুখে কৌতুহল ও বিস্ময়ের ছাপ দেখে অন্বেষা বললো
-বাবা আর নেই। বছর দুয়েক হলো ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোকে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে ।
এরপর দুজনেই চুপ করে বসে রইল।
বাইরে বৃষ্টি আরো বেড়েছে। গাছের পাতা ছুঁয়ে জলের টোপ টোপ করে ঝরে পড়া, সোঁদা গন্ধের তীব্রতা বেড়েই চলল নিস্তব্দতা ছাপিয়ে। বেশ অনেক্ষন চুপ থাকার পরে অনিকেত অন্বেষার হাত দুটো হালকা করে ধরে বললো
-আমাকে বিয়ে করবি ?
অন্বেষা একবার চোখ তুলে অনিকেতের নির্মিলেশ চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে করে হাত টা অনিকেতের হাত থেকে ছড়িয়ে নিয়ে জানলার দিকে ঘুরে বসলো। অন্বেষার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে অনিকেতের কিছুটা অপমানিত বোধ হচ্ছিল, এমন সময়ে অন্বেষা উঠে দাঁড়িয়ে ওড়না তা ভাল করে বেঁধে নিয়ে,অনিকেতের হাত ধরে বললো
-চল আজ দুজনে একসাথে ওই সামনের খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজি। চোদ্দ বছর হয়ে গেল একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি।