ছোটবেলা থেকেই বাঁশিটা দেখে আসছে সন্তু। চওড়া গোল্ডেন ফ্রেমে বাঁধানো, তার হাতের প্রায় দেড় হাত লম্বা চকচকে সিলভার কালারের একটা বাঁশি। অপূর্ব তার কারুকাজ, কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নকশা, কতকাল যে ফ্রেমবন্দী আছে তাতেও এতটুকু বিবর্ণ হয়নি। বরং ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলেট পেপারে যে কৃষ্ণটা ছিল সেটার রং চটে গিয়ে মাঝে মাঝে সাদা ছোপ ছোপ হয়ে গেছে । আর এই বিবর্ণতার জন্যই মনে হয় বাঁশিটাকে আরও বেশি উজ্জ্বল লাগছে। আলো পড়লে এখনও ঝিলিক খেলে যায় । কতদিন যে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে সন্তু তার ইয়ত্তা নাই। চোখ বেঁধে দিলেও বাঁশিটার প্রতিটা নকশার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে দিতে পারবে সে। কিন্তু ওই ইচ্ছা থাকলেও কোনদিন হাতে পায়নি বাঁশিটা।
হালদার বাড়ির বিশেষ দর্শনীয় বস্তু বলতে এই বাঁশিই। দরদালানের মস্ত দেওয়ালে একা অধীশ্বরের মতো শোভা পাচ্ছে। নীচে জলপাই কাঠের টেবিল বার্নিশ করা, তার উপর আবার ঠাকুমার হাতে বানানো টেবিল ক্লথ। টেবিল ক্লথটাই যেন মোহনদ্বীপের ম্যাপ। সুন্দর নকশায় আঁকা এক অপূর্ব দেশ, সারি সারি গাছ, গাছের ফাঁকে পর্বতের মাথা, সেখান থেকে উঁকি মারছে এক টুকরো চাঁদ। মনে হয় রাতের দৃশ্য। কিন্তু কোনও কিছুই অস্পষ্ট নয়, ঝরনা নেমে গেছে পর্বত থেকে, দুপাশে ছড়িয়ে আছে ছোট-বড়ো নুড়ি, ঝরনার ধারে ধারে মাথা ঝুলিয়ে দুলছে রঙবেরঙের ফুল। কিছু পতঙ্গ উড়ছে বটে তবে সেগুলো জোনাকি না প্রজাপতি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঝরনাটা যেখানে পর্বত থেকে নামছে ঠিক সেই জায়গাটা ধূপের আগুনে পুড়ে বেশ একটা অন্যরকম ব্যাপার হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ওখানে একটা গুহা ,ওই গুহার ভিতরে আছে অন্য একটা জগৎ।সন্তু কল্পনায় মাঝে মাঝে ঘুরতে যায় ওই গুহার উল্টোপিঠের জগতে। আর ঠিক তখনই দিদি এসে মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলে – “এ্যাই ন্যাকাচন্ডী হ্যাবলাকান্ত, এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে যা, তোর মাস্টার এসেছে পড়াতে।”
দূর, এই এক জ্বালা সন্তুর, শুধু পড়া পড়া আর পড়া ।সকালে মাস্টার, বিকালে মাস্টার, রাত্রে মাস্টার ।তার উপর আবার সারাটা দিন স্কুলে বন্দী। তবে স্কুলটা ততটাও খারাপ নয়। নামটা আনন্দীবাঈ টাউন স্কুল হলেও স্কুলটা মোটেও টাউনে নয়। শহর থেকে বেড়িয়ে ফাঁকা মাঠ ধরে স্কুল বাস ছুটছে তো ছুটছেই। তারপর অনেকটা দূরে বিশাল বড়ো জায়গা জুড়ে তাদের স্কুল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আর তাদের স্কুলের থেকেও বড় স্কুলের পাশের বটগাছটা বাপরে কত্ত বড় ! কত্ত ঝুড়ি! বড় বড় ঝুড়ি মোটা মোটা থামের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গাছটা পাঁচিলের বাইরে হলেও পাঁচিলের ভিতরে আছে সেই গাছের অর্ধেকটা। ঝুড়ির ফাঁক দিয়ে দিয়ে বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে পাঁচিলটা এমন ভাবে গেঁথে তোলা হয়েছে দেখলে মনে হয় যেন গাছটা আর স্কুলটা হাতে হাতে শিকলি দিয়ে দাঁড়িয়ে।
স্কুলটা যার নামে সেই আনন্দীবাঈ সম্পর্কে স্কুলের ছাত্ররা কয়েকটা কথাই জানে মাত্র, আনন্দীবাঈ ছিলেন এক নিঃসন্তান বিধবা মহিলা, মৃত্যুর আগে তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি পাঠশালা করার জন্য দান করে যান। ব্যাস এটুকুই। কিন্তু হালদার বাড়ি বংশপরম্পরায় বয়ে নিয়ে চলেছে আরও অনেক কথা আরো অনেক কাহিনি।
সেই দিনটা ছিল অঘ্রাণের প্রথম বৃহস্পতিবার। বেশ শীতের আমেজ পড়ে গেছে, আর এই শীতকালটায় একটা অতিরিক্ত কাজ বেড়ে যায় হালদার বাড়িতে। প্রতিদিন লেপ-তোষক টেনে হিঁচড়ে ছাদে তোলা, রোদে গরম করে একেবারে ভাঁজ করে ঘরে তোলা। বাড়ির মেয়েরাই সাধারণত এটা করে থাকে, ব্যাটাছেলে তোর অত সময় কোথা ? সকালের রোদটাই শীতের সব থেকে মিষ্টি রোদ। তাই সকালে যে যার ঘরে লেপ-তোষক নিয়ে গিয়ে ছাদে দেবে রোদে। তবে এ কাজে সন্তুর মত বাচ্চাদেরও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে তো বটেই, রোদে দেওয়ার পর সেই লেপের উপর লাফ- ঝাঁপ। আসলে বাড়িতে পিঠোপিঠি অনেকগুলো কচিকাঁচা থাকলে যা হয়। সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায় বাড়ির মেয়েরা। ছাদ থেকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে স্নান টান করিয়ে সেদিন স্কুলে পাঠানো হয়েছিল সন্তুকে। যদিও স্কুলে পাঠানোর সেদিন কোনো চাপ ছিল না। ফাস্ট পিরিয়ডের পরই স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। কিন্তু উপস্থিত থাকতে হবে সব ছেলেমেয়েকে। এই একটা দিনই আনন্দীবাঈ এর কথা স্মরণ করে স্কুলে ছুটি দেওয়া হয়। আর এই দিনের প্রেয়ার হয় স্কুলের বাইরে ওই বটগাছটার নীচে ব্যাস এইটুকুর মধ্যেই বেঁচে আছেন সেদিনের সেই বিধবা আনন্দীবাঈ।
ব্যাপারটা নজর এসেছিল বেশ কিছুটা বেলায়। বড় জেঠিমাই প্রথম লক্ষ্য করেন, তারপর বুকফাটা হাহাকারে মাতিয়ে তোলেন গোটা বাড়ি,-” ওগো, কি অলুক্ষুনে কান্ড গো, শিগ্গির এসো গো সবাই , এ কি হলো গো”…একে একে সবাই এসে ভিড় করে ফেলেছিল এমন কি বাড়ির কাজের লোকেরা পর্যন্ত চারদিকে খোঁজ খোঁজ বর, কিন্তু খুঁজবে কোথায়? যা চুরি হয়নি তা খুঁজে কোনও লাভ আছে কি? দ্বিতীয় সংবাদটাও এসেছিল ঠিক তখনই, সবাই যখন চিন্তা করে করে ক্লান্ত, গোটা বাড়ির প্রতিটা কোণ বরাবর খুঁজেও ব্যর্থ ঠিক তখন, বিনিই প্রথম বলল -” মা সোনুর স্কুলের বাস কই থামল না তো? সোনুকে না নামিয়েই চলে গেল নাকি?” তখনও অতটা গুরুত্ব দেয়নি কেউ ,-“তাইতো, দাঁড়া তোর বাবাকে বলি”- বলে আবার শোক করতে বসে পড়েছিল মা, একশো বছর ধরে যে জিনিসটা প্রতি পলে পলে চমক দিয়ে গেছে তা যদি বেমালুম গায়েব হয়ে যায় তাহলে তো শোরগোল হবেই । হ্যাঁ , ফ্রেম যেমন কার তেমন দেওয়ালে টাঙানো , শুধু ভিতরে বাঁশিটাই নাই। কেবল যে সোজা বাঁশিটা ছিল সেই সোজা পিছনের ভায়োলেট পেপারটার না চটা রঙ উজ্জ্বল হয়ে এ বাড়িতে বাঁশিটার দীর্ঘদিন উপস্থিতির প্রমাণ দিচ্ছে।
একশো বছর আগে হালদার বাড়ির ঠিক এতটা রমরমা ছিল না। সন্তুর দাদু ষোড়শীমোহনের বাবা ছিলেন অভয়াচরণ, বাঁশিটা পেয়েছিলেন তিনিই। সেই নিয়ে অনেক গল্পকথা হালদার বাড়ির মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে । কোন নতুন অতিথি এলে তাকে আগাগোড়া শোনানো হয় এই বাঁশির ইতিহাস। শুধু রুপে নয় বাঁশি তার পিছনে লুকিয়ে থাকা রহস্য নিয়ে কম অবাক করে না অতিথিদের। কোথাকার না কোন মোহনদ্বীপ থেকে নিয়ে আসা বাঁশি এটা। সেখানে সিঁড়ির মতো মেঘ, ধানক্ষেতের মতো সমুদ্র, আর কুমিরের মতো পর্বত, বাঁশির আওয়াজ শুনলে কুমির ঘুমিয়ে যায়। আর এই বাঁশি বাজিয়ে সন্তুর বাবা মদনমোহনের দাদু অভয়াচরণ সব কুমিরদের ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল । সেই বাঁশি যদি হঠাৎ এই রকম করে চুরি হয়ে যায় সবার চোখের সামনে থেকেই তাহলে কি কারো মাথা ঠিক থাকে ?
আনন্দীবাঈ বিধবা ছিলেন বটে, কিন্তু মোটেই নিঃসন্তান ছিলেন না। ফলিতমোহন ওরফে ফেলু ছিল তার একমাত্র ছেলে। তবে বাপ মরা এই ছেলে ছিল একটু ছন্নছাড়া গোছের। যদিও বিশ্বসংসার কখনও ফলিতমোহনের খোঁজ রাখেনি, খোঁজ করেনি। খোঁজ রেখেছে শুধুমাত্র হালদার বংশ। রূপকথার মতো তার কাহিনি গাঁথা হয়ে রয়েছে হালদার বংশের ইতিহাস। ফলিতমোহন ছিল একটু পাগলাটে গোছের, বাড়িতে বিশেষ থাকত না, ঘুরে বেড়াতো যেখানে সেখানে, আর দিনে দুপুরে আকাশকুসুম রচনা করে যেত। শুধু মায়ের মৃত্যুর পর সেই যে ঘরে ঢুকলো ছেলে, আর ঘর থেকে বের হলো না । ওখানেই তার ইতিহাস শেষ। বেশ কয়েক বছর পর জীর্ণ দীর্ণ সেই ঘর ভেদ করে সবুজ ডালপালা মেলে আকাশের দিকে মাথা তুলে বড় হয়ে ওঠে এই বটগাছ।
প্রেয়ারর পরেই বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে প্রতিবছরের মতো এবারও বড়দি একসাথে শোক, গর্ব ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন আনন্দীবাঈ এর জন্য। তারপর লাইন দিয়ে যে যার ক্লাসে যাবে। আজ জাস্ট রোল কল করেই ছুটি। লাইন দিয়ে গেটের কাছে পর্যন্ত গিয়েও ফিরে আসে সন্তু ।প্রতিদিন বটগাছটা কে দেখলেও এভাবে এত কাছ থেকে তেমন করে কখনো দেখা হয়নি কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে গাছটাকে। যেন কত যুগের অজানা রহস্য পুষে রেখেছে শিরায় শিরায়। স্কুলের কড়াকড়ি ভাবটা আজ তেমন নাই। দু-একটা ছেলেএকটু এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকলেও দিদিরা বকাঝকা করেনি। ছুটির গন্ধ যেমন ছাত্রদের গায়ে লাগে, শিক্ষক- শিক্ষিকার গায়েও কম লাগে না। ভ্যাবলা মার্কা বলে নিজের দিদির কাছে কম গঞ্জনা শুনতে হয় না সন্তুকে। সত্যিই যেনো একটু আপন ভোলা টাইপের ছেলে সে। নিস্পলক চোখে জরিপ করতে থাকে গাছটাকে, যেন কোন মায়াবী জগতে প্রবেশ করছে ক্রমশ। ঠাকুমার টেবিল ক্লোথে এইরকমই একটা গাছের ছবি আছে না! দেখতে দেখতে কখন গাছটার পিছন দিকে চলে গেছে খেয়াল নাই তার। কিন্তু এ কি!
বটগাছের দুটো মোটা মোটা শিকড়ের মাঝখানে একটা গুহার মতো জায়গা , সেখানে বসে আছে একটা ছেলে । তার থেকে বয়সে কিছু বড়ই হবে। মাথায় সোনালী পাতের একটা মুকুট, চোখে উদাস দৃষ্টি, আর হাতে… হাতে তাদের বাড়ির সেই বাঁশি!
-কে তুমি ?
– আমাকে চিনিবে না। আমি ফলিতমোহন। মোহন দ্বীপের রাজা। তোমাকে আমার বড় প্রয়োজন সন্তু। চলো আমার সাথে।
– কোথায়?
– আমার রাজ্যে।
– কোথায় তোমার রাজ্য?
– এই বটগাছের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পথ তাড়াতাড়ি এসো।
– কিন্তু কেন ?
– আমার রাজ্যে বড় বিপদ সন্তু ,একশো বছর আগে তোমার প্রপিতামহের ঘুম পাড়িয়ে রাখা সব কুমির আবার জেগে গেছে। এখন একমাত্র তুমিই পারবে এই বাঁশি বাজিয়ে তাদের আবার ঘুম পাড়িয়ে দিতে।
– এই বাঁশি কোথায় পেলে তুমি ?
-নিয়ে এসেছি তোমাদের বাড়ি থেকে। এখন চলো তাড়াতাড়ি আমার সাথে।
হামাগুড়ি দিয়ে ফলিতমোহনের পিছুপিছু গাছের কোটরের মধ্যে ঢুকে যায় সন্তু।
অন্ধকার হবো হবো ,ঠিক তখনই তাকে খুঁজতে বাইক নিয়ে বড়দা আর বাবা বটগাছটার কাছে এসে দাঁড়ায়। এ কি রে তুই এখানে বসে? এখনও? আর আমরা সারাদিন কোথায় কোথায় না খুঁজেছি তোকে। আরে একি ! এই বাঁশিটা কোথায় পেলি তুই?
-“মোহনদ্বীপে।”- আবিষ্টের মতো বলে ওঠে সন্তু।
আবারও একশো বছর নতুন কোনও অতিথির কাছে গর্ব করে হালদার বাড়ি বলতে পারবে কেমন করে বাঁশি সুরে একসাথে সব কুমির ঘুমের দেশে চলে যায়।