28 C
Kolkata
Wednesday, March 29, 2023
More

    বড়দিনের গল্পঃ ইন্টারভিউয়ের দিনগুলি – অভিরূপ দাস

    “আপনি চলে যাচ্ছেন” ফিরে তাকাল অরিন্দম। মেয়েটার সঙ্গে আলাপ টোটোতে। ডানকুনি মডেল স্কুল শিক্ষক নিয়োগ করছে, ফেসবুকের একটা গ্রুপ থেকে পেয়েছিল খবরটা। বিএড শেষ হয়েছে দু বছর হল। এসএসসি বন্ধ আরো বছর পাঁচেক। এখন প্রাইভেট স্কুল ছাড়ার উপায় কী। কিন্তু ওরা যাকে বলে লেংড়া ঘোড়া। স্পোকেন ইংলিশ ভালো না থাকলে বেসরকারি স্কুলে বাংলা পড়ানোর চাকরিও পাওয়া যায় না। অরিন্দম এখনো বুঝে উঠতে পারেনা পড়াবে বাংলা অথচ ইংরেজিতে ইন্টারভিউ দেবে কেন? সে যাক অন্য দিকটা আরও ভয়ংকর। বেসরকারি স্কুলে যারা ছেলে ভর্তি করে বাংলা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। পেরেন্ট টিচার্স মিটিংয়ে সব স্যারের ডাক পরে, আর বাংলার শিক্ষক অনাহুত অতিথির মত বসে থাকেন টেবিলের এক কোণে। তার দিকে প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এসব কথা অবশ্য বন্ধুদের মুখে শোনা। কিন্তু বিষয়টার আসল এফেক্টটা ও প্রত্যক্ষ করেছে পরে।

    প্রাইভেট স্কুলে বাংলা টিচার মানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রিন্সিপালের মাসতুতো দাদার ছেলে, নয়তো শালী কিংবা ঐরকম ঐরকম ঐরকম। যাই হোক এবার বেশ কিছুটা বিরক্ত হয়েই বাংলা বাঁচাও আন্দোলনে নেমে পড়েছিল অরিন্দম। শনিবারের ২ঃ১ ইন্টারভিউতে প্রথমেই বলেছিল, “I am giving the interview for a bengali teacher.So I think I should give the interview in bengali.”

    ইন্টারভিউটা হয়েছিল বটে। তবে সেদিনই মনে হয়েছিল চাকরি দেওয়ার জন্য ডেকে এরা তাকে বিরক্ত করবে না। তাই সোমবার সকালে রুটিনমাফিক মেলবক্সটা চেক করতে গিয়ে যথেষ্ট চমকে ছিল অরিন্দম। ডেমো ক্লাসের জন্য ডাক দিয়েছে ডানকুনি মডেল স্কুল। ক্লাস সেভেনের গাধার কান গল্পটার জন্য মডেল এবং চার্ট তৈরি করে নিয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে লেটারে। মঙ্গলবার সকালে সেই মতই ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে হাতে একটা ইয়া বড় বিগসপার নিয়ে ৮.১০ এর লোকালটায় উঠে বসেছিল সে। বিগ সপার কেন যারা বিএড করছে তারা ভালোই জানে। ওই কার্টিজ পেপারের চার্ট আর থার্মোকলের মডেল নিত্যযাত্রীদের দমবন্ধ ভিড় থেকে কোলের ছেলের মত বাঁচিয়ে নিয়ে যাওয়া যে কি কঠিন কাজ, যেকোনো বিএড পাঠরতকে জিজ্ঞেস করবেন?

    গল্প শুরু করেছিলাম টোটোয় আলাপ হওয়া মেয়েটাকে নিয়ে। ওর নাম স্নিগ্ধা মন্ডল। বলতে গেলে অরিন্দমের আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বি। উঠে বসে সবে টোটোওয়ালাকে ডানকুনি মডেল স্কুল বলতে যাবে অরিন্দম, পিছন থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছিল স্নিগ্ধা। “ডানকুনি মডেল স্কুল তো।” প্রতিদ্বন্দ্বীকে একবার মেপে নিয়েছিল অরিন্দম। হাতে সেই একই রকম বিগসপার।পিঠের ব্যাগে একটা কালো ড্রইং সিট হোল্ডার। ব্যস আর কোন সন্দেহ নেই।

    “দাদা আপনার?” সপ্রশ্ন দৃষ্টিতেই জিজ্ঞেস করেছিল টোটোওয়ালা। তার আসল জিজ্ঞাসা অবশ্য একই দিকে তো, নাকি আবার ঘুরে যেতে হবে দুজন প্যাসেঞ্জারের জন্য। ‘সেম’ মাথা নেড়েছিল অরিন্দম। মেয়েদের বর্ণনা দিতে গল্পকার কিম্বা অরিন্দম কেউই খুব একটা পটু নয়। তাই পাঠকের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো নীল তারা, পটলচেরা, হরিণ চোখি, গোলাপ মুখী ইত্যাদি ইত্যাদি। কারণ অরিন্দমের তখন সময় ছিলনা রূপ দেখে মুগ্ধ হওয়ার। প্রথম মুখ খুলেছিল স্নিগ্ধাই, “আপনার সাবজেক্ট?”

    “বাংলা!আপনার?” হালকা হেসে বলেছিল অরিন্দম।
    “আমারও। ডেমো ক্লাসের জন্য সাবজেক্ট কি দিল?”
    “আমাকে দেখে ওদের গাধা মনে হয়েছে কিনা! তাই গাধার কান!”আবারো হাসল অরিন্দম। নিজের পরিস্থিতি নিয়ে মজা করে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা আর কি!
    স্নিগ্ধা বললো,”আরে ওরম বলছেন কেন? আপনি তো তাও ভালো পেয়েছেন আমার আবার ব্যাকরণ! সমাস। কি মডেল বানাবো ভাবতে ভাবতেই দিন কাবার হয়ে গেল।”
    “তা ঠিক ব্যাকারনে মডেল বানানো। উফ! বিএড শেষ হয়েছে কবে?” স্বাভাবিক ভদ্রতায় কথোপকথন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হয়।
    “আমার তো এই বছরই। এখনো সার্টিফিকেট হাতে পাইনি। বর্ধমান ইউনিভার্সিটি তো! চাকরিটা আদৌ দেবে কিনা বুঝতে পারছিনা। ওরা তো শুনেছি সার্টিফিকেট না হলে কিছু দেয় না।”

    “না, না তেমন হলে রেজাল্টেও কাজ হবে।” আশ্বস্ত করে বলল অরিন্দম।

    ২.
    এতক্ষণে সে ভালোই বুঝে গেছে এই মেয়েটা বকতে ভালোবাসে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জীবনের এটা-সেটা কথা শুরু হবে। মেয়েরা সাধারণত অপরিচিতের সাথে এত কথা বলেনা। এর বিষয় কি? যা ভেবেছিল তাই হল। কথাপ্রসঙ্গে এল বিএডের খরচ খরচা। স্নিগ্ধা বলল,”শেষ দশ হাজার টাকার জন্য রেজাল্ট আটকে দিয়েছিল জানেন। এমনিতেই নব্বই হাজারে কথা হয়েছিল।যাহোক করে জোগাড় করেছিলাম আশিহাজার।কিন্তু হঠাৎ এই লকডাউনে বাবার চাকরিটা গেল। আমার টিউশনটাও বন্ধ। মাস খানেক সময় চেয়েছিলাম কলেজের কাছে। রেজাল্ট আটকে দিল।”

    কি বলবে বুঝতে পারছিল না অরিন্দম? তার নিজের অবস্থা কি স্নিগ্ধার চেয়ে বেশি কিছু ভালো। দু বছর বাদেই রিটায়ার করবে মা। কোচিং সেন্টারে এখন সব মিলিয়ে খানদশেক ছাত্র। পারলে ছেড়ে দিত চাকরিটা। দিয়ে দিত স্নিগ্ধাকে। ল্যাংড়া ঘোড়া নিয়ে সে যেমন রেসের ময়দানে নেমে কোঁকাচ্ছে তেমন যেন স্নিগ্ধার না হয়। ও তো প্রথম শুরু করেছে। বাংলাকে ভালবেসে শুরু করেছে। আর অরিন্দম এতদিন ঘাটে ঘাটে ধাক্কা খেতে খেতে ভালই বুঝেছে ভালোবাসা আর কাজকে এক রাস্তায় নিয়ে আসা কতটা কঠিন। কিন্তু অরিন্দম কি করে পারবে? ওর কি ক্ষমতা আছে অত?

    ৩.
    “আপনি চলে যাচ্ছেন।” ডেমো ক্লাসের আগেই উঠে চলে আসছিল অরিন্দম। আর তাই দেখে প্রশ্নটা করেছিল স্নিগ্ধা।
    “হ্যাঁ, অন্য একটা জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম এর আগে। ওরা কল করেছিল। চাকরিটা আমার হয়ে গেছে। এটা আপনার জন্যই থাক।”
    “আমাকে দয়া করছেন। আমি কিন্তু আপনার দয়া পাওয়ার জন্য কথাগুলো বলিনি।”কঠিন মুখে বলল স্নিগ্ধা।
    “না, দয়া করছিনা। আমি আপনার অনেক আগে শুরু করেছি। যে যন্ত্রণাটা আমি পেয়েছি, সতীর্থ হিসেবে আপনাকে সেটা দিতে চাইনা। বাংলা নিয়ে এই মুহূর্তে বাজারে চাকরি খোঁজা কতটা কঠিন আমি জানি।” আর দাঁড়ায়নি অরিন্দম বেরিয়ে এসেছিল সোজা। স্কুলের ক্যাম্পাস পেরিয়ে রাস্তায় উঠে হাঁটা লাগিয়েছিল স্টেশনের দিকে। না, চাকরিটা এমনি এমনি ছেড়ে আসেনি অরিন্দম। অতটা করার ক্ষমতা তার নেই।
    বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে বাথরুমের দিকে ফ্রেস হতে যাচ্ছিল সে, আর তখনই স্টাফ রুম থেকে ভেসে আসা কথাটা কানে আসে ।
    “ছেলেটা ভালো তবে স্নিগ্ধা মেয়েটাকে দেখলে? গ্লামার আছে কিন্তু। প্যারেন্ট-টিচার্স মিটিংয়ে গ্ল্যামারটাও তো দরকার। ওই যে কথায় বলে না আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী।”

    এরপর কি করত অরিন্দম? গিয়ে বলত স্নিগ্ধাকে। গুন ফুন নয় স্রেফ তার রূপ দেখেই মুগ্ধ তারা। তারচেয়ে এটা কি বেশি ভালো হলো না। হয়তো হলো হয়তো বা হলো না।সত্যিই কি কিছু এসে যায় অরিন্দমের?

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    আসন্ন IPL-এ কোন দলের অধিনায়ক কে হলেন ?

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : কলকাতা নাইট রাইডার্স সোমবার তাদের দলের অধিনায়কের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ১০টি আইপিএল দলের...

    বাড়ল প্যান ও আধার সংযুক্তিকরণের সময়সীমা ! সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : কেন্দ্রের তরফে আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল, চলতি মাসের মধ্যেই প্যান ও আধার লিংক করিয়ে...

    মোদীর লক্ষ্য ৪০০ পার ! বঙ্গে বিজেপির লক্ষ্য ২৫

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : দিল্লি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছে। আব কি বার ৪০০ পার। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে সারা...

    মাঝে মাঝেই জ্বরে ভুগছেন ? মুক্তি পেতে ভরসা রাখুন হোমিওপ্যাথিতে

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : জ্বরের অনেক কারণ থাকতে পারে তৎসহ জ্বরের বিভিন্ন উপসর্গ থাকে। নীচে জ্বরের উপসর্গ অনুযায়ী...

    ৩রা এপ্রিল ছুটি ঘোষণা করল রাজ্য সরকার !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য সুখবর। এবার মহাবীর জয়ন্তীতেও ছুটি দিচ্ছে রাজ্য সরকার। শনিবার...