বিহারে বাজিমাত করল বিজেপি। জনজোয়ারের মোড় ঘোরালেন মোদি। তাঁর নির্বাচনী রণনীতির তুখোড় দুই তিরে ১১০য়ে স্তব্ধ হল তেজস্বীর অশ্বমেধের ঘোড়া। তেজী ঘোড়া গোড়া থেকেই রণক্ষেত্রে দাপিয়েছে। একজিট পোল যাই বলুক প্রাক সমীক্ষায় পোল স্টারেরা ভোটের আগেই হারিয়ে দিয়েছিলেন মহাগঠবন্ধনকে। সেই হেরে যাওয়া খেলাকে জয়ের দরজায় নিয়ে এসেও শেষরক্ষা করতে পারেননি গঠবন্ধনের নেতা তেজস্বী। তার কারণ মোদীর তূণীরের দুটি মোক্ষম মারণাস্ত্র।
বিরোধী মহাজোটের সর্বাধিনায়ক লালুপুত্র সরাসরি যুদ্ধ করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে। আর এনডিএর প্রধান নেতা প্রধানমন্ত্রীর মূল সেনাপতি অমিত শাহ লড়াই পরিচালনা করেছেন মেঘের আড়াল থেকে। নীতীশ ছিলেন শুধু নাম কে ওয়াস্তে এনডিএর নেতা। কিন্তু তাঁর প্রতি জনরোষের কুরূপ দেখে বিজেপি নির্বাচনের রাশ নিজের হাতেই টেনে এনে চাণক্য নীতি প্রয়োগ করে। বারোটি জনসভায় মোদী ১২০টি কেন্দ্র ছুঁয়ে যান দফায় দফায় প্রচার সভা করে। বিজেপির বীজমন্ত্র ছিল , “মারি অরি পারি যে কৌশলে।” তাই ১৫ বছরের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমারের বিরুদ্ধে জনমতের চোরাস্রোত দেখে আলগোছে ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর বা ক্ষমতায় থাকার ফলে জনরোষের বোঝাটি তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।
নীতীশ যখন এটা বুঝতে পারলেন তখন খেল প্রায় খতম। তবুও চাপের মুখে প্রবীণ প্রাজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ মুখ্যমন্ত্রী পূর্ণিয়ার সভায় বলে দিলেন “অন্ত ভলা তো সব ভলা।” সব ভাল যার শেষ ভাল। বললেন, এটাই আমার “আখরি চুনাও।” এই বার্তা ছড়িয়ে একসঙ্গে দুটি ঘুরি ওড়াতে গেলেন। একটায় সহানুভূতির হাত। আরেকটায় বিজেপির ঋণস্বীকার। যেতে যেতে তাদের প্রোমোট করে যাওয়া। কারণ নীতীশ না থাকলে বিজেপিকে বিহারে কার্যত একক শক্তিতে বা বিগ ব্রাদারে রূপান্তরের কাজটি করার মতো আর কোনও অনগ্রসর অবিজেপি নেতা নেই এই সংসারে


ঠিক আজকের কথা ভেবেই ১৩ বছর নীতীশকে সারথী করে রথ টেনেছে বিজেপির ঘোড়াগুলি। যারা হল বিহারের সামন্ত সমাজ। কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ভূমিহার, কেউ রাজপুত আর কেউ কায়স্থ বা বৈশ্য। তথাকথিত উঁচুজাতের বিপুল প্রভাবশালী সমাজপতিরা লালুর ১৫ বছরে নিচুতলার নিপীড়িত মানুষকে সুরক্ষাহীনতায় পীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে জোট বাঁধতে দেখে প্রমাদ গণেছেন। শাসক শ্রেণীর সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে বিহারে একথা শাসনের সহ্য হয়নি এবং চারা ঘোটালার সুবাদে লালুর কারাবাস ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার অবনতি লালুবিরোধী উঁচুজাতের ঐক্য গড়তে সহায়তা করে।
জমি তৈরি করে দেয় জনতাদলের ভাঙন। জর্জ, নীতীশ, শরদ, রামবিলাসের মতো সমাজবাদী আন্দোলনের নেতারা লালুর বিরুদ্ধে জোট গড়েন বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে। কংগ্রেসও উচ্চ বর্ণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে যখন লালুর পাশে দাঁড়ায় তখন তারাই সর্বহারা। অথচ লালুর কারাবাসের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত হয়েছিল
রাহুল গান্ধীরই ভূমিকায়। সততার প্রতীক হিসেবে তাদের যুবরাজের ভাবমূর্তি উন্নয়নে কিছু কং নেতা লালুর বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। এঁদেরই পরামর্শে রাহুল লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের হাত থেকে যে আইন সংশোধনের প্রস্তাবটি কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন তাতে লালুর মতো অভিযুক্তদের কিছুটা রক্ষাকবচ ছিল। তখনও রাহুল গান্ধী ভাবতেন, লালুর বিরুদ্ধে নীতীশকুমারের সঙ্গে জোট করে কেল্লা ফতে করবেন। তখনও কংগ্রেসের দিশা চূড়ান্ত করার অধিকার ছিল না প্রকৃত প্রবুদ্ধ নেতাদের।


ফলে লালুকে দুর্বল ও কোণঠাসা পেয়ে উচ্চনীচ বর্ণের লালু বিরোধী দলগুলো জবরদস্ত গোষ্ঠী সৃষ্টি করল। একসময় বামদলগুলোও লালু বিরোধী জেহাদে শামিল হয়েছিল। ফের সমস্ত শক্তির পুনর্বিন্যাস হতে হতেই ভাঙাগড়ার খেলায় আপাত লাভবান নীতীশকে লালুর আদালত কথিত “জঙ্গল রাজের” বিরুদ্ধে মাথায় তুলে নিল উঁচুজাতের দলগুলো। জাতের বিভাজনের বিরুদ্ধে নীতিগত অবস্থান আর এস এসের। তারা মুখে বলে, হিন্দু ঐক্য দুর্বল করে জাতপাতের লড়াই। অথচ, বিহারের রাজনীতিতে সংঘ ও বিজেপির প্রত্যেকটি পদক্ষেপ জাতপাতের বিভাজনের ভিত মজবুত করেছে। এর পাশাপাশিই চলেছে ধর্মীয় বিভাজনের জিগির। এই রাজনীতিরই চূড়ান্ত রূপ দেখল এবার বিহার। যখন তথাকথিত উঁচুজাতের শ্রেণীঘৃণাকে উস্কে দিল বিজেপি।
সরকারের ওপর জনগণের অসন্তোষ আঁচ করে নিম্নবর্ণের ( কুর্মি ) নেতা নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধেও উচ্চবর্ণের বিদ্বেষে ধোঁয়া দিল। নীতীশ বিরোধী রামবিলাসের ছেলে চিরাগকে আলাদা লড়াইয়ে নামিয়ে নীতীশ কুমারের দলের ভোট ভেঙে দেওয়া হল। চিরাগের দল দাগ কাটতে পারেনি আসনের অঙ্কে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় নীতীশের জেডিইউ দলের ভোট কাটুয়া হিসেবে নাম লিখিয়েছে। নীতীশ কুমারের সব প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয় চিরাগের দল লোক জনশক্তি। ফলে ন্যূনতম দশ হাজার করে ভোট কেটে নিয়ে জনতাদল ইউ এর প্রার্থীদের হারিয়ে দেয়।
এরই পাশাপাশি আরজেডির মুসলমান ভোট কমাতেও বিজেপির সেবায় লেগেছে আসাদুদ্দিন ওয়েসির মিম। মিমের এই সেবা অবশ্য মোদি জমানায় প্রথম নয়। আসাদুদ্দিন আগাগোড়াই বিজেপির সেবাদাস। শুধু ভোটের সময় হায়দরাবাদের বাধ্যতায় হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতার জন্য কংগ্রেস জোট থাকেন। অথচ মিমের আদি নেতা ওঁর বাবা সুলতান সালাহউদ্দিন ওয়েসি ওই হায়দরাবাদেরই সাংসদ হতেন। ওঁর প্রভাবেই ওই কেন্দ্রে কোনওদিন আর কেউ জিততে পারত না। সালাহউদ্দিন কিন্তু রাষ্ট্রীয় মোর্চার শরিক ও জনতা দলের প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংয়ের সুহৃদ ছিলেন। কোনও দিন সাম্প্রদায়িকতা বা মার্কিনঘেঁষা রাজনীতির দালালি করেন নি।
বিহারের গত নির্বাচনেও মিম প্রার্থী দিয়েছিল মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। এবার তারা পাঁচটি আসন পেয়েছে এবং মোট অন্তত ১৫ আসনে গঠবন্ধনকে হারিয়ে বিজেপিকে জিতিয়েছে। চিরাগ চালে নীতীশকে এবং মিম ফাঁসে তেজস্বীকে রুখে মোদিরথ নিরঙ্কুশ হয়েছে বটে, তবে ম্যাজিক সংখ্যার চেয়ে মাত্র তিনটি আসনে এগোতে পেরেছে বিজেপির এনডিএ। লোকসভায় ২২৩ টি বিধানসভা কেন্দ্রে জিতেছিল শাসকজোট। এবার জিতল মাত্র ১২৫ টিতে। ৯৮ টি আসন কমল কমলজোটের। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে। এটা মোদির জয়ের কোন পরাকাষ্ঠা ? তার মধ্যে শাসক জোটের মুখ্যমন্ত্রীর দলই পৌঁছল তিন নম্বরে। এবং অন্তত দশটি আসনের ফলাফল নিয়ে রয়ে গেল নানারকম অভিযোগ।
গণনা, পুনর্গণনা ও ঘোষণা নিয়ে কারচুপির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। সুতরাং উন্নয়নের জন্য ভোট দিয়েছেন যুবা ও নারীরা, বলে প্রধানমন্ত্রী টুইট করেছেন। যা প্রকৃত ঘটনাক্রমের সারাৎসারকেই অস্বীকার করেছে। এবং ভোটের ফলাফলের চূড়ান্ত ছবি দেখে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন শিবসেনার মুখপাত্র সঞ্জয় রাউত। বলেছেন, বিহার নির্বাচনের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ তেজস্বী। কম মার্জিনে জেতা বিজেপি ও এনডিএর আসনগুলো নিয়ে সন্দেহ নিরসনের কোনও সম্ভাবনা নেই। অন্তত এনিয়ে সমস্ত অভিযোগে নির্বাচন কমিশন যতটা আত্মস্থ , তাতে সব দলই কিল খেয়ে কিল হজম করেছে। কিন্তু নীতীশ কুমারের হজম হচ্ছে না। তিনি ফলাফল দেখে থেকে ভাবছেন , এখন তাঁর গদি তো থাকছে , কিন্তু অর্ধেক শতাব্দীর অর্জিত সম্মান ? সেই অমূল্য অর্জন জলাঞ্জলি দিয়ে গদি আঁকড়ে থাকবেন , এমন নীতীশকে এখনও কেউ দেখেনি।
এনডিএর সঙ্গ ছেড়ে লালুর সঙ্গে গিয়েও ফিরে এসেছিলেন তো স্বাভিমান জলাঞ্জলি দেননি বলেই। তেজস্বীর ফর্দ মেনে অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারেন নি। প্রত্যাখ্যান করেছেন, জোট ছেড়ে ঝুঁকি নিয়ে পুরনো জোটে ফিরেছেন। নীতীশ কুমারের গুণগ্রাহীরা তো তাঁর এই “আপসহীন লড়াইয়ের” প্রশংসা করে থাকেন। কারও তাঁবেদারী করে আখের গোছানোর রাজনীতি তিনি করেন না । এটিই তো স্বতঃসিদ্ধ সমীকরণ। তাহলে স্বঘোষিত “মোদির হনুমান” চিরাগ পাসোয়ানের নীতীশ নিধন অভিযানের সাফল্য ও ভোটে দলের ব্যর্থতার জবাবে একদিন কেন নীরব থাকলেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং তার পরদিন প্রধানমন্ত্রীর প্রশস্তিসহ টুইট করলেন ! বিজেপিতে দাবি উঠল “বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী করা হোক। জেডিইউ যখন প্রথম হয়নি জোটে, তখন তারা মুখ্যমন্ত্রী পাবে কেন ?” গিরিরাজ সমর্থন করলেন এই দাবি। বললেন, আজ না হোক কাল বিজেপিরই মুখ্যমন্ত্রী হবে বিহারে। বিহারজুড়ে কার্যত অভ্যুত্থান উচ্চবর্ণের। ভূমিহারদের প্রকাশ্য নীতীশ-নিন্দার সমাচারেও সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নীরব।
ভোটের প্রচারে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যৌথ মঞ্চে দাঁড়িয়ে “নীতীশ কুমার মুর্দাবাদ” আর “মোদী জিন্দাবাদ” ধ্বনি শুনতে হয়েছে। মেজাজ হারিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছেন নীতীশকুমার। এবং ফলাফল প্রকাশের ধরণ দেখেই নীতীশ কিছু একটা চরম সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ রুদ্ধ দ্বার বৈঠক চলে অনেক রাত পর্যন্ত। অমিত শাহ ফোনে এবং সশরীরে সুশীল মোদী। ওইদিন রাতেই নীতীশ সরে যেতে চান। কিন্তু বিজেপির অনুরোধে থেকেই যান। উপযুক্ত সময়ে ছেড়ে দেওয়ার কথায় দুপক্ষ একমত হয়। কিন্তু চিরাগ ও এলজিপি এবং নীতীশ ও জেডিইউ একসঙ্গে একজোটে থাকেন কীকরে ? এবং সফল রণনীতিতে নির্বাচনী সাফল্য অর্জনের পর ডানা ছাঁটা নীতীশকেই মুখ্যমন্ত্রী রেখে মোদী ঐশ্বর্যময়, প্রতাপশালী ও মহান হলেন। কিন্তু রাজনৈতিক অধিকার, সম্মান, প্রতিপত্তি ও নেতার উচ্চতা হারিয়ে নীতীশ কী পেলেন ? শুধু বিজেপির কৃপায় পাটনায় তাঁর নেই রাজ্যের রাজপাট ? যেকোনো মুহূর্তে বড় শরিক বিজেপি চাইলে যা তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে নিঃশর্তে।