দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: লাদাখের আশ্চর্য সন্তান সোনম ওয়াংচুক। থ্রি-ইডিয়টস ফিল্মের ফুংশুক ওয়াংরু চরিত্রটা অনেকাংশেই তার ওপর চিত্রায়িত। লাদাখ এর হিমালয়ান-মরুভূমিতে বসবাসকারী এই ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানী এই কয়েক সপ্তাহ আগেই চীনা অনুপ্রবেশ নিয়ে নিজের সোসাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে আবেদন করেছিলেন চায়না দ্রব্য ত্যাগের জন্যে। সারাও পেয়েছেন তিনি। দেশের মানুষ তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে চীনা দ্রব্যের ক্রয়ে বলেছে ‘না’। গতকাল তিনি আরও একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন। এই বার্তায় শুধু দেশ নয়, সারা বিশ্বের কাছে একটা বড় আবেদন রেখেছেন তিনি।
তিনি যা যা বলেছেন, সরাসরি দেওয়া হল এই প্রতিবেদনে:
“নমস্কার, আমি সোনম ওয়াংচুক। ট্রান্স-হিমালয়ান মরুভূমি লাদাখ থেকে বলছি। আমরা এই ২৯ সে জুলাই ‘বৃষ্টি দিবস’ পালন করেছি। কিন্তু আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো এই প্রশ্ন করবেন আপনাদের আবার ‘বৃষ্টি দিবস’ পালনের কী প্রয়োজন? কারণ আপনারা একটি মরুভূমি তে বাস করেন যেখানে বৃষ্টি ও তুষার মিলিয়ে মাত্র ৪ ইঞ্চি পুরু চাদর বিছিয়ে দেয়। হ্যাঁ, আপনারা হয়তো ঠিক, কিন্তু আমি সব সময় বলি যদি আপনাকে স্বাস্থ্যর মূল্য জানতে হয় তাহলে একজন রুগ্ন মানুষ কে প্রশ্ন করুন কোনো কুস্তিগির কে নয়। যদি আপনার ধনসম্পত্তির মূল্য জানতে হয় তাহলে প্রশ্ন করুন ভিক্ষুককে কোন রাজা মহারাজ কে নয়।
এবং আপনি যদি প্রতি বিন্দু জলের মূল্য জানতে চান তাহলে মরু অঞ্চলের একজনকে প্রশ্ন করুন, আমাজনের মানুষ কে নয়। এই বিস্তৃত মরুভূমিতে, যেটি চাঁদের জমি বা মঙ্গলের জমির সাথে সাদৃশ্য রাখে, সেখানে এক বিন্দু জলের মূল্য অনেকটাই। এখানে জীবনের বিকশিত হয়ে ওঠা একমাত্র হিমবাহর জন্যে সম্ভবপর হয়েছে। যদিও এখনকার মানুষ নিজের আকাঙ্ক্ষার চেয়েও বৃষ্টি কে বেশি ভয় পান। কারণ এখানে বৃষ্টি তখন আসে না যখন মানুষ তাকে চায় বরং এটি যখন আসে তখন মানুষ ভয়ে থাকে কারণ পর্বতের ঢাল থেকে নেমে আসা হড়পা বান মানুষের জীবন ও সম্পত্তি এক লহমাতেই নষ্ট করে দেয়।
ধন্যবাদ হিমবাহ গুলোকে, যাদের জন্যে এই চাঁদের মত স্থলেও জীবন বেড়ে উঠতে পারছে। এই হিমবাহ গুলো কয়েক শতক ধরে নিজেদের বুকে তুষার কে আগলে রেখেছে। এটি যখন গ্রীষ্ম ও শরত্ কালে গলতে থাকে, তখন কৃষকেরা বিভিন্ন ফসল ফলানোর সুযোগ পান। যেমন – বার্লি, গম আর ফলের মধ্যে অ্যাপরিকট, আপেল এবং প্রায় সমস্থ ধরণের সবজি।
কিন্তু এই মূহুর্তে দু:শ্চিন্তার কারণ হলো, এই হিমবাহ গুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তণ তাদের গলে যেতে সাহায্য করছে। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত গতিবিধির কারণেই আর মাত্র ৩০-৪০ বছরের মধ্যেই এই হিমবাহ গুলি ভ্যানিস হয়ে যাবে। তখন আমাদের হাতে আর মাত্র দুটি উপায় থাকবে। হয় এই জমি ত্যাগ করে জলবায়ু-উদ্বাস্তু হয়ে অন্য কোথাও সরে যেতে হবে অথবা বৃষ্টির সাথে বেঁচে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে যতই স্বল্প হোক না কেনো তার পরিমাণ। আর, ঠিক এটাকেই আমরা আমাদের বিকল্প স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানোর চেষ্টা করছি।
আমারা বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করে মরুভূমির এই স্বল্প পরিমাণ বৃষ্টিকে সেচের কাজে লাগিয়ে কিভাবে দেশীয় গাছপালাকে বড় করা যায় যাদের খুব অল্প জলের প্রয়োজন হয় তা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবং আমাদের উদ্দেশ্য একটি দেশীয় গাছের বনাঞ্চল তৈরি করা যারা হটাত্ করে আসা প্রচুর বৃষ্টির জল ধরে রাখতে সহায়তা করবে এবং সেই সাথে আকস্মিক বন্যাকেও প্রতিরোধ করে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করবে।
এই জল ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঢালে মিশে যাবে এবং আশাকরা যায় দীর্ঘকালীন ধীর লয় বৃষ্টির সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে নতুন করে এই মরুভূমিতে প্রাণের সঞ্চার ঘটাবে। এটাই সর্বোত্তম উপায় যা আমরা প্রচেষ্টা করে দেখতে পারি।
আজ এই ২৯ শে জুলাই, আমি একটা গাছ রোপণ করেছি যাতে এটি বিনিময়ে আমায় অক্সিজেন দেয়। আমাদের গোলা বারুদ কেনবার জন্যে বা বানানোর জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রয়োজন নেই, আমাদের প্রয়োজন ছোট ছোট ছেলে মেয়ে কে শেখানো কিভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে লড়াই করতে হয়।
সুতরাং, আমাদের তুলনায় যাদের কাছে বৃষ্টি পাতের পরিমাণ বেশি, দয়া করে এই আমার এই বার্তাটি গ্রহণ করুন। এটি লাদাখের মরু-আদিবাসীদের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের কে প্রেরণ করলাম। এবং দয়া করে বৃষ্টির প্রত্যেক বিন্দুকে রক্ষা করুন, কারণ এই বিন্দু বিন্দু জলই একটি মরু কে মরুদ্যান বানিয়ে তুলতে পারে। দয়া করে সরল জীবন যাপন করুন”।
সোনম ওয়াংচুকের এই ভিডিওটি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অফিসিয়াল পেজে পোস্ট করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত মোট ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ রিয়েক্ট করেছেন, শেয়ার হয়েছে ৭৮৪ বার। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য সোনম ওয়াংচুক এর আগে কৃত্তিম হিমবাহ বানিয়ে লাদাখের মানুষদের কে পানীয় জলের সমস্যা থেকে মুক্ত করেছেন। এখন বৃষ্টি ধরে রেখে বনাঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষে তিনি যেনো সাফল্য পান সেটাই চাইছে তার হিতৈষীরা।
ইতিমধ্যে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই কে ধরে রাখতে তিনি অনেক গুলো হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করেছেন। এমন কী একটি বহুল পরিচিত সংবাদ পত্রের প্রথম পাতায় একটি মেড ইন চায়না মোবাইলের সম্পুর্ন পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন দেখে নিজের পেজে লিখেছেন- “ বাহ, ২০ জন শহীদের প্রতি কী সুন্দর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন”। তিনি নেটিজেন দের কাছে প্রশ্ন করেছেন, চায়না মোবাইলের মতই কী এই সংবাদ পত্র কে আমরা বয়কট করতে পারি না?
উল্লেখ্য, লাদাখের মানুষদের কে বাঁচিয়ে রাখতে এই দেশীয় ইঞ্জিনিয়ার বিভিন্ন বিকল্প প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছেন সেই সাথে ‘লাদাখের শিক্ষার্থীর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ শীর্ষক একটি ফাউন্ডেশন ও বিকল্প স্কুল চালান, যেখানে সব কিছুই সৌর বিদ্যুতে সম্পন্ন হয় যেমন রান্না, উষ্ণতা রক্ষা বা এই সৌর বিদ্যুতের ব্যবহারে লাইট জ্বালানো ইত্যাদি ইত্যাদি। তার বিকল্প শিক্ষার বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই জগতজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনার করার একটাই শর্ত, আপনাকে ফেল করতে হবে, পাশ নয়।