দ্যা ক্যালকাটামিরর ব্যুরো: রাম বা রাম লালা, রঘুপতি বা সীতাপতি এই নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যি ভারতবর্ষের হাজার হাজার বছরের লুকিয়ে থাকা ভৌগলিক বৈচিত্র্য, মহাকাব্য, সামুদ্রিক দ্বীপ হয়ে মানুষের স্মরণে এক বীরের রূপ তৈরি করেছে। খুব অবাক হলেও সত্যি, তাঁর সব আছে, রাজ্য, সিংহাসন, পতিব্রতা স্ত্রী, সন্তান, স্নেহের ভাই তবুও সে বনবাসী, ফকির। আর অবাক করা হলেও রামের সেই নিজ ভূমে পুন:প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগে গেল প্রায় চার শতকের ও বেশি সময়।
রামায়ণ সত্যি কী মিথ্যে সে বিতর্কে যাচ্ছি না আজ। কিন্তু রাম নামে যদি কোনো রক্ত মাংসের রাজাও থেকে থাকেন সেই রাজার রাজত্বের নিদর্শন কিন্তু সারা ভারত ভূমে ছড়িয়ে। আর সেখান থেকেই বিশ্বাস আর পরম্পরার শুরু। আজ ৫’ই আগস্ট ,২০২০ দিনটি ভারতের (ইন্ডিয়া নয়) হ্যাঁ সনাতন ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ যেন করোনা আবহে নিজ পুত্রের ঘরে ফিরে আসার উত্সব। আজ এই প্রসঙ্গে একটু পিছিয়ে দেখা যাক
স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকদের মতে, ১৫২৮ সালে হিন্দুদের অন্যতম আরাধ্য দেবতা রাম যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন সেখানেই মোঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে তাঁর সেনাপতি মীর বাকি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
এর ঠিক ৩২৫ বছর পর অর্থাত্ ১৮৫৩ সালে ধর্মকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো এই অঞ্চলটিতে একটি দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন দুই ধর্মের লোকজনেরই উপাসনার জন্য জায়গাটিকে পৃথক করার উদ্দেশ্যে বেষ্টনী নির্মাণ করেন। যেখানে বেষ্টনীর ভেতরের চত্বর মুসলিমদের এবং বাইরের চত্বর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যবহার করার জন্য নির্ধারিত হয়।
এইভাবেই চলেছে প্রায় ১০০ বছর। এর পর স্বাধীনতার ঠিক দু-বছর পরে ১৯৪৯ সালে এই মসজিদের ভেতর ভগবান রামের মূর্তি স্থাপন করা হয়। যদিও স্থানীয় হিন্দুদের বিরুদ্ধে মূর্তিগুলো রাখার অভিযোগ ওঠে। এতে মুসলিমরা প্রতিবাদ জানালে দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা করে। পরবর্তীকালে সরকার চত্বরটিকে একটি বিতর্কিত স্থান বলে ঘোষণা করে এবং মন্দিরের দরজা সকলের জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) নেতৃত্বে ভগবান রামের জন্মস্থান পুনরুদ্ধার এবং তার সম্মানের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিটি গঠন করা হয়। তৎকালীন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি (পরবর্তীকালে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) ঐ আন্দোলনের নেতৃত্ব নেন।
১৯৮৬ সালে অযোধ্যা জেলার বিচারক নির্দেশ দেন যেন বিতর্কিত মসজিদের দরজা উন্মুক্ত করণের মাধ্যমে হিন্দুদের সেখানে উপাসনার সুযোগ করে দেওয়া হয়। মুসলিমরা এই নির্দেশের প্রতিবাদে বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে।
১৯৮৯ সাল : বিতর্কিত মসজিদ সংলগ্ন স্থানে রাম মন্দিরের ভিত্তি স্থাপনের মাধ্যমে নতুনভাবে প্রচারণা শুরু করে ভিএইচপি।
১৯৯০ সাল : ভিএইচপির কর্মীরা হামলা চালিয়ে মসজিদের আংশিক ক্ষতিসাধন করে। তখন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর সকলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিতর্ক সমাধানের চেষ্টা করেন। যদিও পরের বছর তা বিফল হয়ে যায়।
১৯৯১ সাল : অযোধ্যা উত্তরাঞ্চলীয় যে রাজ্যে অবস্থিত, সেই উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি।
১৯৯২ সাল : ভিএইচপি, বিজেপি এবং শিব সেনা দলের সমর্থকরা মসজিদটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে গোটা ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে হওয়া দাঙ্গায় ২ হাজারের অধিক লোকের প্রাণহানি হয়।
১৯৯৮ সাল : তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির অধীনে পুনরায় জোট সরকার গঠন করে বিজেপি।
২০০১ সাল : মসজিদ ধ্বংসের বার্ষিকীতে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা শুরু হয়। যে কারণে স্থানটিতে ফের মন্দির তৈরির দাবি তোলে ভিএইচপি।
২০০২ সালের জানুয়ারি : প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি নিজের কার্যালয়ে একটি অযোধ্যা সেল গঠন করেন। যেখানে সংশ্লিষ্ট হিন্দু ও মুসলিম নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিনিয়র কর্মকর্তা শত্রুঘ্ন সিংকে নিযুক্ত করা হয়।
ফেব্রুয়ারি ২০০২ : উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনের তফসিলে বিতর্কিত স্থানে মন্দির নির্মাণের বিষয়টি বাদ দেয় ক্ষমতাসীন বিজেপি। যদিও ভিএইচপি একই বছরের ১৫ই মার্চের মধ্যে মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরুর ঘোষণা দেয়। এতে শত শত স্বেচ্ছাসেবক বিতর্কিত স্থানে জড়ো হতে শুরু হয়। তখন অযোধ্যা থেকে ফিরতে থাকে হিন্দু অ্যাক্টিভিস্টদের বহনকারী একটি ট্রেনে হামলার ঘটনায় অন্তত ৫৮ জনের প্রাণহানি হয়।
মার্চ ২০০২ : ট্রেনে হামলার জের ধরে গুজরাটে ব্যাপক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। যেখানে প্রায় ১ হাজার থেকে ২ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে।
এপ্রিল ২০০২ : ধর্মীয়ভাবে পবিত্র এই স্থানটির প্রকৃত মালিকানার দাবিদার ঠিক কারা, মূলত তা নির্ধারণের জন্য হাইকোর্টে তিন বিচারক শুনানি আয়োজন করেন।
২০০৩ সালের জানুয়ারি : ঐতিহাসিক এই স্থানটিতে ভগবান রামের মন্দিরের কোনো নিদর্শন আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য আদালতের নির্দেশে নৃতত্ববিদরা জরিপ শুরু করেন।
অগাস্ট ২০০৩ : প্রকাশিত জরিপের ফলাফলে যে মসজিদের নিচে মন্দিরের চিহ্ন পাওয়া যায়। যদিও মুসলিমরা এই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হিন্দু অ্যাক্টিভিস্ট রামচন্দ্র পরমহংসের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি বলেন, ‘আমি মৃত ব্যক্তির আশা পূরণ করতে চাই এবং অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ করব।’ যদিও তখন তিনি আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘কেবল আদালতের নির্দেশে এবং সকলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের সমাধান হবে।’
সেপ্টেম্বর ২০০৩ : বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পেছনে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে স্থানীয় সাতজন হিন্দু নেতাকে বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে রুল জারি করেন আদালত। তখন তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানির- যিনি ১৯৯২ সালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি।
অক্টোবর ২০০৪ : বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা আদবানি জানান, তার দল এখনো অযোধ্যায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ এবং তা অবশ্যম্ভাবী।
নভেম্বর ২০০৪ : উত্তর প্রদেশের একটি আদালত রায় প্রদান করেন, মসজিদটি ধ্বংস করার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকায় বিজেপি নেতা আদভানিকে রেহাই দিয়ে আদালতের জারি করা পূর্ববর্তী আদেশ পুনর্যাচাই করা উচিত।
জুলাই ২০০৫ : সন্দেহভাজন মুসলিম সন্ত্রাসীরা বিস্ফোরক ভর্তি একটি জিপ দিয়ে বিতর্কিত স্থানটিতে হামলা চালিয়ে সেখানকার চত্বরের দেয়ালে গর্ত তৈরি করে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয় ছয়জন, যাদের মধ্যে পাঁচজনই জঙ্গি বলে দাবি করে নিরাপত্তা রক্ষীরা।
জুন ২০০৯ : মসজিদ ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে থাকা লিবারহান কমিশন তদন্ত শুরু করার ১৭ বছর পর তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।
নভেম্বর ২০০৯ : প্রকাশিত লিবারহান কমিশনের প্রতিবেদনে মসজিদ ধ্বংসের পেছনে বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। যদিও তা নিয়ে সংসদে ব্যাপক হট্টগোলের শুরু হয়।
সেপ্টেম্বর ২০১০ : এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন, স্থানটির নিয়ন্ত্রণ ভাগাভাগি করে দেওয়া উচিত। আদালতের রায় অনুযায়ী সেখানকার এক-তৃতীয়াংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ মুসলিমদের, এক-তৃতীয়াংশ হিন্দুদের এবং বাকি অংশ ‘নির্মোহী আখারা’ গোষ্ঠীর কাছে দেওয়া উচিত।
এতে যেই অংশটি বিতর্কের কেন্দ্র এবং যেখানে মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল, মূলত তার নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয় হিন্দুদের কাছে। একজন মুসলিম আইনজীবী বলেন, ‘আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।’
২০১১ সালের মে মাস : ২০১০ সালের রায়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম উভয় পক্ষই আদালতে আপিল করে। যা প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের পূর্ববর্তী রায় বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট।
নভেম্বর ২০১৯ : বিতর্কিত এই স্থানটিতে মন্দির তৈরি এবং মুসলিমদের জন্য অন্য স্থানে মসজিদ নির্মাণের পক্ষে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট।
২০২০: আজ ৫’ই আগস্ট বুধবার অযোধ্যার সেই বিতর্কিত অংশে আদালতের নির্দেশে মন্দির স্থাপনের জন্যে ভূমি পুজোর ক্ষণ নির্ধারিত হয়। সেই উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লি থেকে অযোধ্যার উদ্দেশে রওনা দেন সকাল ৯-৩৫ মিনিটে। লখনউ পৌঁছন সকাল ১০-৩৫ মিনিট নাগাদ। সেখান থেকেই ১০-৪০ মিনিটে অযোধ্যার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি।
অযোধ্যায় পৌঁছন মোটামুটি ১১-৩০ মিনিটে। ১১-৪০ মিনিটে হনুমানগড়িতে পুজো দিয়ে এরপর ঠিক দুপুর বারোটায় রাম জন্মভূমি পরিসরে পৌঁছন প্রধানমন্ত্রী মোদী। স্মারক হিসেবে পোস্টাল স্ট্যাম্প রিলিজ করলেন প্রধানমন্ত্রী।


সেখানে প্রথমে রামলালার দর্শন করে বিশেষ পুজো দেন তিনি। এরপর বৃক্ষরোপণ করেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় শুরু হয় রাম মন্দিরের ভূমিপুজোর মূল অনুষ্ঠান। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী। দেন পুষ্পাঞ্জলি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভূমি পুজোয় উপস্থিত রয়েছেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত, উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল আনন্দীবেন পটেল। রাম মন্দির তৈরির স্বপ্নকে সফল করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানালেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।


কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া লাল রঙের গাঁদাফুল দিয়েই আজ অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপূজন হল৷ ঘড়ির কাঁটা ১২টা ৪৪ মিনিট ৮ সেকেন্ড হওয়া মাত্রই মন্ত্রপূত রূপোর ইট স্থাপনা করেন প্রধানমন্ত্রী৷ মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ রাম মন্দির ভূমি পুজোর জন্যে পাঠিয়েছেন ১১টি রুপোর ইঁট। মোরাদাবাদের একটি সংস্থা ভূমি পুজোর জন্যে প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী পাঠিয়েছে অযোধ্যায়। শুধু তাই নয় রাম মন্দিরের ভূমি পুজোয় উপস্থিত প্রত্যেক অতিথির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বিশেষ রুপোর মুদ্রা।
উত্তরপ্রদেশ সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়েছে সামাজিক দূরত্ব মেনেই ভূমিপুজোর আয়োজন করা হয়েছে। মাটির প্রদীপে সেজে উঠেছে ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার আনন্দে হাজার বছরের অযোধ্যা।