দ্যা ক্যালকাটামিরর ব্যুরো: ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার অব্যবহিত পরেই গান্ধিজি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে এপ্রিল ‘হরিজন’ পত্রিকাতে ‘ভারত ছাড়ো’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন । এই প্রবন্ধে তিনি বলেন ” ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবিলম্বে অবসান চাই ।
তখন সমগ্র বিশ্বে যুদ্ধ চলছে। ইংরেজ ভারতীয়দের সেনবাহিনীতে ভর্তি করে জাপানের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনায় ব্যস্ত। গান্ধীজি জানতেন ভারতে ব্রিটিশের উপস্থিতি জাপানকে ভারত আক্রমণ করতে প্ররোচিত করবে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে ভারতের স্বাধীনতা চাই ই চাই এবং সেটা যে কেবল ভারতের স্বার্থে তা নয় — চাই বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য নাত্সীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং একজাতির উপর অন্যজাতির আক্রমণের অবসানের জন্য।”
এরপর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই জুলাই মানে হিরোশিমা-নাগাসাকি আর পার্লহারবার ঘটনার ঠিক কিছুদিন আগেই মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা অধিবেশনে ‘কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি’ গান্ধিজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তাব অনুমোদন করে । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৮ ই আগস্ট কংগ্রেসের কার্য-নির্বাহক সমিতি গান্ধিজির ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাবের আইনগত স্বীকৃতি জানায় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে ৯ ই আগস্ট ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে খুব ভোরেই আন্দোলন শুরু হবে। এই প্রস্তাবে বলা হয় ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিরা একটি সামরিক সরকার গঠন করবেন এবং সকলের গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান রচনা করবেন। প্রস্তাব অনুমোদনের পর গান্ধিজি দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’। অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করব, না হয় মৃত্যুবরণ করব । গান্ধিজির এই উদাত্ত আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল ‘করেঙ্গা ইয়ে মরেঙ্গে’ ।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল মহারাষ্ট্রের সাতারা, মেদিনীপুরের তমলুক, কাঁথি, দিনাজপুরের বালুরঘাট, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, আসামের নওগাঁ, ওড়িশার তালচের, বালাশোর ইত্যাদি। বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে সাতারার শ্রীনাথ লালা, নানা পাতিল, বালিয়ার চৈতু পান্ডে, সরযূ পান্ডে, তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা, সুশীল ধাড়া, পাঞ্জাবের গৃহবধু ভোগেশ্বরী ফকোননি, আসামের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া অন্যতম । এছাড়া অরুণা আসিফ আলি, সুচেতা কৃপালিনী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্রদেব, রামমনোহর লোহিয়া, যোগেশ চ্যাটার্জি, উষা মেহেতা, অচ্যুত পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
বাংলার মেদিনীপুর জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন এক গণবিদ্রোহের রূপ নেয়। তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এর গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল বেশি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতঙ্গিনী হাজরার অবদান বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন গান্ধিজির অনুরাগী একজন গ্রাম্য বিধবা মহিলা। মহাত্মা গান্ধি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে মাতঙ্গিনী হাজরা এই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন।


প্রথম প্রথম এই আন্দোলন ছাত্র-শিক্ষক, যুবসম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমে তা দেশের শ্রমিক, কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। সরকারি দমন নীতির প্রতিবাদে দেশের আপামর জনসাধারণ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। দেশব্যাপী ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। এ সবের প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ পরিগ্রহ করে। রেললাইন ধ্বংস, স্কুল-কলেজ বর্জন, বিভিন্ন অফিস-আদালতে অগ্নি-সংযোগ, ট্রেন ও টেলিফোন সংযোগ বিছিন্নকরণ থানা, ডাকঘর, রেজিস্ট্রি অফিস, রেলস্টেশন দখল ইত্যাদি কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়।
মেদিনীপুরে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৯ শে সেপ্টেম্বর নানাদিক থেকে এসে তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন । ৭৩ বছর বয়স্কা কৃষকবধু মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালত শীর্ষে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান। মাতঙ্গিনী হাজরার দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শ জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে।
অজয় মুখার্জি, সুশীল কুমার ধাড়া ও সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে লালবাড়ির দখল নেওয়া হয় ও অজয় মুখার্জির উদ্যোগে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৭ ডিসেম্বর তমলুক মহকুমায় ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ গঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকারি দমন নীতির প্রচন্ডতা ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। তবুও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ব্রিটিশের ভিত্তি নাড়িয়ে দেওয়ার একটি বৃহত্তর প্রয়াস ছিল। অন্য দিকে কেউ কেউ মনে করেন এই আন্দোলন কোথাও একটা সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজ কে রুখে দেওয়ারও সুচারু কৌশল ছিল। জাপান কে আটকে দেওয়ার অর্থ সুভাষ চন্দ্র বসুকেও আটকে দেওয়া। তবুও আমাদের রাজ্যের মেদিনীপুর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের যে পথিকৃত ছিল তা বলাই বাহুল্য তাই ৯’ই আগস্ট মানে ‘মেদিনীপুরের গর্জে ওঠার দিন’।