স্বাধীনতার তিরিশ বছরের মাথায় কেন্দ্রে প্রথম কংগ্রেসের একচ্ছত্র শাসনের বিরতি ঘোষণা করেছিল ভারতের গরিবগুর্বোরা। একেবারে নিশ্চিত ম্যানডেট। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং দল ও সরকারের দ্বিতীয় সর্বেসর্বা সঞ্জয় গান্ধীসহ কংগ্রেস একেবারে মুছে গিয়েছিল বিন্ধ্য পর্বতের এপারে। হিন্দি বলয়ে মাত্র একজন এমপি জিতেছিলেন লোকসভায়। আর সব দক্ষিণ ভারত থেকে। জরুরি অবস্থার নিগ্রহের জবাবে জয়প্রকাশের ডাকে ব্যালট বিপ্লব হয়েছিল ১৯৭৭ এর ১৬ মার্চ। সক্রিয় উত্তর দিয়েছিল উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম। আর উত্তরে মৌন ছিল দক্ষিণ ভারত। ভারতের মানচিত্রের মাঝামাঝি ফুটে উঠেছিল এক ক্রান্তিরেখা।


প্রধানমন্ত্রী মোরারজিভাই দেশাই শপথের পর উচ্চারণ করেছিলেন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মূল সুর। বলেছিলেন ভয়মুক্ত ভারত উপহার দেব আমরা, অর্থাৎ জনতা পার্টির সরকার। কারণ, কংগ্রেস জরুরি অবস্থার মাধ্যমে সারাদেশে যে ভয় আর স্বৈরাচার কায়েম করেছিল, জনতা তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে। গান্ধীর জন্মভূমি গুজরাতের আরেক সুসন্তান মোরারজিভাই তাঁর কার্যত কোয়ালিশন কাঠামোর দল জনতার অভ্যন্তরীণ চোরাস্রোতের টানে তিন বছরের বেশি সরকার চালাতেই পারেননি। কিন্তু ওই তিন বছরে নেহরু জমানার চেয়েও স্বচ্ছ শাসন দিয়েছিলেন। সারাদেশকে জেলখানা বানানোর বিপরীতমুখী সক্রিয়তায় ভয়মুক্তির স্বাদ দিয়েছিলেন অনেকটাই। কিন্তু জনতা পার্টিতে মিশে যাওয়া পূর্বতন জনসংঘের নেতারা শাসক দল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন আর এস এসের সদস্যপদ ছাড়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। জনতা পার্টিতে সামিল সমাজবাদী নেতারা আওয়াজ তুলেছিলেন দলের পাশাপাশি আরএসএসের সদস্যপদ অর্থাৎ যৌথ সদস্যপদ রাখা চলবেনা। যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে। সবাই এই দাবি সমর্থন করলেন। তখন বাজপেয়ী, আডবাণী, নানাজীরা জনতা পার্টি ও সরকার ছেড়ে বেরিয়ে এসে ভারতীয় জনতা পার্টি গড়লেন। এই দলে জনতা পার্টির নাম থেকে শুরু করে কাম অর্থাৎ অ্যাজেন্ডারও অনেকটা গ্রহণ করলেন । আগের দলের সীমাবদ্ধতা দূর করতে দলের আইকনদের মধ্যেও এমন অনেক দেশনায়কের নাম ঢোকানো হল, যাদের সেকুলার আইডেন্টিটি অবিকৃত। সেই নতুন দলের প্রথম সভাপতি বাজপেয়ী মোরারজিভাইয়ের ভয়মুক্তির কথা মাথায় রেখেই ঘোষণা করলেন, আমরা ভয়-ভুখ-ভ্রষ্টাচারমুক্ত ভারত গড়ব। এরপর যখন তেরদিন, তেরমাস ও প্রায় পাঁচ বছরের সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন অটলবিহারী বাজপেয়ী, তখনও ভয়মুক্ত ভারত গড়ার কথা বলতে ভোলেননি।
রাম মন্দিরের দ্বিতীয় শিলান্যাসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে, অটলজির দলে তাঁর উত্তরসূরি নরেন্দ্রভাই বললেন, “ভয় বিনু প্রীত না হোই ।” কথাটা তাঁর নয়, তুলসীদাসের। কিন্তু অভিজিৎ মুহূর্তে নব্য স্বাধীনতার আধারশিলা রাখার পর মোদির এই মন্ত্রটি ভারতের ইতিহাসে ক্রিস্টাল হয়ে গেল।
যিনিই প্রধানমন্ত্রী হন, রাষ্ট্র জীবনের সর্বশক্তিমান হিসেবে তাঁর চাণক্য হওয়ার সুযোগ থাকে। তাছাড়া বুদ্ধিমত্তা, বিবেচনা এবং বিচক্ষণতায় তিনি অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে থাকেন অনেক কদম। বলা বাহুল্য এইসব গুণের ক্ষেত্রে নরেন্দ্রভাই প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি তাঁর দল ও পরিবারে নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রশ্নাতীত ভাবে তাঁর জনপ্রিয়তা ও সঙ্ঘপ্রিয়তা আডবাণীর চেয়ে বহুগুণ বেশি। অটলজিকে গুরুজি বলতেন চাণক্য হিসেবে ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বজনগ্রাহ্য প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও। কিন্তু নরেন্দ্রভাই ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর একটানা কার্যকালের নিরিখে প্রথম স্বয়ংসেবক প্রধানমন্ত্রীকে অতিক্রম করেছেন বটেই, সেইসঙ্গে হিন্দুত্বের কোর অ্যাজেন্ডা রূপায়ণে মোদির সাফল্যের গ্রাফের ধারেকাছেও নেই বাজপেয়ী। তাছাড়া অটলজি যেভাবে কোর অ্যাজেন্ডা স্থগিত রেখে এবং শরিক নির্ভর সরকার চালিয়েও সঙ্ঘের বহু বিতর্কিত কর্মসূচিতে হাত দিতেন, সফল হবেন না জেনেও চেষ্টা করতেন, নরেন্দ্রভাই কদাচ তা করেন না। যেমন বিচারপতি বেঙ্কটচেলাইয়ার নেতৃত্বে সংবিধানের আমূল সংস্কারের জন্য কমিশন গড়া। সে উদ্দেশ্য অপূর্ণই থেকেছে। কিন্তু অটলজি শুধু একদিকে সংঘ আর অন্যদিকে জনগণকে বার্তা দিয়েছেন, সংঘসেবক প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এই উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন। ইতিহাসের পাতাতেও তো একথা লেখা থাকবে। বিচারধারার প্রতি নিজস্ব দায়বদ্ধতার দলিল হবে সেটাই। তাছাড়া তাঁর ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল ঘাড়ের কাছে বন্ধু ও সতীর্থ আডবাণীজির নিঃশ্বাস। উদারচেতা অটলকে চাপে রাখতে সংঘের মহাস্ত্র ছিলেন লালকৃষ্ণ। আর চাণক্যনীতির
জ্ঞাতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর তীক্ষ্ণ তিরের ঢাল ছিলেন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর মুখ্য সলাহকার ও ফরেন সার্ভিসের দুঁদে কূটনীতিক ব্রজেশ মিশ্র। তাঁর গুরুত্ব এতটাই ছিল পিএমওতে যে ব্রজেশ উপস্থিত না থাকলে পাক প্রেসিডেন্ট মোশারফের সঙ্গেও কথা বলতে চাননি বাজপেয়ী এমন ঘটনাও ঘটেছে। এবং তা নিয়ে লুকোছাপাও করেন নি দিলদরিয়া মানুষটি। নিজস্ব সরস স্টাইলে মোশারফকে বলে দিয়েছেন, আপনার এই প্যাঁচের জবাব ব্রজেশ ছাড়া আর কেউ দেবেনা। সুতরাং এবিষয়ে পরে কথা হবে। মোদিজি এবং তাঁর অজিত ডোভালের ভিন্ন ঘরানার কূটনৈতিক শৈলী। প্রথম কথা, নিশ্চিত সাফল্যের অঙ্ক ছাড়া কোনও ইস্যু হাতে নেন না। এক্ষেত্রে বিধি তাঁর বাম নয়। সর্বক্ষেত্রেই সহায়ক। তিন দশক পর দিল্লির মসনদ কোনও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ সরকার দেখেছে। দ্বিতীয় দফায় তিনশো পেরিয়ে থ্রি নট থ্রিও পঁয়ত্রিশ বছরের রেকর্ড। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর পায়ের নীচের মাটি মজবুত। যদিও বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার মত নবরত্নসভা তাঁর নেই। বিজেপির একের পর এক প্রবীণ, নবীন স্টলওয়ার্ট তো বটেই, সেইসঙ্গে সেকুলার সপ্তর্ষিমণ্ডলও সমাবিষ্ট।জর্জ,নীতীশ,শরদ,ফারুক,মমতা এবং নবীন, চন্দ্রবাবু, জয়ললিতা, করুণানিধি,ভাইকো এমনকি পিএমকের মন্ত্রীরা। এখন মোদিজির সঙ্গীদের মধ্যে জনজীবনে উচ্চপদে স্বনামখ্যাত বলতে শুধু রাজনাথ। তবু কোর অ্যাজেন্ডা রূপায়ণে মোদির সাফল্যের ডঙ্কা বাজছে সারা দেশে। কখনও বা বিদেশে। এমনকি এই ঘোর অমানিশায় দীপাবলি করে কিংবা তালি আর থালি বাজিয়ে বাজিয়ে করোনানিধন পর্ব রমরমিয়ে চলছে। বিরোধীরা নানা ধরনের ফুট কেটেছেন। কিন্তু কেউ বলতে পারেন নি, এটা কি করোনা না বিরোধী বিতাড়ন মন্ত্র ?
আসলে মেরুকরণের পর্ব। যা বিজেপির তো সর্বত্র, এবং আঞ্চলিকদেরও কারও কারও বিপদতাড়িনীর কবচ হয়ে উঠেছে। সেটাই সম্যক উপলব্ধি করে স্থির ভাবলেশহীন নিয়তির মত সরকারের নেতা এগিয়ে চলেছেন লক্ষ্যের দিকে। বিবিধের মাঝে মহামিলনের এই ভারততীর্থ, পৃথিবীতে একমাত্র যে দেশের নামে মহাসাগরের নাম। কোন রাজনৈতিক বা জাতীয়তাবাদের অ্যাজেন্ডায় লেখা ছিল এই ভারত মহাসাগরের নামকরণ ? নাকি এটা আগে ছিল রামসাগর ? কে লিখেছিলেন, ” হেথায় দাঁড়ায়ে দুবাহু বাড়ায়ে নমি নব দেবতারে / উদারছন্দে পরমানন্দে বন্দনা করি তারে ,,,,,” ? জাতীয়তাবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কী লিখেছেন ভারততীর্থের এই ঋষি এবং বঙ্গের এই ব্রহ্মা ? যাঁর টুপি পড়ে লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে অতীতের কুকীর্তিকে ধিক্কার দিয়েছিলেন আমাদের সব ধর্ম , সব জাত, সব দল, সব ভারতবাসীর প্রধানমন্ত্রী, ওঁর সঠিক কথামতোই ভারতের সেই প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ধর্ম ও রাজনীতি মেলানো সম্পর্কে
ঐতিহাসিক উক্তি আর কেউ না জানলেও সংঘসেবকরা সবচেয়ে ভাল করে জানেন। ভারতের জাতীয় জীবনের আদর্শ মহাপুরুষ হিসেবে ওঁরা যাঁদের নাম অহরহ উচ্চারণ করেন, সেই সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ও ঋষি অরবিন্দ এমনকি বন্দে মাতরমের স্রষ্টা বঙ্কিমের বক্তব্য কি রামমন্দিরের আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে দিতে বলে ? পাঁচশো বছরের ইতিহাস নিয়ে তাঁদের কোনও উল্লেখ কি সেকথা বলে ? স্বদেশী, বিদেশী পরিব্রাজকদের ইতিহাসেও তো একথার সমর্থন আছে ?
সর্বোপরি, রুমালটা রাতারাতি বেড়াল হয়ে গেল। কেন ? আমরা জানি। এবং কর্তারা আরও হাড়ে হাড়ে জানেন। আন্দোলনটার হোতা একটা সংগঠন। তাদের কর্মসূচিকে সমর্থন করে বাবরি মসজিদ ( যাকে কর্তারা মসজিদ না বলে ধাঁচা বলতেন। এমন কি অটলজিও )কে “জাতীয় লজ্জা”র প্রতীক হিসেবে গণ্য করে আডবাণীর নেতৃত্বে বিজেপি, পালামপুর প্রস্তাবে। এবং সেই জাতীয় লজ্জার প্রতীককে মুছে ফেলে ঐখানেই রামমন্দির নির্মাণের দাবিতে আন্দোলনের প্রতি দলের সমর্থন ঘোষণা করে। সুতরাং তাদের দলীয় বিচারধারা অনুযায়ী তারা “বিদেশি” শাসনের প্রতীক চিহ্ন মুছে রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণকে স্বাধীনতার প্রতীক বা আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন বলুক। এটা একটা দল ও তার সদস্যদের স্বাধিকার। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্রভাই মোদি যখন গান্ধীর স্বাধীনতা আন্দোলনকে রামমন্দির আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে দিলেন তাতে তো ভারত সরকারের সিলমোহর পড়ল। এবং গান্ধী রাষ্ট্রপিতা হলেও তো বাপ মা ছাড়া নন। তাঁর একটা দল আছে, তাঁর বিপুল অনুগামী আছেন। তাদের মতামত জানানোর কোনও সুযোগ দেওয়া হলনা। অর্থাৎ ভবিষ্যতের জন্য একটি নজির রাখা হল। এবার অন্য কোনও দলের সরকার এসে যেকোনও বিরোধী মতাদর্শের দলের নেতা বা রাষ্ট্রনায়ককে তাদের রাজনীতির রঙে রাঙিয়ে দিতে পারেন। এবং সেই নেতার দলমতের কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই এটা ঘটতে পারে। অথচ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ভারত সরকারের সরকারি সিদ্ধান্তগুলো কিন্তু অনন্ত কালের জন্য সরকারের প্রকাশ্য ও গোপনীয় দলিল হয়ে আছে। সেই অবস্থান বদলাতে হলে নিদেনপক্ষে সংসদে বিতর্ক ও বিল পাস করাতে হয়। কারণ সুপ্রিম কোর্টের শেষ রায়েও তো বাবরি মসজিদকে জাতীয় লজ্জা বা আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় সংসদ ও বিচারবিভাগের অবস্থানের বিপরীতে গিয়েও কোনও দল রাজনৈতিক শ্লোগান দিতে পারে কিনা সেটাও বিবেচনাসাপেক্ষ। তাছাড়া, আন্দোলনকারী সংগঠনের বা রামজন্মভূমি ন্যাসের পক্ষে কেউ ভূমিপুজোয় বসবেন, তাঁর নামেই সংকল্প হবে ,এমনটাই ভাবা স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের চমক অন্য দৃশ্য উপহার দিল। পুরোহিত বললেন, আমার যজমান স্বয়ং মহানুভব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি সংকল্প করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজি আচমন করুন, নিজের গোত্র বলুন। মুখোশ খুলে মুখে সরযূ বা গঙ্গার জল নেননি মহামান্য মোদি। করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।


এই দায় ও দায়িত্ব পালনে অর্জুনের মত শুধু পাখির চোখ নিশানা করে প্রতিটি পা ফেলেছেন। কোথাও অঙ্কে কোনও ভুল নেই। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে সংঘ পরিবারের মধ্যে একমাত্র সরসংঘচালক উপস্থিত। যেখানে সংঘের মাথা আর সংঘের সরকারের মাথা আছেন সেখানে আর তৃতীয় ব্যক্তি নিষ্প্রয়োজন। আগে বাজপেয়ীর মত উদার ভাবমূর্তির বর্ণময় নেতা ছিলেন বলে সংঘের ক্লাচ আডবাণীর দরকার ছিল। তাই গালভরা যৌথ নেতৃত্বের অবতারণা। কংগ্রেসেও তাই। গান্ধী পরিবারের সবাই এমনকি রাওও সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দুটি পাওয়ার সেন্টার গড়তে কংগ্রেসের আপত্তি কাগজে কলমে। বিজেপির কাঠামো আলাদা। বাহ্যত গণতান্ত্রিক। কিন্তু অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মন্ত্রিসভাও হয়না। আর হবেনাই বা কেন ? ১৯৮০,১৯৮৪ তে সংঘ ইন্দিরা ও কংগ্রেসের পাশে থাকায় গোহারা হারে বিজেপি। ভোটে জেতার সাংগঠনিক পরিকাঠামো পুরোটা সংঘের। নেতার ক্যারিশমা শুধু কসমেটিক্স। মোদির ক্ষেত্রে সেই পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। কারণ মোদি আডবাণীর মতোই সংঘের আত্মা। সংঘকে কিছু বলার দরকার করেনা। মোদি এতটাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি অর্থনীতির ছক বেঁধে নিজের তৈরি পরিচালন কাঠামো নিয়ে চলেন। উল্লেখযোগ্য, আডবাণী, যোশী, কল্যাণের ব্রাত্য হওয়ার কারণ সবার জানা। কিন্তু করোনাক্রান্ত না হলেও কি অমিত যেতেন। সরকারের খাতায় কলমে নাম্বার টু তো রাজনাথ। এবং তিনিই সব দিক থেকে উত্তরপ্রদেশের হিন্দু নেতা ছিলেন এতাবৎ। কিন্তু এক আকাশে দুই সূর্য থাকেনা। তাই একই জাতিগত বেস থেকে উঠে এসেছেন যোগী। ওঁর গেরুয়া বসনের মূল্য রাজনাথের চারগুণ। আর যেখানে রাজনাথ বা নাগপুরের গডকড়ির মতো সংঘের সন্তান বাদ, সেখানে অনুজ নাড্ডা কী করে যান ? রাম মাধবও তো ডাক পাননি। একেবারে নির্ভুল উদ্দেশ্যপ্রবণ নির্মেদ আয়োজন। শুধু বাহাদুর বলতে হবে হিন্দু পরিষদকে। বিজেপি আডবাণীকে বুড়ো আঙুল দেখালেও পরিষদ অকৃতজ্ঞ নয়। অশোক সিংহলকে সম্মান দিতে তাঁরা তাঁর বংশধর সলিল সিংহলকে সম্মান দিয়েছেন। আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মঞ্চে। এটাই হিন্দু ও ভারতীয় সংস্কৃতি। আর প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে কদাচ হস্তক্ষেপ করেন না সংঘচালক। তথাপি কোথাও একটা খটকা লেগেছে তাঁর। সংঘের সুদিনে দুর্দিনে কত পরামর্শ দিয়েছেন, মার্গ দর্শন করেছেন আডবাণীজি। মনে পরে উপপ্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কত সময় সংঘের তরফ থেকে যাঁরা তাঁর বাড়িতে ছুটে যেতেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ভাগবত। দেওরস, রজ্জু ভাইয়া, সুদর্শনের আমলে আডবাণীর পরিমণ্ডলে প্রথম ছিলেন তিনি। এছাড়া, গোবিন্দাচার্য, সুধীন্দ্র কুলকার্নি এবং প্রবীণদের মধ্যে কিষেণলাল শর্মা, জগদীশ প্রসাদ মাথুর। তাছাড়া, সুষমা, বেঙ্কাইয়া, জেটলি। সুতরাং অতীত দিনের স্মৃতি কেউ ভোলেনা কেউ ভোলে। কিন্তু রাজনীতিতে রুথলেস হতেই হয়। সেখানে মায়া মমতা করুণার কোনও কদর নেই। সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। এই তত্ত্বও তো শিখিয়েছেন মাননীয় আডবাণীজি। তবু, উল্লেখ করলেন ভাগবত। অনেকেই অনুপস্থিত। প্রয়াত রামচন্দ্র পরমহংস এবং অশোক সিংহলের কথায় বললেন, ওঁরা সূক্ষ্মদেহে আছেন এবার স্থূলদেহীদের প্রসঙ্গ। শুধুমাত্র আডবাণীর কথা বললেন ভাগবত। খুব সতর্ক উচ্চারণ। আডবাণীজি নিশ্চয়ই টিভিতে দেখছেন। যোগী বললেন, এরকম নেতাদের একে একে নিয়ে আসা হবে একেকদিন। কিন্তু আডবাণীকে বিশেষ আসন দিলেন না। একইভাবে গণহারে সবাইকে অভিনন্দন জানালেন মোদি, যাঁরা আন্দোলনে ছিলেন। এরপর মোদির ভূমিপুজোয় সংকল্প। কিন্তু রূপোর ইট পুজো হল। মনে প্রশ্ন জাগে, আশির শেষদিকে, সম্ভবত ‘৮৭তে অযোধ্যার শিলান্যাসে পাশে ছিল কংগ্রেসের রাজীব সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিংকে পাঠান রাজীব শিলান্যাস দেখতে। তাহলে আবার শিলাপুজো কিসের ?


মনে পড়ছে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালীঘাট মন্দিরে রাজ্যের কল্যাণের জন্য পুজো দিতে যান। তাঁকে পুরুতঠাকুর গোত্র জিজ্ঞেস করলে মুখ্যমন্ত্রী শাণ্ডিল্য গোত্র কিন্তু বলেন নি। বলেন, মা মাটি মানুষ গোত্র। এই কথাটি নাটকীয়ভাবে পরিবেশন করা হয়েছে মনে হলেও একটা সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার ছাপ স্পষ্ট। এবং সবচাইতে বড় কথা বাংলা মতে মুখ্যমন্ত্রীর এটাই সঠিক গোত্র। অন্তরের খবর অন্তর্যামী জানেন। জনজীবনে উচ্চারণটাই মন্ত্র। কারণ, বাংলা তাদের প্রতিনিধিকে জনগণমন অধিনায়ক হিসেবেই দেখতে চায়। ঘর পোড়া গরু বামুন-টিকি আর মোল্লা-দাড়ি দেখলে ভয় পায়। অবশ্য আমাদের মোদিজির ধর্মকর্ম দারুণভাবে ক্লিক করেছে। তিনি রামনাম সত্য করেছেন। সব পাড়া কমিটির পার্টি থেকে হিল্লি দিল্লি সবাইকে খিল্লি করেছেন। রাহুল অন্য কিছু বলার চেষ্টা করলেও প্রিয়ঙ্কা রামরাম করে নেমে পড়েছেন। দেশ রামময়, করোনামৃত পান করে বলতে বলতেই রাম নাম সত্যর সংখ্যা আকাশ ছুঁতে চাইছে। খবর লেখা হচ্ছে, ব্রাজিলের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশংকা। রামময় দেশের এনডিএ শরিকরা আমন্ত্রিত না হয়েও রামরাম করছেন। নীতীশের সামনে ভোটের খাঁড়া। রামধাক্কা থেকে বাঁচতে হবে। শরিক ছাড়াও কি বন্ধু কম ? পরম পরিবারতন্ত্র বিরোধী নবীন পট্টবস্ত্র পড়ব পড়ব করছেন। মধ্যপ্রদেশে রামকেলো। কংগ্রেস ভবনের মূল সাইনবোর্ডে রাম। কমলচিহ্নের সরকারের মুখ্যমন্ত্রী করোনা থেকে সুস্থ। আর সাক্ষাৎ কমল কিনা কংগ্রেসের মুখ ! ওই মুখই মোক্ষম দাওয়াই দেওয়ার তৃণমূলী তরিকা নিয়েছেন। কমলনাথের বাড়িতে অষ্টপ্রহর হনুমান চালিশা পাঠ, যাগযজ্ঞ চলছে।তবু কেউ বলেনি, কমল কা কামাল।


তৃণমূলের নেতা না করলেও কোনে কোনে সে আয়ে হুয়ে কোটি কোটি ভাইওঁ ঔর বহনোঁ,,,,,? বাঁকুড়া থেকে বিরাটি , গোকর্ণ থেকে গোসাবা হৈহৈ করে হনুমান সেজেছিল যারা রামনবমীতে দিলুবাবুকে দেখিয়ে দিতে তার এখন রামরাম করছে। বাম থেকে রামে গিয়েছে যারা তারা ঘাস থেকে পদ্ম হওয়াদের কাছে ছদ্মবেশ নিচ্ছে অজ্ঞাতবাসের দায়ে। কিন্তু সে ভয়ে কম্পিত নয় দেবের হৃদয়। ঘাটালে গিয়ে রামমন্দিরের জায়গায় করোনার গুরুত্ব বেশি বলেও যেভাবে উচ্ছ্বসিত মোদির প্রশংসায়, তাতে মনে হয়, বাংলার মাটি আর দুর্জয় নয়। নন্দীগ্রামে তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত নেতা তো বলেই দিলেন, দল পরে, আগে ধর্ম। একথা ডেকে হেঁকে বাংলায় এতোদিন কেউ বলেনি।মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী তারাপীঠে পুজো দিয়ে জয় তারা জয় তারা বললেও জ্যোতি বাবু বলেছেন, ওর মৃত্যুভয় হয়েছে । সে তো নাহয় কম্যুনিস্টি।কিন্তু কংগ্রেসিরা ধর্ম করলেও কেউ দলের আগে ধর্ম বলেননি। আর প্রিয়ঙ্কার ইউএসপিকে টপকে গিয়েছে জুনিয়র অধিকারীর রাম রাজনীতি। বিজেপি উদ্বাহু না উদ্বিগ্ন দিলুবাবুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি।