দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। সারা বাংলা বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললো। এ সময়েই কলকাতার যুগান্তরে মেদিনীপুর থেকে একটি বিপ্লবীদের দল কর্মী হিসেবে যোগ দিতে আসেন। আর সেই দলের কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু।
শৈশব থেকেই দুরন্ত ও বেপরোয়া প্রকৃতির ক্ষুদিরাম বিপ্লবী চেতনার ছোঁয়া পেয়ে এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠলেন। তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় হেমচন্দ্র কানুনগোর সাথে ক্ষুদিরামের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনায়।
ক্ষুদিরামের বয়স তখন তের-চৌদ্দ। একদিন হেমচন্দ্র কানুনগো মেদিনীপুরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন।তার মোটর গাড়ি আটকালেন ক্ষুদিরাম। হেমচন্দ্র কে বললেন “আমাকে একটা রিভলবার দিতে হবে।”
অচেনা অজানা একটা বাচ্ছার এই ধরনের আবদার শুনে স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত হলেন হেমচন্দ্র। জিজ্ঞেস করলেন, “তুই রিভলবার দিয়ে কী করবি?” জবাবে শুনলেন, “সাহেব মারবো।” হেমচন্দ্র সেদিন তাকে ধমক দিলেও বাচ্চা ছেলের বুকে মুক্তির আগুন দেখে অভিভূত হয়েছিলেন।
ক্ষুদিরাম প্রথম আলোচনার আলোয় আসে ব্রিটিশ বিরোধী ‘সোনার বাংলা’ লিফলেট বিলি করতে গিয়ে। ১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মেদিনীপুরে এক কৃষি-শিল্প প্রদর্শনীর প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে সবার কাছে লিফলেট বিলি করতে শুরু করেন ক্ষুদিরাম। এক সময় এক পুলিশ কনস্টেবলের হাতে ধরাও পড়ে যান কিন্তু শোনা যায়, বক্সিং এর কেরামতিতে সেদিন কনস্টেবলের নাক ভেঙে দিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। কিন্তু তাও ধরা পড়ে যান।


বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ তখন কালেক্টরিতে এক ডেপুটির অফিসে কাজ করতেন। তিনি সেই প্রদর্শনীর সহকারি সম্পাদকও ছিলেন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়লে পুলিশের কাছ থেকে তিনি তাকে কৌশলে ছাড়িয়ে নেন। কিন্টু পুলিশ পড়ে এটি ধরতে পারে। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সত্যেন চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। আর ক্ষুদিরামের নামে ঠুকে দেওয়া হয় ‘রাজদ্রোহী মামলা’। সম্ভবত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে এটিই সর্বপ্রথম রাজদ্রোহী মামলা ছিল।
কিছুদিন ফেরারী থাকার পর সিদ্ধান্ত হয় ক্ষুদিরাম পুলিশের কাছে ধরা দেবেন। কিন্তু বিপ্লবীদের ভয় ছিল, হয়তো পুলিশের নির্যাতনের মুখে ক্ষুদিরাম তাদের কর্মকাণ্ডের কথা ফাঁস করে দেবেন। কিন্তু তাকে সব অত্যাচার নির্যাতনের গল্প অনেক অতিরঞ্জিত করে শুনিয়ে ভয় দেখানোর পরও, ক্ষুদিরাম নির্বিকার ভাবে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হন। এতে বিপ্লবীরা নিশ্চিন্ত হন; তারা বুঝতে পারলেন যত যা-ই হোক, ক্ষুদিরাম কিছু ফাঁস করবে না। বাস্তবেও তা-ই হলো, পুলিশ অনেক চেষ্টার পরেও সেই ষোল বছরের কিশোরটির মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারেনি।
ক্ষুদিরামের শৈশব সহজ ছিল না। ১৮৮৯ সালের ৩’রা ডিসেম্বর, মেদিনীপুরে জন্মেছিলেন তিনি। ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছেন, বড় হয়েছেন আত্মীয়ের বাড়িতে। জানা যায়, পিতার রেখে যাওয়া দেনা শোধ ও বোনদের বিয়ে দেওয়ার খরচে যোগাতে গিয়ে হারাতে হয়েছিল সম্পত্তিটুকুও। ছোটবেলা থেকেই সমাজ কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছিলেন বলেই হয়তো নির্যাতিতের প্রতি এতটা দরদ অনুভব করতে পারতেন তিনি।
এর পরের ঘটনা আমাদের প্রায় সকলেরই জানা। ৩০শে এপ্রিল ১৯০৮, সন্ধ্যা ৮টা অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে দুই ইংরেজ নারীকে মেরে ফেলেন ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী।
তাঁরা দুজনেই একনিষ্ঠতা ও ত্যাগের সাথে কাজ করলেও কিছু ভুল ছিল। দলের তরফ থেকে তাদের ওপর নির্দেশ ছিল যে, তারা যেন মিশনের সময় অন্য কোনো প্রদেশের লোকের অনুকরণে পোশাক পরিধান করে, এরপর মিশন শেষে আবার বাঙালি পোশাক পরে। কিন্তু তারা দুজন তা করেননি।
ভুল ছিল আরো একটি। রিভলবার জিনিটির প্রতি ক্ষুদিরামের দুর্বলতা ছিল আগে থেকেই। অপব্যবহারের ভয়ে এর আগে এটি তার হাতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এ মিশনে তার এবং প্রফুল্ল দুজনের কাছেই একটি করে রিভলভার দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ক্ষুদিরাম লুকিয়ে নিজে আরেকটি রিভলবার নিয়েছিলেন অস্ত্রাগার থেকে। বোমা বিস্ফোরণ হওয়ার পর রিভলবার ফেলে দেওয়ার জন্য তাদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রিভলবারের প্রতি আকর্ষণের কারণেই সম্ভবত ক্ষুদিরাম সেটি করতে পারেননি। পরদিন তাকে যখন ধরা হয়, তখন তিনি দু’হাতে খাবার খাচ্ছেন আর পাতলা জামার দুই পকেটে ঝুলছে দুইটি রিভলবার। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর।
কোর্টে উকিলদের অনেক জোরাজুরিতে ক্ষুদিরাম আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দি বদলে নতুন জবানবন্দি দেন। যেহেতু প্রফুল্ল মারা গেছেন, তাই উকিলরা চেষ্টা করেছিলেন যদি প্রফুল্লর উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে ক্ষুদিরামের দণ্ড লঘু করা যায়!
কিন্তু তাতেও কিছু লাভ হয়নি। বিপ্লবের প্রশ্নে ব্রিটিশরা কোনো রকমের ছাড় দেয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। ক্ষুদিরামকে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়। এরপর ১৯০৮ সালের ১১’ই আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
সেদিন জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। দু দিকে ছিল দুটি খুঁটি। তার উপর একটি মোটা লোহার রড আড়াআড়িভাবে লাগানো ছিল। সেই রডের মাঝখানে মোটা একগাছি দড়ি বাঁধা ছিল। তার শেষ প্রান্তে ছিল মরণ-ফাঁস।
ক্ষুদিরামকে সেই মঞ্চে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চার পুলিশ। ক্ষুদিরাম ছিলেন তাঁদের সামনে। ফাঁসির আগে উপস্থিত আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর পিছমোড়া করে বাঁধা হয় দুইহাত। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্র জল্লাদকে ক্ষুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন ‘ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?’