দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: গত মঙ্গলবার অর্থাত্ ২৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সন্ত্রাসবাদী হামলায় চার্জশিট দাখিল করল এনআইএ। মোট ১৯ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ১৩,৮০০ পাতার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী, সিআরপিএফের কনভয়ে অতর্কিতে হামলা চালিয়েছিল জইশ জঙ্গিরা। সেই ঘটনার তদন্ত করছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা, এনআইএ। ওই সন্ত্রাসবাদী হামলার জেরে সিআরপিএফের ৪০ জন জওয়ান শহিদ হন। জখম হন আরও আট সিআরপিএফ। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, যখন সিআরপিএফের ওই কনভয়টি জম্মু থেকে শ্রীনগরে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় পুলওয়ামার লেথপুরায় আত্মঘাতী হামলা চালায় আদিল আহমেদ ডর। প্রাথমিক তদন্তে আদিল এর সাথে জইশ-ই-মহম্মদ নামক জঙ্গি সংগঠনের সাথে যোগাযোগের প্রমাণ মেলে।
এনআইএ চার্জশিটে থাকা ১৯ জন জঙ্গির নাম-
১. মাসুদ আজহার (৫২), পাকিস্তানি নাগরিক (ফেরার)
২. রউফ আসগর (৪৭), পাকিস্তানি নাগরিক (ফেরার)
৩. অমর আলভি (৪৬), পাকিস্তানি নাগরিক (ফেরার)
৪. শাকির বশির (২৪), পুলওয়ামার কাকাপোরায় বাড়ি (গ্রেফতার)
৫. ইনশা জান (২২), পুলওয়ামার কাকাপোরায় বাড়ি (গ্রেফতার)
৬. পির তারিক আহমেদ শাহ (৫৩),পুলওয়ামার কাকাপোরায় বাড়ি (গ্রেফতার)
৭.ওয়াইজ-উল-ইসলাম (২০), শ্রীনগরে বাড়ি (গ্রেফতার)
৮. মহম্মদ আব্বাস রাঠোর (৩১), পুলওয়ামার কাকাপোরায় বাড়ি (গ্রেফতার)
৯. বিলাল আহমেদ কুচ্চে (২৮), পুলওয়ামার লালহরের হাজিবলে বাড়ি (গ্রেফতার)
১০. মহম্মদ ইকবাল রাঠোর (২৫), বুদগমে বাড়ি (গ্রেফতার)
১১. মহম্মদ ইসমাইল (২৫), পাকিস্তানি নাগরিক (ফেরার)
১২. সমীর আহমেদ ডর (২২), পুলওয়ামার কাকাপোরায় বাড়ি (ফেরার)
১৩. আশাক আহমেদ নেঙ্গরু (৩৩), পুলওয়ামার রাজপুরায় বাড়ি (ফেরার)
১৪. আদিল আহমেদ ডর (২১), পুলওয়ামার কাকাপোরায় বাড়ি (নিহত)
১৫. মহম্মদ উমর ফারুক (২৪), পাকিস্তানি নাগরিক (নিহত)
১৬. মহম্মদ কামরান আলি (২৫), পাকিস্তানি নাগরিক (নিহত)
১৭. সাজ্জাদ আহমেদ ভাট (১৯), অনন্তনাগের বিজবেহরায় বাড়ি (নিহত)
১৮. মুদাসির আহমেদ খান (২৪), পুলওয়ামার অনন্তপোরায় বাড়ি (নিহত)
১৯. কারি ইয়াসির, পাকিস্তানি নাগরিক (নিহত)
দীর্ঘ দেড় বছর পর পুলওয়ামা হামলার আগে ও ঘটনার দিনের একাধিক গৃরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে NIA-এর চার্জশিটে :
চার্জশিট এ উল্লেখ ঘটনাক্রম থেকে জানা যায়, পাকিস্তানে বসেই ওই সন্ত্রাসবাদী হামলার ছক কষা হয়েছিল। জইশ জঙ্গিদের হামলার প্রশিক্ষণ নিতে পাঠানো হয়েছিল আফগানিস্তানে। সেখানে আল-কায়দা-তালিবান-জইশ-ই-মহম্মদ (Al-Qaida-Taliban-JeM) ও হাক্কানি-জইশ-ই-মহম্মদের (Haqqani-JeM) শিবিরে বিস্ফোরক ব্যবহার ছাড়াও জঙ্গি হামলার বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করে ওই সন্ত্রাসবাদীরা। এর পর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেই তারা পাকিস্তানে ফিরে আসে।
এনআইএ এর মতে ২০১৬-১৭ সালে পুলওয়ামা হামলার মূল অভিযুক্ত মহম্মদ উমর আফগানিস্তানে গিয়েছিল। সেও সেখানে জঙ্গি হামলার প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক সীমান্ত জম্মু-সাম্বা সেক্টর দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করে। জঙ্গিরা সাম্বা-কাঠুয়া সেক্টরে ঢোকার জন্য কী ভাবে চেষ্টা করেছিল, এনআইএ’র তদন্তে তা-ও বেরিয়ে আসে। পুলওয়ামায় জইশ-ই-মহম্মদের অপারেশনের কম্যান্ডারের দায়িত্ব নেয় সে। শুধু তাই নয়, ভারতে ঢোকার পরেই মহম্মদ উমর আরও তিন পাকিস্তানি সহযোগী অর্থাত্ মহম্মদ কামরান, মহম্মদ ইসমাইল ও কারি ইয়াসির ছাড়াও আঞ্চলিক জঙ্গি সমীর ডর ও আহমেদ ডরের সঙ্গে বসে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে। তাদের এই প্ল্যানে আইইডি ব্যবহার করে কিভাবে হামলা চালানো যায় সে বিষয়ই তাই প্রধান্য পেয়েছিল।
জানা গিয়েছে এই জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়েছিল শাকির বাসির জান, পির তারিক আহমেদ শাহ ও বিলাল আহমেদ নামে তিন কাশ্মীরি। আর ১৪ ফেব্রুয়ারির মূল হামলার গ্রাউন্ড প্রস্তুতি নিতে জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়েতে আগেই রেকি করেছিল এই শাকির বসির। হামলায় ব্যবহৃত জিলেটিন স্টিক জোগাড় করে দিয়েছিল মুদসির আহমেদ খান। এই শাকির বসির নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছিল আরডিএক্স।
এন আই এর রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে এই জঙ্গী হামলার আগে আগে সাজিদ আহমেদ ভাট একটি মারুতি ইকো গাড়ি কিনেছিল। এই ছোট আকারের গাড়িটি কেনাই হয়েছিল আইইডি বিস্ফোরণ ঘটানোর লক্ষ্যে। ওয়াজির উল ইসলাম অনলাইন স্টোর অ্যামাজন থেকে চার কেজি অ্যামোনিয়াম পাউডার কিনেছিল। শুধু তাই নয় পুলওয়ামা হামলার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় আদিল ডরের যে ভিডিয়োটি রিলিজ করা হয়েছিল, ওই ভিডিও ২০১৯ সালের জুনে বানানো হয়েছিল।
আসলে ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এই হামলার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গীদের। কিন্তু, ওই সময় কাশ্মীরে ভারী তুষারপাতের কারণে জঙ্গিরা ওই দিনেই হামলা করে উঠতে পারেনি। কারণ, তুষার পাতের কারণে জাতীয় সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় সড়ক বন্ধ থাকায় ৬ ফেব্রুয়ারি জঙ্গিদের পরিকল্পনা বানচাল হয়।
ওই দিন হামলার পরিকল্পনা বানচাল হলেও, ১৪ ফেব্রুয়ারি শাকির বাসির ২০০ কেজির বিস্ফোরক বোঝাই মারুতি ইকো গাড়ি নিয়ে জাতীয় সড়ক ধরে চলে আসে আর ৬ তারিখের বদলে ওই দিনই পরিকল্পনা মাফিক সিআরপিএফ কনভয়ে হামলা চালায় আদিল আহমেদ ডর।


এই তদন্তে সামনে এসেছে যে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মহম্মদের নেতৃত্ব যথাক্রমে মাসুদ আজহার, রউফ আসগর ও অমর আলভি চাচা ছোটা মাসুদ এরা ক্রমাগত যোগাযোগ রেখে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছে ভারতে অনুপ্রবেশ করা ওই পাকিস্তানি জইশ জঙ্গিদের। শুধু তাই নয় হামলার আগে-পরে হাল-হাকীকত জানার জন্যে এই যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।
এনআইএ এটাও জানাচ্ছে যে পুলওয়ামা হামলার পর আরও একটি হামলার পরিকল্পনা ছিল জইশের। কিন্তু, ভারতীয় বায়ুসেনার বালাকোট হামালার জেরে তা ভণ্ডুল হয়। কারণ, মূলচক্রী মহম্মদ উমর ফারুক ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যাঘাতে নিহত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের উপর বেশ অনেকটাই আন্তর্জাতিক চাপও তৈরি করেছিল ভারত।
এই চার্জশিটে আরপিসি, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক আইন, বিদেশি আইন, জম্মু-কাশ্মীর সম্পত্তি সুরক্ষা আইনের একাধিক ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। ফেরারদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য পরোয়ানা জারি হয়েছে। সেইসঙ্গে মূল তদন্ত এখনও চলছে।