দ্যা কলকাতা মিরর ব্যুরো: ৩১’শে আগস্ট সোমবার সন্ধ্যায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তথা প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, ভারত রত্ন প্রণব মুখার্জীর মহা প্রয়াণ ঘটেছে। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। মস্তিষ্কে অস্ত্রপচারের পর পরই তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটে। সেই সাথে তাঁর শরীরে করোনা সংক্রমণ ও ঘটেছিল। যে কথা তিনি নিজেই টুইট করে জানিয়েছিলেন। আজ সেনা হাসপাতাল থেকে বুলেটিনে জানান হয়েছিল তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে ‘সেপটিক শক’ চলছে। কিডনীও কাজ করছিল না। অত:পর দীর্ঘ ২১ দিন গভীর কোমা ও ভেন্টিলেশন সাপোর্ট এ থাকার পর নিয়তির সাথে লড়াইয়ে পরাজয় বরণ করেন তিনি।
গত ৯’ই আগস্ট থেকে দিল্লীর সেনা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। অস্ত্রপচারের পর থেকেই তাঁর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় তাঁকে। আজ ৩১’ শে আগস্ট সোমবার সন্ধ্যে বেলাতেও তাঁর পুত্র অভিজিত মুখার্জী টুইট করে জানান যে তাঁর বাবা প্রয়াত হয়েছেন।
গত ৯ তারিখ প্রণব মুখার্জী দুপুর বেলায় ট্যুইট করে লিখেছিলেন, ‘আমি রুটিন চেকআপের জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার করোনার রিপোর্ট করানো হয়, আর রিপোর্ট পজেটিভ আসে। আমি সবাইকে অনুরোধ করছি যে, যারা যারা বিগত কয়েকদিনে আমার সম্পর্কে এসেছেন, তাঁরা নিজের পরীক্ষা করিয়ে নিন।”
উল্লেখ্য, কংগ্রেসের এই বর্ষীয়াণ নেতা প্রণব মুখার্জী, ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে আসিন ছিলেন। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন, সেই জন্যে নিয়মিত হাসপাতালে আসতে হতো তাঁকে। কিন্তু গত ৮’ই আগস্ট রবিবার রাতের দিকে বাথরুমে পড়ে গিয়ে কপালে আর ঘাড়ে চোট পান। হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করে দেখা যায় মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তাই ডাক্তার রা অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এর সাথেই তাঁর সোয়াব টেস্টে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জী একটি ট্যুইট করে লেখেন, ‘গত বছর ৮ ই আগস্ট আমার কাছে বড় খুশির দিন ছিল। সেদিন আমার বাবা ভারত রত্ন উপাধি পেয়েছিলেন। আর এর ঠিক এক বছর পর ১০’ই আগস্ট আমার বাবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওনার জন্য যেটা ভালো হবে, ভগবান যেন সেটাই করেন। ভগবান ওনাকে জীবনের সুখ দুঃখ সহ্য করার শক্তি দিক। ওনার জন্য প্রার্থনা করায় আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।”
তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন ছয় দশকব্যাপী ছড়িয়ে ছিল। বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় সমস্যা-সমাধানকারী নেতা।
১৯৬৯ সালে তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্যে প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হন। এরপর রাজনৈতিক কর্মজীবনে তার দ্রুত উত্থান শুরু হয়। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীতে পরিণত হন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় স্থান পান। ১৯৮২-৮৪ পর্বে তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার দলনেতাও ছিলেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিদেশ, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, রাজস্ব ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব পালনের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর প্রয়াণে রাজনৈতিক মহল সহ ভারতের প্রতিটি রাজ্যে নেমে এসেছে শোকের আবহ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইটে নিজের শপথ গ্রহনের ছবি দিয়ে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, তিনি লিখেছেন-“ভারতরত্ন শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে ভারত শোকাহত। তিনি আমাদের জাতির উন্নয়নের গতিপথে একটি অনবদ্য চিহ্ন রেখে গেছেন। একজন পণ্ডিত পার এক্সেলেন্স, একজন উঁচু রাষ্ট্রনায়ক, তিনি রাজনৈতিক পরিসর এবং সমাজের সকল শ্রেণী দ্বারা প্রশংসিত হয়। দশকের পর দশক ধরে চলা রাজনৈতিক জীবনে শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘস্থায়ী অবদান রাখেন। তিনি একজন অসাধারণ সংসদ সদস্য ছিলেন, সবসময় সুপ্রস্তুত, অত্যন্ত স্পষ্ট এবং রসিক। ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনকে সাধারণ নাগরিকদের কাছে আরও সহজলভ্য করে তোলে। তিনি রাষ্ট্রপতির বাড়িশিক্ষা, উদ্ভাবন, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের একটি কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ নীতি বিষয়ে তার জ্ঞানী পরামর্শ কখনোই আমার দ্বারা বিস্মৃত হবে না। আমি ২০১৪ সালে দিল্লিতে নতুন ছিলাম। প্রথম দিন থেকে শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশিকা, সমর্থন ও আশীর্বাদ পেয়ে আমি ধন্য। আমি সবসময় তার সাথে আমার মিথস্ক্রিয়া লালন করবো। সারা ভারত জুড়ে তার পরিবার, বন্ধু, ভক্ত এবং সমর্থকদের প্রতি সমবেদনা। ওম শান্তি।“
আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী শোক প্রকাশ করে লিখেছেন- “এটা গভীর দুঃখের সাথে আমি এটা লিখছি। ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। একটা যুগ শেষ হয়ে গেছে। দশকের পর দশক ধরে তিনি একজন পিতা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে আমার প্রথম জয় থেকে শুরু করে আমার সিনিয়র ক্যাবিনেট সহকর্মী হওয়া থেকে শুরু করে আমি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন প্রেসিডেন্ট হওয়া পর্যন্ত আমি তার নেতৃত্বকে স্যালুট জানাই, এবং #Bengal জনগণের জন্য তার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে স্যালুটজানাই। এই ক্ষতি অপূরণীয়, কিন্তু আমরা তার পরিবারের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি এবং এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য তাদের সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য প্রদান করব। তাদের, তার বন্ধু এবং সহকর্মীদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা।”
তাঁর মৃত্যুর খবরে বীরভুমের কির্ণাহারে শোকের ছায়া নেমেছে।বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁর আরোগ্য কামনায় পূজা অর্চনা করছিলেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের আশা ছিল এবারের দুর্গা পুজোতে বাড়িতেই দেবী কে বরণ করবেন এই মহামহিম। কিন্তু মহালয়ার আগেই যে বিসর্জনের দু:ক্ষ গ্রাস করবে সে কথা বুঝতে পারেননি কেউই।