দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে বিহারে বিধানসভা ভোট। তার আগেই লালু প্রসাদের দলে ভাঙ্গন। আরজেডি থেকে ইস্তফা দিয়ে দিলেন বর্ষীয়াণ নেতা রঘুবংশ প্রসাদ সিংহ। না কোনো দলীয় কোন্দল নয়। শারীরিক অসুস্থতাই দায় হয়ে দাঁড়াল লালুর দীর্ঘ দিনের সঙ্গীর দলযাপনে। রঘুবংশজীর পক্ষে দলের ভার বহন আর সম্ভবপর হচ্ছে না।
উল্লেখ্য এই মূহুর্তে তিনি নয়াদিল্লির এইমসের আইসিইউ-তে রয়েছেন। আইসিইউ’র বেডে শুয়েই কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়েরির পাতায় রঘুবংশ লিখেছেন, “৩২ বছর হয়ে গেল। কর্পুরি ঠাকুরের মৃত্যুর পর থেকে আপনার পাশে রয়েছি। আর নয়!” এর পর সেই পাতা ছিঁড়ে পাঠিয়ে দিলেন লালু প্রসাদ জীর কাছে।
প্রসঙ্গত, কর্পুরি ঠাকুর বিহারে সমাজবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ। তাঁরই অনুগামী ছিলেন লালু প্রসাদ, রঘুবংশ, নীতীশ কুমার এঁরা সবাই। আর এই কর্পুরি ঠাকুরের মৃত্যুর পরই পৃথক দল গঠন করেন লালু প্রসাদ। লালু প্রসাদের সাথে সঙ্গ দিয়েছিলেন এই রঘুবংশ।


এবার জেনে নেওয়া যাক প্রসাদজীর সংক্ষিপ্ত জীবন সারণী। পেশাদার জীবনের শুরুতে রঘুবংশ জী অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন। গণিত নিয়েই গবেষণা করতেন তিনি। কিন্তু শুধুমাত্র বিজ্ঞানের স্কলার হয়েই থাকতে চাননি তিনি, পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র জীবন থেকেই সমাজবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
অবশেষে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ কর্পুরি ঠাকুরের পদাঙ্ক অনুসরণে। মাষ্টার মশাই হওয়ার জন্যে মানুষের খুব কাছেই ছিলেন। একজন লোহিয়া পন্থী নেতা হিসেবে তিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যার মধ্যে পাঁচ বার বিহার বিধানসভায় বিধায়কও ছিলেন। এছাড়া সামলেছেন রাজ্যে বিদ্যুৎ মন্ত্রী’র পদ ও কেন্দ্রে মনমোহন সিংহ জমানায় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী। ।
রঘুবংশ জী বিহারের রাজ্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকও এই কারণে, লালু প্রসাদ যতটা দুর্নীতি পরায়ণ ও ধূর্ত, ঠিক ততটাই অত্যন্ত সৎ ও একনিষ্ঠ রাজনীতিক তিনি। আসলে এই মানুষটির সরল ও সাদা মাটা জীবনযাপন সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে অনেক গল্প কাহিনী। যাকে পাথেয় করেই লালু প্রসাদ বরাবর দাবার ছকে তাঁকে ঘোড়া করেছেন।
উল্লেখ্য, নিজে মন্ত্রী হওয়ার পরও বাড়িতে ছেলেকে নিয়ে নিয়মিত পড়াতে বসতেন। এমনকি একবার ছেলে অঙ্ক ভুল করায় বেত হাতে নিয়ে ছেলের পেছণ ধাওয়া করেছিলেন। একজন রাজ্য মন্ত্রীর প্রকাশ্যে ছেলের পেছনে বেত হাতে তাড়া করা এই ২০২০ তে হয়তো ভাইরাল বা ট্রোল হতো, কিন্তু সে সময়ে সেই দৃশ্য সাধারণ মানুষের কাছে ছিল মূল্যবোধের চরম পাঠ, যা লালু প্রসাদ যাদব কে দিয়েছে এক চুড়ান্ত মাইলেজ।
তিনি কেন্দরেও সমানভাবে সমাদৃত হয়েছেন। মনমোহন সিংহ এর আমলে, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকে তাঁর জমানাতেই ঐতিহাসিক একশ দিনের কাজ সংক্রান্ত আইন পাশ হয়। এমনকি জমি অধিগ্রহণ আইনের সংশোধনেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তাঁর স্মৃতি শক্তি খুব প্রখর। সকলেই অবাক হতেন এই দেখে যে রাজ্যওয়াড়ি গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প খাতে অনুদান ও তার রূপায়ণের পরিসংখ্যান রঘুবংশ জী মুখে মুখে বলতে পারতেন। আমলারা জানতেন অন্য কোথাও পাড় পাওয়া গেলেও রঘুবংশ জীর নদীর ঢেউ বড় উত্তাল।
সত্যিই কী শারীরিক অসুস্থতা তাঁর দল ছাড়ার মূল কারণ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর পেছনে রয়েছে অবহেলা আর অভিমানের গল্প, সেই সাথে প্রজন্মের মানসিকতার ফারাক তো বটেই। এই মূহুর্তে পশুখাদ্য মামলায় লালু প্রসাদ রাঁচির জেলে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর ছেলে তেজস্বী যাদব যে ভাবে পার্টি চালাচ্ছেন তাতে বেশ কিছুদিন ধরেই রঘুবংশ জী অসন্তুষ্ট।
এর মধ্যে ২০১৪ সালে যে রমা সিংহ রঘুবংশকে বৈশালী লোকসভা আসনে তিনি পরাস্ত করেছেন তেজস্বী যাদব এখন তাঁকেও দলে টেনেছেন। প্রতিপক্ষ দল বদল করলেই তো আর সমকক্ষ হতে পারে না। স্বভাবতই এই বর্ষীয়ান নেতা অপমানিত হয়েছেন। সেই অপমান, রাগ, অভিমানেই আজ ইস্তফা পত্র পাঠিয়েছেন তিনি।
রঘবংশ জীর পদত্যাগে লালু প্রসাদ জীর বক্তব্য- “রঘুবংশবাবু আপনার ইস্তফাপত্র গ্রহণ করছি না। আপনাকে কোথাও যেতে দেব না আমি। আমাদের সঙ্গেই থাকবেন”। লালু আরও লিখেছেন, “গত চল্লিশ বছর ধরে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং পারিবারিক সিদ্ধান্ত আমরা একসঙ্গে নিয়েছি। আপনারি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। তার পর আমরা বসে কথা বলব”।
স্বাভাবিক ভাবেই বিহার ভোটের আগে রঘুবংশের এই ইস্তফা পত্র, বিহার রাজনীতির অঙ্গনে বুড়ির ঘরে আগুন লাগার মত। তেজস্বী যাদবের কাছে রঘুবংশ জীর মূল্য ওই বুড়ির ঘরের ছাই হলেও বৃহস্পতিবার বিহারের রাজনীতিমহল বুঝতে পেরেছেন লালু প্রসাদ জী হারাচ্ছেন তাঁর অর্জুন কে।