দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: ধৃতিমান বোরা। আসামের এক যুবক, বাঁশের তৈরি একটি পণ্য আনতে জীবনের ১৭ টা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন নিরলস পরিশ্রমে। আর এই কষ্টের ফলাফল তাঁকে আর পাঁচজনের ভিড় থেকে আলাদা করে পরিচয় দিয়েছে বিশ্বের আসরে। আসামে একটি কথা খুব প্রচলিত ‘যার নাই বানহ, তার নাই খাহ’। যে কথার আক্ষরিক অর্থ,”বাঁশ বিহীন ব্যক্তির কোন সাহস নেই” এবং বাঁশ আসামে একটি বহুমুখী সম্পদ হিসেবে পরিচিত। যাকে ‘সোনালী ঘাস’ বলে জানেন এই রাজ্যের মানুষ।


আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে, ধৃতিমান বোরা তার শিক্ষাবিদ বাবা-মাকে বলে দিয়েছিল যে সে দ্বাদশ শ্রেণীর ওপরে আর স্কুলে পড়াশোনা করবে না; পরিবর্তে, তিনি বাঁশের আসবাবপত্র এবং রান্নাঘর এবং কৃষিজ দ্রব্য বাস্তবায়নের একটি ব্যবসা শুরু করেন। তিনি তাঁর এই কোম্পানী’র নাম দেন ডিবি ইন্ডাস্ট্রিজ।
তিনি আসামের প্রধান শহর গুয়াহাটি থেকে ২৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে বিশ্বনাথ চারালির নবপুর এলাকায় থাকেন। তাঁদের বাড়ির উঠোনের বাঁশ বাগান থেকে তিনি তাঁর কাজের জিনিস সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন- ” আমার বাড়ির উঠোনে থাকা বাঁশ ‘জাতি’ (বাম্বুসা তুলদা) এবং ‘বিজুলি’ (বাম্বুসা পল্লিদা), অভিনব কাজের জন্য উপকারী কিন্তু আমার মনে থাকা প্রকল্পের জন্য যথেষ্ট টেকসই ছিল না।”
কিন্তু মাত্র ২০ বছর বয়সী বোরার সেই সাহসের ছিল না যে সঠিক ধরণের মজবুত, টেকসই বাঁশ যেমন ভালুকা (বাম্বুসা বালকুয়া) কে যোগাড় করা যা এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে শীর্ষস্থান দখল করে ছিল।
এভাবে বছরের পর বছর ধরে, ডিবি ইন্ডাস্ট্রিজ বেশ কিছু বাঁশের জিনিস তৈরি ও বিক্রি করে। যেমন বাঁশের আসবাবপত্র, পার্টিশন, ঝুলন্ত দেয়াল, ফ্লাওয়ার ভাস, মাদুর, ক্রোকারি- কিন্তু এই সব পণ্যে এক্স ফ্যাক্টরের অভাব ছিল। এর পর দীর্ঘ ১৭ বছর সময় লাগলো এমন একটা পণ্য আনতে যা তাকে নাম, যশ দিলো। হ্যাঁ, বাঁশের তৈরি জলের বোতল। এই পরিবর্তনশীল ও দূষিত পৃথিবীতে যখন সবাই চাইছে প্লাস্টিক বর্জন করতে সেখানে এই বাঁশের তৈরি জলের জৈব বোতল ভারতে এবং ভারতের বাইরে যারা প্রাকৃতিক কন্টেইনার থেকে জল পান করতে চায় তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।


উল্লেখ্য আজ থেকে এক বছর আগে দিল্লিতে একটি আন্তর্জাতিক মেলায় এই বোতলের খুব বেশি একটা চাহিদা দেখতে পাওয়া যায় নি। কিছু ইউরোপীয় ডিলার লক্ষ্য করেছিল, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই আসেনি। কিন্তু কোথাও একটা ভুল ছিল যেটা বোরাহ খুব শীঘ্রই বুঝতে পারে। আর সেটা সে শুধরেও নেয় জলদি।
তিনি বলেন-“আজ থেকে এক বছর আগে প্রথম অর্ডার এসেছিল যুক্তরাজ্য থেকে। ২০০ বোতলের। ওখানকার ক্রেতা কাঁচা বোতল পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী ছিল, যার অর্থ তাদের গায়ে কোন রং বা গ্লস থাকবে না। কিন্তু ততদিনে, আমি একটি দামী মার্কিন মেড ওয়াটারপ্রুফ অয়েল পলিশ দিয়ে বোতলের ওপর প্রলেপ দিয়ে দিয়েছিলাম”।


এবার যুক্তরাজ্যের গ্রাহকের বিষয়টা মাথায় রেখে তিনি ক্লায়েন্টের জন্য পালিসের ব্যবহার অব্যাহত রাখলেও কিছু বিশেষ গ্রাহকদের জন্যে, তৈরি হওয়া বোতলে ট্রানজিটের সময় সুরক্ষার জন্য কর্প্পুর এবং সর্ষের তেলের প্রলেপ দিয়ে দেন।
এই একটি বোতল তৈরি করতে প্রায় পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে- ভালুকা বাঁশ কাটা থেকে শুরু করে ফোটানো, শুকনোকয়া , ধোঁয়াতে পোড়ানো, এবং আলাদা আলাদা অংশ গুলোকে এক সাথে জোড়া লাগানো এবং শেষ করা। গরম জলে ফোটালে বাঁশের ভেতরের গর্তের চারপাশের দেয়াল শক্তিশালী হয়, এবং এটি একটি বোতলকে অন্তত ১৮ মাস টিকে থাকতে সাহায্য করে। এই বোতলের দাম ২৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে।
বোরার বাবা এক দশকেরও বেশি সময় আগে লেকচারার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন, এবং এই মূহুর্তে ব্যবসাটি আজ একটি পারিবারিক ব্যবসায়ে রূপান্তরিত। সোশ্যাল মিডিয়া প্রচার ও বিক্রয় দেখেন বোরার ভাই গৌরব। এছাড়া তিনি ডিজিটাল মার্কেটিং এর দায়িত্বেও আছেন। এছাড়াও তিনি কাঁচামাল পরিচালনা, কর্মীদের তত্ত্বাবধান এবং গুণগত মানের উপর নজর রাখতে সাহায্য করেন। অন্যদিকে, মা কুমুদিনী অর্থায়নকারী হিসেবে সহায়তা করেছে, প্রথমে তার সঞ্চয় দিয়ে এবং তারপর পর্যায়ক্রমিক ঋণ নিয়ে ব্যবসা রপ্ত করতে সাহায্য করে।


ধৃতিমানের প্রায় প্রতিটি পণ্যই হাতে তৈরি করা হয়। বিদেশি ক্রেতারা ধোঁয়া’র প্রভাব এবং বোতলের ওপরের রাউন্ড ফিনিশ চান, আর কেউ কেউ থ্রেডকরা টুপিও চাইছেন।
বোরাহ বলেন – “আমার এখন বাড়িতেই ইউনিট আছে এবং আমি প্রতি মাসে স্থানীয়ভাবে ১০০-১৫০ ভালুকা উত্পন্ন করি। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিকটবর্তী বাণিজ্যিক কেন্দ্র গুয়াহাটি থেকে যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম পাওয়া এবং তৈরি পণ্য সেখানে পাঠানো,”
গৌরব বলেন- “আমরা বর্তমানে চাহিদার থেকে অনেক কম মাসে প্রায় ১,৫০০ বাঁশের বোতল উৎপাদন করছি। যদি আমাদের কাছে একটি ল্যাট মেশিন, একটি বৃহত্তর ড্রায়ার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম থাকত, তাহলে আমরা মাসে প্রায় ৮,০০০ উৎপাদন করতে পারতাম। কিন্তু এটা অনেক টাকা বিনিয়োগের বিষয়।”
ইতিমধ্যে বোরা তার এই মৌলিক বাঁশের বোতলের একটি পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছে। তিনিই প্রথম বাঁশের বোতল তৈরি করেন নি, কিছু চীনা নির্মাতা এর ভেতরে কাঁচের অভ্যন্তর এবং ইস্পাতের টুপি তৈরি করছেন। কিন্তু তাদের বোতল আমার মত সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নয়, তাই তারা পেটেন্ট করতে পারেন নি।”


আসাম থেকে এই বাঁশের জলের বোতল সর্বত্রই পরিবেশ বান্ধব ভোক্তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আজ বোরার মা গর্বিত যে তার ছেলে আবেগ অনুসরণ করেছে এবং এমন একটি নাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে যা তাদের পরিবারের অল্প কয়েকজনই অর্জন করেছে, এমনকি একাডেমিকভাবেও।
বোরার মা বলেন “লোকে যেমন বলে, একে জুপি বানহোর কুনু হোয় লাঠি, কুনু জাথি আরু কুনু বারহোনির কাঠি (একই বাঁশ থেকেই কেউ হয় লাঠি, কেউ বর্শা এবং কেউ বা ঝাড়ু)।