একসময় মৌসুমী ভৌমিকের ‘যশোর রোড’ গানটি সাড়া তুলেছিল নাগরিক জীবনে, কারা হেঁটে এসেছিল যশোর রোডের দীর্ঘ প্রান্তর ধরে সেই বৃত্তান্ত উঠে এসেছিল সেই গানে। কিন্তু আজকের গতিময় পৃথিবীতে কেই বা দুদণ্ড দাঁড়িয়ে শুনবে সেই গান, কেই বা হাতড়ে দেখবে যে বাস্তহারাদের সালতামামি। কিন্তু তাই বলে শরনার্থীদের সরণ কি থেমে থাকবে? এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ, কত কাঁটাতারের জালে সন্তান-সন্ততির রক্তে রোঁয়া জলের ছাপ ফেলতে ফেলতে তারা চলেছে।
‘ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে/ যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশ/ মাথার ভিতরে বোমারু বিমান/ এই কালোরাত কবে হবে শেষ’
ঊর্ধ্বমুখী পণ্যমূল্য, চিন-আমেরিকা দ্বন্দ্ব, মধ্য-এশিয়ায় সেনা ছাউনি, হালের কোভিড অতিমারি সবকিছুর থেকেও বর্তমান পৃথিবীর সবথেকে বড় সমস্যা হল শরনার্থী সমস্যা। যেকোনো সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যার ফলাফল হল এক অঞ্চলের মানুষকে উদখাত করে দিয়ে তাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার ঘৃণ্য চক্রান্ত। মাত্র কয়েকমাস আগের ঘটনা, আমরা রাজধানীর বুকে এক এম ছবি দেখলাম যা দেখলে অসহায়তা ছাড়া আর কিছুই বোধ হয় না।
হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিক তাদের শেষ সম্বল নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, তারপরেও পায়নি কোনো সরকারি সাহায্য। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি ‘ক্ষমা করেনি’ প্রভু, কেউ লুটিয়ে পড়েছে গ্রামের সীমান্তে, কাউকে গিলে নিয়ে ক্ষুধা, কাউকে টেনে নিয়ে গেছে এক্সপ্রেস ট্রেনের তীব্র গতি। দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে, পরিবার পরিজনের স্বার্থে তারা নিভৃতবাসে থেকেছে। যা করতে পারেনি কোনো বলিউডি তারকা বা কোনো রাজনৈতিক নেতা তাই করে দেখিয়েছে তারা। কিন্তু তারা আজো শুধুমাত্র এই যন্ত্রসভ্যতার পিলশূচ।




এই না হয় দুনিয়ার সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের ছবি কিন্তু এর ক্যানভাস অনেক দূর বিস্তৃত। মেক্সিকো থেকে সিরিয়া, মায়ানমার থেকে সুদূর চিলি – ‘আলোর পথযাত্রী’দের যাত্রা যেন শেষ হবার নয়। শেষ শতকের গোড়া থেকে ইউনাইটেড নেশনস্ একগুচ্ছ প্রকল্প নিয়েছিল এই বাস্তুহারাদের একছাদের তলায় নিয়ে আসার জন্য। বারংবার বলা হয়েছে যে তারাই হচ্ছে এই গতিময় পৃথিবীর শক্তিকেন্দ্র। তবুও তাদের ঘিরেই তৈরি হয়েছে রাজনীতি, শ্রমের অসমবন্টনে তাদের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে অনেক কমে।
তারমধ্যে এই ২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর কবলে পরেছে গোটা দুনিয়া, সেই জন্য এইবার এই মহামারির সঙ্গে শরনার্থী সমস্যা সরাসরি জুড়ে গেছে। তাই ইউনাইটেড নেশনস্ ঠিক করেছে যে করোনা মোকাবিলার সঙ্গে চাকরি হারানো পরিযায়ী শ্রমিক ও কর্মীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এই বার্তা দিয়ে তারা তাদের ওয়েবসাইটে একটি সচেতনতামূলক ভিডিও প্রচার করেছে।
ওয়েবসাইটে ইউনাইটেড নেশনস্-এর সেক্রেটারি জেনারেল আন্তেনিও গুতেরেস জানিয়েছেন যে, ‘এই অতিমারি পরিস্থিতিতে দুনিয়াজুড়ে যে শরনার্থীরা ছড়িয়ে পরেছে তাদের সামাজিক-আর্থনৈতিক স্থিতাবস্থার দিকটিকে ভুলে গেলে চলবে না। নয়তো একটু সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ গঠনে আমরা পিছিয়ে পরবো।’ একইসঙ্গে বর্ণবৈষম্যকে ইঙ্গিত করে তার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কথাও বলা হয়েছে। আমরা সকলেই সিরিয়ার সেই বাচ্চা ছেলেটির মৃত্যুর ছবি দেখে শিউরে উঠেছিলাম কিন্তু তারপরেও আমাদের দেশেই আমরা দেখেছি যে এক পরিযায়ী মহিলা শ্রমিকের মৃতদেহের পাশে তার কোলের শিশুর কান্না, এই ছবি যাতে বদলায় সেই অঙ্গীকারই নিতে হবে আজকের দিনে। একই সঙ্গে জানানো হয়েছে যে ঘর ছেড়ে বেরিয়া পরা যে মানুষের ইচ্ছে হয় তাকে যেন আমরা বাধ্য না করি তার স্বদেশ ছেড়ে যেতে।




#internationmigrantsday