গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি নেদারল্যান্ডসে লকডাউন ব্যবস্থা কার্যকরি হতেই আমস্টারডামের রেড লাইট জেলাটি রাতারাতি একটি ভূত নগরীতে রূপান্তরিত হয়।
ইতিমধ্যেই করোনাভাইরাস ডাচ রাজধানীর কুখ্যাত উইন্ডো পতিতালয়গুলিকে এক বিপর্যয়কর আঘাতের মুখোমুখি করে দিয়েছে এবং প্রায় চার মাস ধরে কোনও রকম আয় ছাড়াই ৩০০ জন আইনত সিদ্ধ যৌনকর্মী এখানে রয়ে গিয়েছেন।
ঐতিহাসিক আমস্টারডামের কেন্দ্রীয় একটি জেলা, স্থানীয়ভাবে ডি ওয়ালেন নামে পরিচিত, এটি পর্যটন উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল;
এবং সাধারণত প্রতি মাসে দশ লক্ষেরও বেশি দর্শনার্থী এখানে বেড়াতে আসেন।
কোভিড-১৯ মহামারীটি নেদারল্যান্ড এর যৌন শিল্পকে গভীর আর্থিক সমস্যায় নিমজ্জিত করেছে এবং সেই সাথে রেডলাইট জেলাটির ভবিষ্যত নিয়েও যথেষ্ঠ বিতর্কের উত্থান ঘটিয়েছে।
এমনই এক রোমানিয়ান যৌনকর্মী এবং রেড লাইট ইউনাইটেডের প্রতিষ্ঠাতা (১১০ জন মহিলা প্রতিনিধিত্বকারী একটি ট্রেড ইউনিয়ন।), ফেলিচিয়া আনার মতে, “যারা অবৈধভাবে কাজ করেছেন তাদের অনেকেই দেশে ফিরে গিয়েছেন কারণ তাদের কাছে অন্য কোনও বিকল্প ছিল না” আনা বলেছেন।
যদিও ট্যাক্স দেয়ার কারণে আইনি যৌনকর্মীরা সরকারী আর্থিক সহায়তার জন্য যোগ্য ছিলেন, তবে আনার মতানুসারে এই নগরের কেন্দ্রস্থলে তাদের ব্যয়বহুল জীবনযাত্রার খরচ প্রায় মাসিক € 1,100 (প্রায় 1,250 ডলার) যার নিরিখে কোনো অনুদানই যথেষ্ট ছিল না।
এরকমই ৫৬ বছর বয়সী একজন যৌনকর্মী অ্যানা (যার নামটি তার গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্যে পরিবর্তিত) বলেন “ক্লায়েন্টদের সাথে লকডাউন শুরু হওয়ার সপ্তাহে আমার মোট সাতটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। সব কটা কাস্টমার ই হাত ছাড়া হয়ে যায়। যে কারণে ঐ প্রথম সপ্তাহে আমি প্রায় ১৩০০ পাউন্ড আয় হাতছাড়া করেছি। এর পরে আমি আর চেষ্টা করিনি”।
এরিক হ্যামেকার যিনি রেড লাইট ট্যাক্স নামে এক বুককিপিং ফার্ম এর মালিকের (যারা অনেক যৌনকর্মীর আর্থিক সংস্থান পরিচালনা করে) মতে “কিছু মেয়ে ইণ্ডাস্ট্রি ছেড়ে দিয়েছে কারণ তারা কোভিড -১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি এবং আয়ের বিষয়ে সাধারণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল।
মূলত সেপ্টেম্বর অবধি লকডাউন থাকবে বলে ঘোষণা করার পরে এই জুলাইয়ের শুরুতে ডাচ সরকার পতিতালয়গুলিকে আবার চালু করার জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছে।
এই প্রসঙ্গে অনিতা বলেন “এটা যদি সেপ্টেম্বর হত, তাহলে আমাকে অন্য চাকরির সন্ধান করতে হত এবং অনেক পতিতালয়ের মালিক এবং উইন্ডো ভাড়ার মালিকেরা দেউলিয়া হয়ে যেতেন”। অনিতা প্রতিবন্ধী ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করেন এবং পতিতা তথ্য কেন্দ্র ও ট্যুর চালান।
তাদের ক্লায়েন্টদের কোভিড -১৯ উপসর্গ আছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করতে যৌনকর্মীদের উত্সাহিত করা হয়। বর্তমানে নতুন স্বাস্থ্যকর পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে হাত ধোয়া, অতিরিক্ত স্নান করা , কোনও চুম্বন এবং মুখোমুখি সাক্ষাতকার সীমিত করা।
হ্যামেকার বলেছেন, “ভ্রমণ ব্যতীত আগে যেসব মেয়েরা সুনির্দিষ্ট ভাবে আগে আয় করছিল তাদের পক্ষে উপার্জন অসম্ভব হবে।” এই জেলার আয়ের কমপক্ষে ৭০% আয়ই পর্যটন থেকে আসে।
যদিও আমস্টারডাম বহু বছর ধরেই সুস্থ ভ্রমণের পরিবেশ বজায় রাখার জন্যে লড়াই করে যাচ্ছে। কারণ পর্যটকদের ভীরের তীব্র শব্দ, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা এবং বাসিন্দাদের সাথে অপ্রীতিকর আচরণ একটি বাড়তি অসন্তোষ গড়ে তুলছিল।
লকডাউন চলাকালীন ফাঁকা রাস্তা এবং শান্ত পরিবেশ দেখে উদ্বেলিত হয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলে বাস করা বাসিন্দারা এখন পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছেন।
৩০ হাজারেরও বেশি কেন্দ্রীয় বাসিন্দা “আমস্টারডামের ও একটি পছন্দ আছে” শীর্ষক একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন, যা নগর কর্তৃপক্ষকে কেন্দ্রের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য এবং বার্ষিক হিসেবে পর্যটকদের ১২ মিলিয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার করার আহ্বান জানিয়েছে। এই সংখ্যা গত বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৮.৮ মিলিয়নে।
মারটিজন বদির, যিনি পিটিশন শুরু করেছিলেন, তিনি বলেছেন “লকডাউনে আপনি দেখেছেন যে লোকেরা তাদের এই শহরটি নতুন করে আবিষ্কার করেছে (তারা আগেও দেখেছিল)। তার দেখেছে যে অভ্যন্তরীণ নগরীর অর্থনীতিটি পর্যটনের উপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে”।
বদির আরও বলেন যে, “আমরা পর্যটনবিরোধী নই, তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের মধ্যে আরও ভাল ভারসাম্য তৈরি করার জন্য সিটি কাউন্সিলের আরও বেশি দ্বায়িত্ব নেওয়া উচিত এবং চিন্তাভাবনা করা উচিত যে এই সংকটের পরে এই শহরকে আমরা কী ধরণের ভাবে চিত্রিত করতে চাই”।
হ্যামেকার আরও জানান বলেন যে “আমস্টারডামের বাসিন্দারা আশা করছেন যে যদিও এটি আর পূর্বের মত পর্যটকের ডিজনিল্যাণ্ড হয়ে ফিরবে না”।
এই বিষয়ে সিটি কাউন্সিল কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
অনিতা বলেন- “যৌনকর্মীরা বলেছেন যে তাদের এই শিল্পকে সমস্যার মূল হিসাবে এককভাবেই দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু আসলে যৌনকর্মীরা এই ঝামেলার কারণ নয়। প্রাইভেট জেট এর উড়ান এত সস্তা যে সত্য অর্থে ব্যাচেলর পার্টিগুলিই মূল সমস্যা”।
তারা বলেছেন যে এই নিষিদ্ধ জেলার সংস্কার করলেই ওভারটুরিজমের বিষয়টি সমাধান হবে না।
আনা বলেছেন- “পর্যটকরা যে কোনও উপায়ে বেড়াতে আসছেন। আমস্টারডামের চারপাশে পাঁচিল দিয়ে না ঘেরা অবধি আপনি পর্যটন বন্ধ করতে পারবেন না” ।
লকডাউনের আগে, বাধাগ্রস্ত আচরণ কমিয়ে আনার জন্য এবং যৌনকর্মীদের অবজ্ঞাপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য রেড লাইট জেলার একটি বড় আকারের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি আমস্টারডামের মেয়র ফেমকে হালসেমা বিবেচনা করছিলেন।
মে মাসে, তিনি বলেছিলেন যে মহামারীটি “ভবিষ্যতের নগর কেন্দ্র সম্পর্কে ভাবার তাগিদকে” তুলে ধরেছে।
হালসেমা জেলার জন্য চারটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন, যা পতিতালয়ের উইন্ডোগুলির সংখ্যা হ্রাস থেকে শুরু করে যৌনকর্মীদের নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি শহরের কেন্দ্রের বাইরে একটি “পতিতাবৃত্তি হোটেল”খোলার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং মে মাসে বিবেচনা করা সেই প্রস্তাব অনুযায়ী নতুন জায়গার সন্ধানের কাজ চলছে।
গরম মরসুম কেটে গেলে পরিস্থিতিগুলির বিষয়ে পরিষদ একটি ভোট গ্রহণ আয়োজন করবে।
পর্যটকদের জন্যে নতুন নিয়ম ইতিমধ্যে চালু করা হয়েছে। ট্যুর গাইডগুলিকে আর কোনো জানালার সামনে থামার অনুমতি নেই এবং পর্যটকদের দ্বারা যৌনকর্মীদের ছবি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।