28 C
Kolkata
Monday, September 25, 2023
More

    নাগরী ভাষা সিলেটের ঐতিহ্য – মোঃ হোসেন আহমদ

    ভাষা যেকোন অঞ্চল, জনগোষ্ঠী তথা দেশের জন্য ঐতিহ্যের ও সম্মানের যার ঐতিহাসিক তাৎপর্য অত্যধিক। সিলেটি ভাষাভাষীরা যে ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করেন সেটি তাঁদের আঞ্চলিক মাতৃভাষা কারণ এর লিখিত রূপ বিদ্যমান ও সেটি অনেক প্রাচীন। তাঁদের আছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর প্রথায় আছে বৈচিত্রময়তা। উদাহরণ স্বরূপ চিন্তাচেতনা, আচার-আচরণ, আতিথেয়তা, সৌখিনতা যা এই অঞ্চলের মানুষদের ভিন্নতা দিয়েছে ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এছাড়া বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মণ্ডিত এ অঞ্চলকে ‘দুটি পাথার একটি কুঁড়ির দেশ’, ‘আধ্যাত্মিক নগরী’ বলে ডাকা হয় ও বিশ্বে ‘দ্বিতীয় লন্ডন’ হিসেবে খ্যাত। এছাড়া সবুজ ঘেরা চা বাগান, উঁচু নিচু পাহাড়, নদী ও বিশাল হাওয়ার এ অঞ্চলের সৌন্দর্য্যকে আর বাড়িয়ে দিয়েছে। ঐতিহাসিক দিক থেকেও সিলেট অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম।

    কোন আদিম জনগোষ্ঠীর মুখের কথ্য অথবা বহুল ব্যবহৃত কথাবার্তা ঠিক তখনই ভাষায় পূর্ণতা লাভ করে যখন তার একটি প্রাচীন লিখিত রূপ বিদ্যমান থাকে। একই সাথে সেটি আর মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যায় ঠিক তখন যখন আন্তর্জাতিক ভাবে এর স্বীকৃতি অর্জিত হয়। তেমনিভাবে ছয়শ’ বছরের পুরোনো নাগরী লিপি সিলেটের লোকসাহিত্যের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। নাগরী লিপির বর্ণ সংখ্যা বত্রিশটি (৩২)। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সাতানব্বই (৯৭) তম অবস্থানে এখন সিলেটি নাগরী ভাষা (সূত্রঃ ভিজুয়াল ক্যাপিটালিস্টের ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০ সালের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী)।

    কৌতুহল ও দ্বিধাদ্বন্দ রয়েছে সিলেট নামের উৎপত্তি নিয়ে। প্রাচীন গ্রন্থাদিতে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন নামের উল্লেখ রয়েছে যেমনঃ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শিবের স্ত্রী সতি দেবীর কাটা হস্ত (হাত) এই অঞ্চলে পড়েছিল, যার ফলে ‘শ্রী হস্ত’ হতে শ্রীহট্ট নামের উৎপত্তি বলে হিন্দু সম্প্রদায়ে বিশ্বাস। ঐতিহাসিক এরিয়ানের লিখিত বিবরণীতে “সিরিওট” ও চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণ কাহিনীতে “শিলিচতল” উল্লেখ আছে। তুর্কি সেনাপতির বঙ্গবিজয়ের পর উনার দলিলপত্রে “শ্রীহট্ট” নামের পরিবর্তে “সিলাহেট”, “সিলহেট” নামে লিখেছেন। কথিত আছে যে, এক ধনী ব্যক্তি তাঁর কন্যার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি হাট নির্মাণ করেন ও এর নামকরণ করেন শিলার হাট। নানাভাবে এটি বিকৃত হয়ে সিলেট নামের উৎপত্তি হয়।

    অতঃপর যখন “সিলেটে” “হযরত শাহ্ জালাল)(রঃ)” আসেন তখন শত্রু পক্ষ তাকে এবং তার অনুসারী ৩৬০ আউলিয়াদেরকে “শিলা” বা “পাথর” দ্বারা আটকে দিয়েছিলো। তখন মহান আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবানীতে তিনি বলেন “শিলাহাট”(অর্থ্যাৎ- পাথর সরে যা)। তখন, তথখনাৎ পাথর গুলো সরে যায়। এরপর থেকে নাম রাখা হয় “শিলাহাট”। তারপর নাম সহজ করতে করতে হয় “শিলহাট”, “সিলাহেট”, “সিলেট (বর্তমানে)”।

    কথিত আছে যে, ১৭৮২ সালের ৩ জানুয়ারী সিলেট জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ও ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পূর্বে সিলেট ভারতের আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ফলে সিলেট ছাড়াও ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি; অার ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাসহর, ধর্মনগর সহ প্রায় এক কোটি আঠারো লাখ মানুষ এই ভাষায় কথা বলে থাকেন। যদিও ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভাষাটি নানান আপত্তি বিপত্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলো।

    উল্লেখ্য তের-চৌদ্দ শতকে এই অঞ্চলের তৃণমূল মানুষ লোকসাহিত্যের চর্চা বাংলা লিপিতে না করে তুলনামূলক সহজবোধ্য নাগরী লিপিতে করেছিলেন। কথিত আছে যে, হযরত শাহজালাল (রঃ) এই অঞ্চলে আসার পর ও একসাথে সুফি, ফকির ও দরবেশের আগমনের ফলে এই অঞ্চলের মুসলিমরা কোন না কোন কারণে নাগরী লিপির চর্চা শুরু করেছিলেন। ধারণা করা হয় ধর্ম প্রচারের জন্য অধিকতর সহজ এই ভাষার উদ্ভাবন ও চর্চা শুরু হয়েছিলো।

    পূর্ব পাকিস্তান আমলে নাগরী ভাষায় বই মুদ্রিত হতো। পরিতাপের বিষয় ১৯৭১ সালে নাগরী ভাষা প্রকাশের একমাত্র ছাপাখানাটি বিধ্বস্ত হয়, যার ফলে মুদ্রণ কার্য বন্ধ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে ক্রমান্বয়ে হস্তলিখিত নাগরী লিপির মূল কপিগুলির বড় অংশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলো। এমনকি সে সময় আশ্চর্যজনক ভাবে কলকাতায় সংরক্ষিত নাগরী লিপির কপিগুলোও হারিয়ে গিয়েছিলো। তথাপি ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের উঁচু মহলে ও সাহিত্য প্রাঙ্গনে এর চর্চার ব্যাপকতা ও সংরক্ষণ বিদ্যমান আছে। তবে ধারণা করা হয় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হারিকেল জনপদ খ্যাত সিলেটে এর চর্চা অতোধিক হয়ে আসছিলো।

    তাই এই অঞ্চলের মানুষ তাঁদের স্বর্ণালী ঐতিহ্যকে আরও সম্মৃদ্ধ করে তুলতে সিলেটের আঞ্চলিক পর্যায়ে ইতিমধ্যে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন যেমন— ঐতিহাসিক কিংব্রীজের ফটক সংলগ্নে নাগরী চত্ত্বর স্থাপন, স্থানীয় গবেষকদের গবেষণা ও শিক্ষাবিদের রচিত বই ইত্যাদি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভাষা সংরক্ষণ ও প্রসারণে এই পদক্ষেপ নিতান্তই অপ্রতুল। ফলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে নাগরী ভাষা সংরক্ষণ ও প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    কতদিন বৃষ্টি চলবে দক্ষিণবঙ্গে ? জানাল আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ঝাড়খণ্ডের উপর তৈরি হওয়া নিম্নচাপের জেরে বিগত ক’দিন ধরে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে...

    ‘‌ফেলো কড়ি , পাও পঞ্চায়েতের পদ’‌ ! বিস্ফোরক দাবি তৃণমূল বিধায়কের

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : এবার বিস্ফোরক অভিযোগ তুললেন তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক ইদ্রিশ আলি। পঞ্চায়েত নির্বাচন মিটে গেলেও...

    বড় সিদ্ধান্ত মোদী সরকারের ! গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হতে চলেছে ‘বার্থ সার্টিফিকেট’

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : এবার থেকে বার্থ সার্টিফিকেটই হতে চলেছে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট। কারণ ১ অক্টোবর থেকেই...

    চিনের কাছে ৫-১ গোলে হারল ভারত !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : পেনাল্টি বাঁচালেন ভারতের (Indian Football Team) গোলকিপার গুরমীত। দুর্দান্ত গোল করে ভারতের হয়ে...

    বিশ্ব বাজারে রেকর্ড অস্ত্র বিক্রি করল ভারত !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : আমদানি নয়, বিশ্ববাজারে অস্ত্র বিক্রির আশা শুনিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারতীয় "প্রতিভা ও...