দ্যা ক্যালকাটামিরর ব্যুরো: আজ নাগাসাকি দিবস। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে ঠিক এই দিনে জাপানের নাগাসাকি শহর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ‘লিটল বয়’ নামক আণবিক বোমার আঘাতে। আমেরিকার এই ঘৃণ্য আক্রমনের ৭৫ বছর পর প্রায় ডজন ক্ষাণেক ভুক্তভোগী অভাগা মানুষ জিতে নিলো তাঁদের বেঁচে থাকা তথা সরকারী মেডিকেল সুবিধা পাওয়ার অধিকার। আজ নাগাসাকি দিবসে তাঁদের কোথায় থাকলো এই প্রতিবেদনে।
গত ২৯ শে জুলাই, একটি জাপানী কোর্ট ডজন ক্ষাণেক মানুষ কে ৭৫ বছর আগে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আঘাত হানা পারমানবিক বোমার তেজস্ক্রিয় ‘কালো বৃষ্টির’ শিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই রায়ের ফলে এই মানুষগুলি ডাক্তারী পরিষেবার আওতাধীন হতে পারবেন।হিরোশিমা জেলা আদালত তার রায়ে বলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমা হামলার পর ৮৪ জন বাদী পক্ষকে একই সুবিধা পাওয়া উচিত যারা বিস্ফোরণসীমার কাছাকাছি বাস করত।
উল্লেখ্য, ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের একটি শহর হিরোশিমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোমা নিক্ষেপ করে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ৭০,০০০ এর ও বেশী লোক নিহত হয়। তিন দিন পরে অর্থাত্ আজ ৯’ই আগস্ট নাগাসাকির উপরেও আরেকটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটে এবং এতে আরও ৪০,০০০ মানুষ নিহত হয়।
এই পারমানবিক বোমা হামলায় হাজার হাজার লোক ধীরে ধীরে পুড়ে যাওয়া বা বিকিরণ সংক্রান্ত অসুখে মারা যায়। এই অঞ্চল জুড়ে এই বোমা তেজস্ক্রিয় “কালো বৃষ্টি” সৃষ্টি করেছে- যার ফলে শহরব্যাপী দাবানল থেকে কার্বনের অবশিষ্টাংশ, এবং অন্যান্য বিপজ্জনক উপাদান আকাশ থেকে ঝরে পড়েছিল। কালো বৃষ্টি মানুষের চামড়া এবং পোশাকের উপর পড়েছিল, শ্বাসের সাথে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করেছিল, খাদ্য এবং জল দূষিত করেছিল সেই সাথে ব্যাপক বিকিরণ বিষক্রিয়া ঘটিয়েছিল।আমেরিকই একমাত্র দেশ যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু বোমা ব্যবহার করে।এই মামলার অন্যতম আপিলকারী ৭৯ বছর বয়স্ক সেইজি তাকাতো বোমা হামলার সময় তার বয়স ছিল ৪ বছর। তার 8 বছর বয়সেই হাতের লিম্ফ প্রদাহ বিকশিত হয়, এবং তারপর থেকে ক্রমাগত স্ট্রোক এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছেন।
কিন্তু এখন পর্যন্ত, তিনি এবং “হালকা বৃষ্টি” এক্সপোজার জোনে বসবাসকারী অন্যরা “ভারী বৃষ্টি” অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্তদের মত বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারেননি। “ভারী বৃষ্টি” অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত তারাই যারা যে সব এলাকাকে সরকার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিস্ফোরণ এলাকার সবচেয়ে কাছাকাছি হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেখানে বাস করে। কিন্তু এই রায় এ প্রথমবারের মত “ভারী বৃষ্টি” অঞ্চলের বাইরে বাস করা ভুক্তভোগীদের একই সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
আদালত তার রায় প্রকাশ করার পর টাকাতো বলেন-“আমরা সরকারকে তাদের মতই সত্য এবং বাস্তব বিষয়টা বলছি। কিন্তু তারা কখনো আমাদের কথা শোনেনি, আজ আমি অত্যন্ত খুশি। আমি আশা করিনি যে ৮৪ জন (বাদী) এই মামলায় জয়লাভ করবে।২৯ জুলাই, ২০২০ তারিখে হিরোশিমা আদালতের রায়ের পর বাদী এবং সমর্থকদের একটি দল আনন্দ উদযাপন করছে।


টাকাতো আরও বলেন যে তিনি “উদ্বিগ্ন” ছিলেন কারণ সকল বাদী এখন বয়স্ক, যাদের বেশীরভাগেরই বয়স ৮০ এবং ৯০ এর মধ্যে। তিনি বলেন, “যদি এই (কেস) দীর্ঘায়িত হয় তাহলে আমরা সবাই মারা যাব।
এই রায় শহর এবং প্রিফেকচারাল সরকারকে নির্দেশ দেয় যে বাদীরা “এই-বোমার শিকার” হিসেবে স্বীকৃত যা তাদের চিকিৎসা নেওয়ার সময় “বিশেষ চিকিৎসা সুবিধা” প্রদান করে, যার মূল্য মাসে প্রায় ৩০০ মার্কিন ডলার।
এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিহিদ সুগা বলেন, সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। তিনি বলেন, “মন্ত্রণালয়ে, হিরোশিমা জেলা এবং হিরোশিমা শহরের এই রায়কে বিস্তারিত ভাবে পরীক্ষা করে দেখা হবে।”
এই ঐতিহাসিক রায় এসেছে পারমানবিক বোমা হামলার ৭৫ তম বার্ষিকীর এক সপ্তাহ আগে, যখন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান মার্কিন বি-২৯ বোমারু বিমান এনোলা গে’কে হিরোশিমায় “লিটল বয়” নামে একটি পারমাণবিক বোমা ফেলার অনুমতি দেন।
যারা বেঁচে গেছে তারা বলছেন যে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয় একটি গোলমালহীন আলোর ঝলকানি দিয়ে, এবং তীব্র গরমের এক বিশাল ঢেউ যা পোশাককে ছাই এ পরিণত করে। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি লোকজন অবিলম্বে বাষ্পীভূত বা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেখানে একটি বধির বিস্ফোরণ ছিল যা কারো কারোর জন্য মনে হচ্ছিল যেন শত শত সূচ দ্বারা আঘাত করা হয়েছে।
তারপর আগুন ছড়িয়ে পড়ল। আগুনের শিখার ঝড় বয়ে যায়। বেঁচে যাওয়া অনেককে ফোস্কা দিয়ে ঢেকে থাকতে দেখা গেছে। মৃতদেহ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে।এই চরম ধ্বংসের ফলে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট ডি আইজেনহাওয়ার সহ অনেকেই পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে দেখা যায়।১৯৫৮ সালে হিরোশিমা সিটি কাউন্সিল ট্রুম্যানের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ করে। তারা প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের অবস্থানকে “হিরোশিমার জনগণ এবং তাদের ভুক্তভোগীদের প্রতি চরম বিকৃতি” বলে অভিহিত করে।কিন্তু ট্রুম্যান আরো কঠোর অবস্থানে থেকে লিখেছিলেন, “আমি মনে করি হিরোশিমা এবং নাগাসাকির আত্মত্যাগ জাপান এবং মিত্রদের সম্ভাব্য কল্যাণের জন্য শুভ এবং জরুরী ছিল।২০১৬ সালে বারাক ওবামাই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে হিরোশিমা সফর করেন, যেখানে তিনি “পারমাণবিক অস্ত্র বিহীন বিশ্বের” আহ্বান জানান।
বোমা হামলার ভয়াবহতা এবং এর পরবর্তী ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে এবং হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল জাদুঘরে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যা জাপানের শহরের গ্রাউন্ড জিরোর বা বোমা পতনের কেন্দ্রের কাছে অবস্থিত।সরকারী সম্প্রচারকারী এনএইচকে-এর মতে,গত মার্চ মাস পর্যন্ত হিরোশিমা এবং নাগাসাকি বোমা হামলায় ১,৩৬,৬৮২ জন সরকার স্বীকৃত মানুষ বেঁচে গেছে।কিছু বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি তাদের ব্যক্তিগত মিশন তৈরি করেছে এটা নিশ্চিত করতে যে হিরোশিমা-নাগাসাকির নারকীয় ঘটনা কেউ যেনো ভুলে না যায়।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কোসেই মিতো তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে যান- যখন বোমা টি পড়ে তখন তার মা মাসের গর্ভবতী ছিলেন।গত ১৩ বছর ধরে তিনি প্রায় প্রতিদিনই হিরোশিমা পিস মেমোরিয়ালে থাকেন। তিনি বিভিন্ন ভাষায় বোমা হামলা এবং এর পরবর্তী ঘটনার নথিপত্র তুলে ধরেছেন।তিনি বলেন, “ঐতিহাসিক তথ্য না জেনে, আমরা আবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে পারি।””অতীতে যা ঘটেছে তার জন্য আমাদের কোন দায়িত্ব নেই, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তো আমাদের দায়িত্ব আছে। “