দ্যা ক্যালকাটামিরর ব্যুরো: ২৭ মার্চ, ২০২০। কোভিড-১৯ মহামারীর এক ভয়াবহ মুহূর্ত আঘাত হানে ইতালিতে। বেসামরিক সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন মাত্র ২৪ ঘন্টায় মারা গিয়েছে ৯৬৯ জন লোক। এর আগের সপ্তাহগুলোতে একে একে চার্চের পার্লারে কফিনের ছবি জমা পড়েছিল আর উত্তর ইতালির বার্গামোর রাস্তায় সামরিক ট্রাকের ক্যারাভ্যানে করে ইতালীয়দের বাড়িতে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল খাবার, কফিন। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে স্তব্দ হয়ে যায় গোটা ইতালি। চীনের উহানের পর ইতালিই দ্বিতীয় দেশ যেখানে করোনা আঘাত হেনেছিল সবার আগে।
এখন, সেই ঘটনার মাত্র চার মাস পরে, ইতালির জীবন অনেকটা স্থিতিশীল। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেছিলেন- “কেউ আর এমন টি চায় না”, দেশ এখন সম্পুর্ণ স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে যদিও মাঝে মাঝে দেশটিতে আসা অভিবাসীদের কারণে বা ঘনিষ্ঠ মহলে ঠাসাঠাসি করে বাস করার জন্যে কিছু নতুন কেস সামনে আসছে।
ইতালিতে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৩৫,০০০। যেখানে এখন নতুন মৃত্যুর সংখ্যা এক ডজনেরও কম। এখন মোট আক্রান্তর সংখ্যা ২,৫০,১০৩ জন, যেখানে দৈনিক আক্রান্তর সংখ্যা ১০০ জনের ও কম।
যদিও নাইটক্লাব এবং স্কুল এখনো খোলা হয়নি, মুখের মুখোশ বাধ্যতামূলক এবং সামাজিক দূরত্ব বলবৎ করা হয়েছে, কিন্তু এ দেশে এখন পুরোদমে চলছে গ্রীষ্ম কাল চলছে। এখন মানুষ রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে যাচ্ছে, খোলা চত্বরে গ্রীষ্মকালীন ঐতিহ্য-ভ্রমণ উপভোগ করছে, ছুটিতে যাচ্ছে এবং হ্যাঁ, তারা মহামারীকে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। না, এটা কোন অলৌকিক ঘটনা নয়, বিশেষ করে ব্রাজিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত জাতির তুলনায়, যেখানে মহামারী এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।


মার্চ মাসে যখন প্রায় ১০০০ লোক মারা যায়, তখনই ইতালিয়ানরা লকডাউন করে দিয়েছিলো। আর এই লকডাউন এর ঘটনা খুব সাধারণ হযে গিয়েছিলো। গোপন ডিনার পার্টি করা বা অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক না করে ঘুরে বেড়ানো ইতালির জাতীয় উন্মাদনাকে অপমান করার সামিল ছিল। সবাই ঠিক করে নিয়েছিল লকডাউন মানে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া প্রত্যেককে তাদের বাড়ির মাত্র ৩০০ মিটারের মধ্যে আটকে রাখা।
ইতালির ন্যাশনাল হেল্থ ইনস্টিটিউটের পরিচালক জিয়ান্নি রেজা বলেছেন -“যদিও মানুষ চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের অসমর্থিত শিক্ষা ব্যবস্থা অনলাইন শিক্ষার সাথে মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করায় শিশুরা তাদের মূল্যবান সময় হারিয়েছে। কিন্তু এটা ততটা কঠিন ছিল না যেখানে থরে থরে মৃতের ছবি, জনবহুল হাসপাতাল, নিজের দাদু-দিদিমা-ঠাকুমা-ঠাকুরদার নি:সঙ্গ মৃত্যু এক কঠিন ও অকল্পনীয় জাতীয় শোকের সৃষ্টি করেছে এবং সারা দেশকে ভীত করেছে, তার থেকে।
তিনি আরও বলেন যে- “জনগণ প্রথম পর্যায়ে বেশ পজিটিভ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তবে সম্ভবত ভয় বা আতঙ্ক সেখানে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ বার্গামোতে সামরিক ট্রাকে বহন করা কফিনের ছবি ছিল কঠোর, এবং আপাতদৃষ্টিতে সেই ছবি পরিষ্কার করে দিয়েছিল কিভাবে এই ভাইরাসের অনিয়ন্ত্রিত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেলে দেশ জুড়েই গুরুতর সমস্যা দেখা দেবে।”
ধীরে ধীরে, এখন পরিস্থিতি সেই ভয়াবহ দিন থেকে ভালো হয়ে উঠেছে,মহামারী ও দৈনন্দিন সংক্রমণের সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা ছুঁয়ে অবশেষে নগণ্য সংখ্যায় পতিত হয়েছে। আসলে মানুষ লকডাউন কে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে, তারা কর্তব্যপরায়ণতার সাথে (ফেস-মাস্ক) মুখোশ পরেছে, শুধু তাই নয় তারা নিয়ম করে আজও সেই অভ্যাস চালিয়ে যাচ্ছে, এবং এর ফলাফল দেশটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছে।


আসলে ইতালির এই ভাল হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে মানুষের কঠোর বাধ্যতা। প্রত্যেকটি মানুষ সরকারী নিয়মের অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। যখন আনলক ফেজ শুরু হয় তখন জিম খুব সাবধানে খোলা হয়েছে। দোকান বা রেস্টুরেন্ট এ ভিড় না করার আবেদন করা হয়েছে, ৫০% যাত্রীর মধ্যে বাস বা ট্রেন পরিবহন সীমিত করা হয়েছে সেই সাথে ফেস-মাস্ক আর প্রতিটা ব্যবসায়ী সংস্থাতে স্যানিটাইজার রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
২৩ জুলাই,২০২০ তারিখে ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্তো স্পেরানজা নিশ্চিত করেছেন যে এই কঠোর পরিশ্রম সফল হয়েছে। তিনি ইতালির কোল্ডিরেত্তি কৃষি গ্রুপকে বলেন, “আমি বিশ্বাস করি ইতালি ঝড় থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমি সরকারের কথা ভাবছি না, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের কথা ভাবছি।”
ভাইরাস কে টেক্কা দেওয়ার এই সাফল্যের গল্প সত্ত্বেও, ইতালি ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এ বছর জিডিপি প্রায় ১০% এর নিচে নেমে যাবে এবং পর্যটন খাতের সাথে যুক্ত অনেক ব্যবসা আর কখনোই হয়ত খুলবে না। কিন্তু ইতালিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ ঘটার আর সম্ভবত কোনো আশঙ্কা নেই তাই আর কোন লকডাউন হবে না এবং ব্যবসায়ীরা এখন টাকা হারানোর ভয় ছাড়াই তাদের ব্যাক আপ দিয়ে আগামী দিন গুলো চালিয়ে যেতে পারে। ইতালি এখন সারা বিশ্বের কাছেই একটা রোল মডেল।
তাই একটাই প্রশ্ন, ইতালির মত আমরাও প্রদীপ জ্বালিয়েছি ঘরে ঘরে, তাদের মত আমরাও থালা বাটি বাজিয়েছি মহামারী কে দূরে সরানোর জন্যে কিন্তু আদতে কী আমরা ইতালির জনসাধারণের মানসিকতার ধারে কাছে পৌঁছতে পেরেছি? সেই ঘুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উক্তি মনে পড়ে গেলো -“আদতে সেখানে যাহা ঘটিতেছে আমরা তাহা দেখিতে পারি নাই, আমরা কেবল অনুকরণ করিয়াই যাইতেছি”। যদিও এখন আমাদের হাতে হাইস্পীড নেট, সোসাল মিডিয়া, তবুও কী আমরা সত্যিই কিছু দেখতে পাচ্ছি না!