দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: “অর্ধেক মরসুম চলে গিয়েছে, কিন্তু ইলিশ কোথায়?” এই প্রশ্নই ঘোরফেরা করছে আবু জাহের (৪০) এর মত বাংলাদেশের ভোলা জেলার উপকূলীয় সোমরাজ গ্রামের মত্সজীবীদের মনে। তাদের মতে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর নতুন করে মত্স শিকার শুরু হয়েছে, নদী ভরা জল রয়েছে, কিন্তু ইলিশ নেই! তাদের আশঙ্কা এবার যদি ইলিশ না পাওয়া যায় এই গ্রামের অধিকাংশ পরিবারকেই অনাহারে মরতে হবে।
এপার ওপর দুই বাংলাতেই ইলিশ হলো মাছের রাজা। সে স্বাদেই হোক দামে। দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্রের এই মাছ জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে উপকূল সংলগ্ন মিঠে জলে ডিম পারতে আসে। ঝাঁকে ঝাঁকে। চীনের য়াংত্জে হোক বা ইনদাস এই মাছের মূল্য সব মত্সজীবীরাই জানেন। মাছের আড়তে বঙ্গোপসাগরের ইলিশের মূল্য সব থেকে বেশি। সে কারণেই মেঘনা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র থেকে পাওয়া ইলিশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে সমগ্র বাংলাদেশএ রূপোলি শস্য হিসেবে পরিচিত।
যদিও অত্যাধিক মত্সশিকার ইলিশের পোনা নষ্ট করছে। যে কারণে বাংলাদেশী সরকার মার্চ এপ্রিল মাসে মত্সশিকারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন করেছেন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৫ লক্ষ জেলে সমুদ্রে ইলিশ মাছ ধরার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। এই বছরে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে মাছ ধরার ওপরে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও জেলেরা মে মাস থেকেই চোরা-গোপ্তা সমুদ্রে যাচ্ছিল। যে কারণে দ্বিতীয়বার নিষেধাজ্ঞা চাপায় বাংলাদেশ সরকার।


সেই ২৩’শে জুলাই থেকে জেলেরা উপকূলীয় সমুদ্র-নদী মোহনা তোলপাড় করে ফেলছেন কিন্তু কালেভদ্রে একটা দুটো ছাড়া মাছের রাজার পাত্তাই নেই। এমন কী পদ্মা, মেঘনা বা তেঁতুলিয়া কোথাও ইলিশের দেখা নেই!
ইলিশের দাম স্বাভাবিক ভাবেই গগণচুম্বী। এমনকি যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো রপ্তানী হয়ে যাচ্ছে গাল্ফ দেশগুলি সহ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ আর অস্ট্রেলিয়াতে। আর পশ্চিমবঙ্গে ? পশ্চিমের নর্মদা থেকে পাওয়া ইলিশ বাজারে আসছে যা স্বাদে-গুণে বাংলাদেশের ইলিশের ধারে কাছেই নেই।
কিন্তু পশ্চিমা দেশ গুলিতে বেশি মূল্যে ইলিশের রপ্তানী হলেও বাংলাদেশী মত্সজীবীরা তাতে লাভবান হচ্ছেন না। কারণ এখনো তাদের সরকার নির্ধারিত আগের মূল্যেই ইলিশ বিক্রি করতে হচ্ছে।
এরকমই একজন মাঝি নুরুদ্দিনের বক্তব্য-” আমি এই মরশুমের শুরুতেই চড়া সুদে ঋণ নিয়ে নিজের নৌকা, জাল ঠিক করেছি, কিন্তু ইলিশ কোথায় যে আমি এই ঋণ শোধ করবো?” ধলচরের এই জেলে আরও বলে যে-” আমাদের কাছে ইলিশ রূপো রঙের নয়, সেগুলো সব সোনালী। আমাদের অকছে ইলিশের মূল্য সোনার থেকে কিছু কম নয়। ইলিশ না থাকলে আমরা অনাহারে মরবো।”
নুরুদ্দিনের মত এই জেলেরা প্রত্যেক মরশুমের শুরুতেই আঞ্চলিক ‘দাদন’দার কাছ থেকে চড়া সুদে বা এনজিও’র কাছে থেকে ঋণ নেন। কিন্তু এবারে তারা সেই ঋণ কিভাবে শোধ করবে সে চিন্তায় মগ্ন সকলেই।
কিন্তু ইলিশের দেখা না মেলার কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই মরশুমে অধিকাংশ ইলিশের শিকার সমুদ্রে হয়েছে। এছাড়া নদী মোহনা গুলির রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে সেখানে পলি জমে নদীর নাব্যতা কমেছে। ইলিশের জন্যে অন্তত ১২ মিটার গভীরতা প্রয়োজন। এই জন্যেই হয়তো ইলিশের ঝাঁক দিক পরিবর্তণ করেছে। এছাড়া বেড়ে চলা নদী দূষণ একটা বড় কারণ। বৃষ্টির জল সব ময়লা বয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। ইলিশের ডিম পাড়ার জন্যে পরিষ্কার জলের প্রয়োজন।


কিছু কিছু পর্যবেক্ষকদের মতে নদী বন্দরে অধিক পরিমাণে জাহাজ ঢোকার জন্যেই ইলিশের ঝাঁক আসছে না অন্য দিকে কিছু দোষারোপ করছে সরকারের অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ওপরে। এছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের নদীবাঁধ গুলোও মাছেদের জীবন যাপনে বাধা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রবীণ সমুদ্র আধিকারিক আনিসুর রহমান জানাচ্ছেন নদীর পলি আর দূষণ ই ইলিশ মাছের স্বল্পতার পেছনে মূল কারণ। তাঁর মতে যেই ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীর উচ্চ প্রবাহে ঢুকছে ততই দূষিত জল তাদের পেছনে সরে যেতে বলছে। যদিও বাংলাদেশী সরকার অনেক গুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তবুও তিনি আশাবাদী এই মরশুমের শেষে অর্থাত্ সেপ্টেম্বের মাসে ইলিশের চাহিদা কিছুটা হলেও মিটবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ইলিশ না পাওয়া গেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় জনসংখ্যার একটা বৃহত্তর অংশ অনাহারে মারা যাবে। কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়লেও একটি বাংলাদেশী জেলে পরিবারের ১০-১২,০০০ বাংলাদেশী টাকা খরচ হয় যেখানে তাদের আয় হয় ১০,০০০ টাকা। ফলত: ঋণের তলানিতে পৌঁছে যাচ্ছে এই মানুষ গুলো। এই ঋণের ফাঁদে পড়া মানুষ গুলোর না আছে অন্য আয়ের উপায় না আছে সঠিক শিক্ষা। একমাত্র নদীর ইলিশই পারে এদের বাঁচিয়ে রাখতে।