দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: গতকাল সল্টলেক এ জে ব্লকে’র একটি অভিজাত বাড়ির ছাড় থেকে উদ্ধার হয়েছিল কাপড়ে বাঁধা এক নর কঙ্কাল। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সহ বিধান নগরের পুলিশ বিষয়টি তদন্ত শুরু করতেই যা যা সামনে এল তাতে আপনার গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাবে! যে যুবকের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিলো তার নাম অর্জুন মাহেনসেরিয়া। আর তিনি এই মাহেনসরিয়া পরিবারের তিন সন্তানের বড় জন। বাকি দুই ভাই বোন বিদুর ও বৈদেহী ও এই খুনে জড়িত। গতকাল এই খুনের দায়ে অর্জুনের মা’ কে পুলিশ নিজের হেফাজতে নিয়েছে।
পুলিশি তদন্তে যা যা জন গিয়েছে তাতে প্রথমে ঘরের মশলা বাটার শিলনোড়া দিয়ে থেঁতলে খুন করা হয় অর্জুন কে। এরপর প্রমাণ লোপাট করতে ঘি ও কর্পূর মাখিয়ে মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আর ওই আধপোড়া দেহ তোয়ালেতে মুড়ে রেখে আসা হয় ছাদে। যাতে আধ পোড়া দেহ থেকে গন্ধ না বেরোয় সেই জন্যে পোড়া বা পচা গন্ধ ঠেকাতে আলাদা একটি কড়াইয়ে ঘি ও কর্পূর গরম করা হয়েছিল। এমনভাবে করা হয়েছিল যে যাতে প্রতিবেশীরা যাতে মনে করেন, বাড়িতে কোনও পুজো হচ্ছে।
বিধাননগরের এ জে ব্লকের বাড়ির ছাদ থেকে কঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনায় এই তথ্য সামনে আসতেই চমকে গিয়েছে পুলিশও। বাড়ির বড় ছেলে অর্জুন বেশ কিছুদিন তিনি নিখোঁজ ছিলেন। অর্জুনের বাবা এই মর্মে বিধান নগর থানায় ডায়েরি করলে পুলিশ এই বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। আর কাল বিধান নগরের ও বাড়ি থেকে কঙ্কাল উদ্ধার হওয়ার ঘটনায় বিধাননগর পুলিশ মৃত যুবকের মা গীতা ও ভাই বিদুরকে বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করেছে।
তবে পুলিশের অনুমান এই ঘটনায় মৃতের ছোট বোন বৈদেহীও জড়িত রয়েছে। তদন্তকারীরা ওই তরুণীর খোঁজ চলছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি তোয়ালে, কড়াই ও কর্পূর উদ্ধার হয়েছে। পাওয়া গিয়েছে দেহ পোড়ানোর প্রমাণও। কিন্তু প্রশ্ন নিজের মা কিভাবে বাকি ছেলে ও মেয়েকে সাথে নিয়ে বড় ছেলেকে খুন করতে পারলো! কি মোটিফ রয়েছে এই কেসে! তদন্তকারীদের মনে এই প্রশ্নগুলো উঠতেই ইতিহাস ঘেঁটে যা পাওয়া গিয়েছে তাতে এই সমস্যার মূল অনেক গভীরে।
আরও পড়ুন: সল্টলেকে বাড়ির ছাদ থেকে উদ্ধার ‘বাড়ির বড় ছেলে’র কঙ্কাল! সন্দেহের তীর ‘মা’য়ের তন্ত্র সাধনা!
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ এবং তাতে ছেলে-মেয়েদের জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। গতকাল ই অর্জুনের বাবা অনিল মাহেনসেরিয়ার জানিয়েছিলেন যে স্ত্রী গিটার সাথে দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য কলহ চলছে। দেড় বছর ধরেই আলাদা থাকেন অনিল। তবে অর্জুন মা, ভাই-বোনের সঙ্গে থাকলেও বাবার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মাঝেমধ্যে বাবার কাছে গিয়ে থাকতেনও। এছাড়াও পুলিশের কাছে তথ্য এসেছে যে, তন্ত্রে বিশ্বাস ছিল মাহেনসেরিয়া পরিবারের, বিশেষ করে গীতার। প্রায়ই একজন তান্ত্রিক আসতেন।
এই মামলাতে শুক্রবার ধৃত গীতা ও বিদুরকে বিধাননগর এসিজেএম আদালতে পেশ করা হলে তাদের ৫ দিন পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয়। এই মূহুর্তে তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ, খুন ও প্রমাণ লোপাটের মামলা দায়ের হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সরকারি আইনজীবী মহম্মদ সাবির আলি বলেন, পুলিশি জেরাতে গীতা, তার বড় ছেলে অর্জুনকে খুন করার কথা স্বীকার করেছেন। আর এই নৃশংস কাজে ছোট ছেলে ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বড় ছেলেকে খুন করে জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
তাদের এই তান্ত্রীক নিয়ে এসে যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কথা মাঝেমধ্যেই অর্জুন নাকি বাবাকে সব বলে দিয়ে তাদের ফাঁসানোর হুমকি দিতেন। এচহরও অন্য কোনও জটিল বিষয় ছিল কিনা যা নিয়ে অর্জুন ফাঁস করা হুমকি দিতেন; তা জানতে পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। তবে খুনে বিবরণে জানা গিয়েছে শিলনোড়া দিয়ে থেঁতলে খুন করার আগে কিছু খাইয়ে অচেতন করা হয়েছিল অর্জুনকে। অন্যদিকে ধৃতদের আইনজীবী আদালতে জানান, মা ও ছোট ছেলের মানসিক অসুস্থতা রয়েছে। শারীরিক পরীক্ষার আবেদন জানান তিনি। জানা গেছে, এর আগেও দাম্পত্য কলহের জেরে একবার গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন গীতা। এছাড়া স্বামী অনিল মাহেনসেরিয়ার বিরুদ্ধে বাগুইআটি থানায় অভিযোগও দায়ের করেছিলেন। তখন তাঁরা বাগুইআটিতে থাকতেন।
এছাড়াও আজ পুলিশি তদন্তে সামনে এসেছে যে , কয়েক বছর আগে অনিল মাহেনসেরিয়ার ব্যবসায় মন্দা চলায় একজন তান্ত্রিক আসেন তাঁর এজে ব্লকের ২২৬ নম্বর বাড়িতে। তন্ত্রসাধনা, যজ্ঞ হয়। তাতে নাকি ব্যবসার হালও ফেরে। কিন্তু এর পর থেকে নাকি বাড়িতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন এই তান্ত্রিক। গৃহকর্তার থেকে তান্ত্রিকের মতামত বেশি মানতে শুরু করে পরিবারের অন্যরা। এনিয়ে স্ত্রী গীতার সঙ্গে অনিলের অশান্তি আরও বড় আকার নেয়। গতবছরের আগস্ট মাসে অনিল এ জে ব্লকের বাড়ি ছেড়ে রাজারহাটের একটি আবাসনে থাকতে শুরু করেন।
অনিল মাহেনসারিয়ার একাধিক ব্যবসা। উড স্ট্রিটে অফিস। বাস্তু চর্চা ও তন্ত্র সাধনায় বিশ্বাসী এই পরিবার। প্রায়ই তাঁদের বাড়িতে পুজো, যজ্ঞ হত। বড় ছেলে অর্জুনের ব্যবসা ছিল, বাবার উড স্ট্রিটের অফিসেও সে যেত। বিদুর ও বৈদেহী পড়াশুনোর জন্য আমেরিকায় ছিলেন। আর্থিক কারণে ফিরিয়ে আনেন অনিল। এই নিয়ে ছোট ছেলে ও মেয়ের বাবার ওপর ক্ষোভ থাকতে পারে। অনিল গত ২৯ অক্টোবর তিনি জানতে পারেন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গীতা রাঁচিতে তাঁর মায়ের কাছে গিয়েছেন। ৩০ নভেম্বর তাঁর কাছে খবর আসে অর্জুন রাঁচিতে নেই। গীতা অবশ্য ফোনে স্বামীকে জানান দুই ছেলে ও মেয়ে তাঁর কাছেই আছে। এরপরও কয়েকদিন অর্জুনের কোনও খবর না পেয়ে বিধাননগর পূর্ব থানায় ডায়েরি করেন। পুলিশ জানতে পারে, রাঁচি থেকে কলকাতায় ফিরেছেন গীতা, অন্যত্র রয়েছেন। এদিকে বৃহস্পতিবার অনিল অভিযোগ করেন, তাঁর স্ত্রী সহযোগীদের নিয়ে অর্জুনকে অপহরণ করে খুন করতে পারে। এরপর সন্ধ্যায় গীতাকে সঙ্গে নিয়ে এজে ব্লকে ওই তালাবন্ধ বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। ছাদে মেলে কঙ্কাল। অর্জুনকে খুন করে বাড়িতে তালা লাগিয়ে গীতা বিদুর ও বৈদেহীকে নিয়ে রাঁচী চলে যান বলে অনুমান।