(এভারেস্ট শীর্ষে প্রথমবারের জন্য মোহন বাগান ক্লাবের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন । ক্লাবের সম্বর্ধনা পেলেও তাঁকে আজ ও দেওয়া হয়নি ক্লাবের সদস্যপদ। অবশ্য অভিযোগ নেই কারো বিরুদ্ধে। তাঁর গলায় শুধুই আক্ষেপ। তিনি এভারেস্ট জয়ী দেবরাজ দত্ত। )
স্কুল জীবনে বাবার পুরস্কার পাওয়া “পরাজিত এভারেস্ট ” বইটা হাতে পেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়া ছাত্রটির জীবনে ছন্দপতন ঘটালো। আপাদমস্তক মোহনবাগানী ছেলেটার স্বপ্ন দেখার সেই শুরু। তারপর আর থেমে থাকেনি সে। তখন কলেজের সেকেন্ড ইয়ার। পর্বত অভিযাত্রী সংঘের হাত ধরেই তার পাহাড়ে পথ চলা শুরু। শুশুনিয়াতে শৈলারোহনে হাতে খড়ি দিয়ে সে চলে গেল NIM এ (নেহেরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং)। সেখানেই শুরু হলো পাহাড়ে চড়ার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সে হয়ে উঠলো একজন দক্ষ পর্বতারোহী।
এভারেস্ট নাľমটা শুনলেই তার রক্তে ঢেউ খেলে যায়, শক্ত হয়ে ওঠে তার চোয়াল। কিন্তু এভারেস্ট তো আর কথার কথা নয়। চাইলেই তাকে পাওয়া এতটা সহজ নয়। বিজ্ঞান যতই উন্নত হোক শেরপারা যতই সাহায্য করুক , সেখানে প্রতিটা পদক্ষেপই মৃত্যু কে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। প্রতিটা পদক্ষেপেই লড়তে হয় বেঁচে থাকার জন্য। ওখানে নিশ্বাস নিতে হয় হিসাব করে। ডেথ জোনে অক্সিজেন শেষ হলে, শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করতে সময় লগে না। তাই লড়াইটা শুধু শরীরের নয় তার থেকে অনেক অনেক বেশি মনের। এভারেস্টে যাওয়ার আগে নিজের শরীরের সঙ্গে নিজের মনকেও গড়ে তুলতে হয় ইস্পাত কঠিন। ওখানে জীবন ঝুলে থাকে রোপ আর জুমারে , এগিয়ে চলতে হয় ক্রিভাস আর এভালাঞ্চ কে সঙ্গী করে।
তাই সে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে সকলের অলক্ষ্যে। একে একে নীলকণ্ঠ, ইন্দ্রসন , ত্রিশূলী পশ্চিম ,শিনকুন , মামোস্থং কাংরি ,সাসের কাংরির মতো পঁচিশটিরও বেশি সফল পর্বত অভিযানের সদস্য হিসাবে যোগদান করে । শুধু যোগদান করেই থেমে থাকেনি সে , নিজের যোগ্যতার ছাপ রেখেছে তার প্রত্যেকটা অভিযানে। এতগুলো সফল অভিযান করেও এভারেস্ট নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলনা তখনও। সালটা ২০১৩ এর ৩১ এ জুলাই তার নেতৃত্বে সিয়াচেনে অবিজিত শৃঙ্গ মাউন্ট প্লাটু জয় করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বসেই সে সিদ্ধান্ত নিলো পরের বছরই এভারেস্ট অভিযানে যাবে।
এতদিন ধরে নিজের মনে লালন করে চলা তার স্বপ্নকে সত্যি করতে আর পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থান থেকে এই বিশ্ব চরাচরকে দৃষ্টি গোচরের বাসনা, দেশ মাতৃকার পতাকা উত্তোলন আর নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় ক্লাব মোহন বাগানের পতাকা ওড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়ে যাওয়া এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে। কিন্তু বিধাতার কি পরিহাস ১৮ ই এপ্রিল ২০১৪ অভ্যালেঞ্জে কেড়ে নিলো ১৬ জন শেরপার প্রাণ। বন্ধ করে দেওয়া হলো দক্ষিণ গাত্র দিয়ে এভারেস্ট অভিযান। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসতে হলো কলকাতায়। সে বছর নেপাল সরকার পার্মিট এক্সটেন্ড করলো।
২০১৫ এভারেস্ট যাত্রার আরও একটা অভিশপ্ত বছর। সেদিন ২৪ শে এপ্রিল বেস ক্যাম্পে এক ভয়াবহ অভ্যালেঞ্জ প্রাণ নিয়ে গেল শেরপা সহ ১৯ জন মানুষের। চোখের সামনে এমন ভয়াবহ দৃশ্য আজও ভুলতে পারিনি সে। বেস ক্যাম্প থেকে ফিরে না এসে সে হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লেগে পড়লো উদ্ধার কাজে। আবার ফিরে আসা কলকাতায়। নেপাল সরকার আবারও পার্মিট এক্সটেন্ড করলো।
বার বার তিনবার। অনেক হতাশা আর আগের দুবার প্রকৃতির রোষানলে পড়ে অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়া তার তৃতীয়বারের অভিযান বন্ধ করতে পারেনি। একজন পর্বতারোহী কখনো নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। অনেক সংগঠন ও অনেক সহৃদয় মানুষের উৎসাহ আর প্রেরণা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে তৃতীয়বার অভিযানে। বিগত দুবারের সমস্ত ব্যর্থতাকে মুছে ফেলে অদম্য সাহসকে সঙ্গী করে আবার অভিযান শুরু হয়। বছরের পর বছর ধরে পর্বতারোহীরা নিজেদের কে প্রস্তুত করে নিজের স্বপ্নের শিখরে আরোহন করার জন্য। একজন পর্বতারোহীর উদ্দেশ্য শুধু মাত্র শৃঙ্গ জয় করা নয় বরং তার চলার প্রতিটা পদক্ষেপে নিজের আত্মা কে সে অনুভব করে।
গত দু বছরে এভারেস্টের যাত্রা পথ অনেকটাই বদলে গেছে। বিশেষ করে ভূমিকম্পের পর খুম্বু আইস ফল নিজের রূপ বদলে ফেলেছে অনেকটাই। শেরপা দল দুবছরের পরে শীর্ষে পা রাখার জন্য পথটি খুলেছিল। এজেন্সির আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী 18 থেকে 20 মে মধ্যে একটি পরিষ্কার ক্লাইম্বিং উইন্ডো ছিল। সেই মতো ১৯ শে মে সকালে সামিটের পরিকল্পনা করে ১৫ ই মে রাত্রে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প থেকে শৃঙ্গ আরোহণের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করে । ৩৫০০ মিটার অতিক্রম করে আগামী চার পাঁচ দিনের মধ্যে সামিট করতে হবে। প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘন্টারও বেশি সময় আরোহন। , সঙ্গে ১২-১৪ কেজি ভারী রুক নিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ এর কম বায়ুচাপের একটি অঞ্চলে পাড়ি দেওয়া,যেখানে ৭৫০০ মিটারের পরে শুরু হয় ডেথ জোন সেখানে নিঃশ্বাস নিতে ব্যাবহার করতে হয় বোতল এ ভরা অক্সিজেন। ওখানে তাপমাত্রা মাইনাস 20 সেন্টিগ্রেট থেকে মাইনাস 30 সেন্টিগ্রেট এবং বায়ুর গতিবেগ ঘন্টায় ১০-১৫ কিলোমিটার এবং যা কখনো কখনো ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি হতে পারে।
১৫ ই মে রাত্রি যখন দুটো বাজে তখন অভিযান শুরু হয় খুম্বু আইসফল ক্রস করে বেলা তিনটায় ক্যাম্প ২ তে পৌঁছায়। ১৬ তারিখ সেখানে পুরোদমে প্রাকটিস চলে । ১৭ই মে ক্যাম্প ছাড়ার পরেই পড়তে হয়েছে তুষার ঝড় এর মধ্যে। সেই প্রবল হাওয়ার ঝাপটায় প্রায় ১৫ মিটার ছিটকে গিয়ে পড়ে এক জার্মান অভিযাত্রীতো প্রায় তার ঘাড়ের উপর এসেই পরে। কোনো ক্রমে সে যাত্রায় রক্ষা পায় তারা। হাওয়া থামলে প্রায় ৯ ঘন্টার প্রচেষ্টায় ক্যাম্প থ্রিতে পৌঁছায়। এগিয়ে যাওয়ার আগে আবহাওয়া স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ১৮ তারিখ সকালে বাতাস শান্ত হতে শুরু করে। ভোর পাঁচটায় সামিট ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হবার কথা থাকলেও অবশেষে আবহাওয়া ঠিক হলে সকাল সাতটার সময়
ক্যাম্প থ্রি থেকে শুরু করে দুপুর আড়াইটেতে সামিট ক্যাম্পে পৌঁছে যায়।
রাত সাড়ে নটায় সামিট মার্চ শুরু হয়। এটাই ছিল তার কাছে শেষ সুযোগ। এতদিন ধরে যেসব স্থানের কথা গল্পের মতো ছিল তা একে একে আসতে লাগলো চোখের সামনে ট্রিয়াঙ্গুলার ফেস, ব্যালকনি , সাউথ সামিট , হিলারি স্টেপ। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিলো না তার। দুদিন আগেও পূর্ণিমার চাঁদ ছিল আকাশে সেই আলোর রেশ এখনো রয়ে গেছে। সেই আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে এই বিশ্ব চরাচর। প্রতিটা পদক্ষেই তাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তার স্বপ্ন শিখরের আরো কাছে। স্বপ্ন আর বাস্তব এক হয়ে গেছে আজ। যখন স্বপ্নের শিখরে পৌছালো ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল দশটা চল্লিশ। একে একে উত্তোলিত করলো তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা , প্রিয় ক্লাব মোহন বাগানের পতাকা, কলকাতা কর্পোরেশনের পতাকা এবং স্পনসরদের পতাকা। স্বপ্ন শিখরে চললো ত্রিশ মিনিটের একটি স্বপ্নের এপিসোড।
“পরাজিত এভারেষ্ট “বইটা কার লেখা ও পাবলিশার্সের নাম জানালে বাধিত হবো।