25 C
Kolkata
Thursday, March 23, 2023
More

    দলে নয়, মার্ক্সবাদে আছি, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ করি বুদ্ধদেবকে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় – দেবারুণ রায়

    ২০০৪য়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেদিন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদ্মভূষণ সম্মান গ্রহণ করলেন, সেদিনই সন্ধ্যায় রাজধানীর অশোক হোটেলের স্যুটে ওঁকে ফোন করি। ওঁকে পাওয়ার জন্য কোনও ঘাট পেরনোর দরকার হত না। এরকম শুধু উনি নন। জীবনের বিশেষ কিছু বোধে আস্থাশীল প্রথম সারির সেলিব্রিটিদের মধ্যে একেবারে শীর্ষে যে ক’জন, বিশেষ করে তাঁরাই অনধিগম্য নন। এই স্তরের অভিনেতাদের মধ্যে যেমন ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তেমনি ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় এবং তেমনি আছেন শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দিলিপ কুমার। সৌমিত্রবাবুকে তবু একবেলা আগে ফোন করে সময় নিয়েছিলাম।  আর দিলিপ সাবকে তাও নয়। একেবারে সটান হোটেলের খোলা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সাক্ষাৎকার চাওয়া। এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত মহানায়কের কাছে তৎক্ষণাৎ সময়  পাওয়া। সৌমিত্র বাবু দিলিপ সাবের  চাইতে এক দশকেরও বেশি ছোট হলেও  ঘরানা ভিন্ন নয়। একই ধরণের অন্তর্গত বোধে বিশ্বাসী ছিলেন তিনিও।

    ১৬ বছর আগের সেই স্মরণীয় সন্ধ্যার ফোনে পদ্মভূষণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বললেন, ” কাল বিকেলের ফ্লাইটেই ফিরে যাব। আপনি সকাল দশটার মধ্যে চলে আসুন। ” তার আগে ওঁকে সামনাসামনি দেখলেও কখনও কথা বলার সুযোগ হয়নি। দেখেছি প্রথম “পথের পাঁচালী”-র রজত জয়ন্তীর বছরে গ্লোব সিনেমার একটা শো-তে। সেখানে সম্ভবত দেখানো হচ্ছিল অপু ট্রিলজি। কোনও বিশেষ অতিথির আসনে নয়। অপু বসেছিলেন হলের মাঝামাঝি রিয়ার স্টলের একটা রোয়ের কোনের চেয়ারটিতে। ছবি চলাকালীন অন্ধকার হলের ভেতর আম দর্শকদের মধ্যে কখন যে এসে বসে পড়েছেন !! কেউ পেছন ফিরে বা পাশে তাকিয়েও দেখেননি। বিনা নোটিশে কখন এসে বসেছেন অপু। যখন বিরতির আলো জ্বলে উঠলো তখন দেখা গেল অপুকে।

    টিকিটের দাম উসুল করা সেই ইভনিং শোতেই তাঁকে সামনাসামনি  প্রথম দেখা। তখন তিনি খ্যাতির মেঘমালার মাঝে মধ্যগগনের আলো। ভালো করে দেখা কথা কিছুই হয়নি তখনও। সেটা ১৯৮০। বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমারের বিদায়ের বছর। তারও প্রায় আড়াই দশক পরে সৌমিত্র পদ্মভূষণ পেলেন। আরও তের বছর পরে ফরাসী দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক পুরস্কার লিজিয়ঁ দ্য নর ( লিজিয়ন অফ অনার )। এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাংলার স্বর্ণযুগের ডাকসাইটে নায়িকাদের বর্ণনায় দেবদূত নায়ক কিন্তু প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙেচুড়ে বদলেছেন। পর্দার কল্পজীবন থেকে বাস্তব গল্পের নায়ক হয়ে উঠেছেন তিল তিল  করে। নিজের সেই সামগ্রিক নির্মাণ উত্তম বাংলার রূপোলি পর্দা আর রঙ্গালয়ের জগতে অনন্য। সমান্তরাল অন্তরালে তাঁর আগে পদচিহ্ন রেখে গেছেন শুধু উৎপল  দত্ত।

    ফিরি ২০০৪-এর সেই সকালে। অশোক হোটেলের ভিআইপি সেলিব্রিটি স্যুটে। তৈরিই ছিলেন সৌমিত্র। কিছু পড়ছিলেন। বেশ  গুছিয়ে বসলেন আড্ডার মতো করে। মোটেই পোশাকি ইন্টারভিউয়ের কেতা বা কাঠিন্য না রেখে।  ঠিক একের পর এক ইট গেঁথে চলার মতো। আমি প্রশ্ন রেখে যাই প্রসঙ্গ ধরিয়ে দেওয়ার ধাঁচে। তাতে কোনও খোঁচ নেই।  খোঁজ আছে । বাংলা সিনেমার উত্তম পুরুষকে ছোটভাই ও উত্তর পুরুষ  অনেক আগেই কালপুরুষ বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গে  পাদপূরণ নিখুঁতভাবে করে যাচ্ছিলেন। অধম নন বলেই উত্তমের গুণগ্রাহী ছিলেন প্রতি কথায়। গ্ল্যামার নিয়ে মহানায়কের উপদেশ অকাট্য ছিল। কিন্তু সৌমিত্র সেটা কখনোই মেনে চলেননি। আম জনতার সঙ্গে আরোপিত দূরত্ব গড়ে তোলেননি সচেতন ভাবেই। উত্তম তাঁর শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন।  কিন্তু তিনি কখনও উত্তম হওয়ার কষ্টকল্পনায় নিজেকে অধম হতে দেননি।

    নিজের মতোই নিজে হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। তাই উত্তমের যা ছিল তা যেমন তাঁর মধ্যে ছিল না, তেমনি তাঁর অপূর্ব প্রেম কখনও বাঙালির সর্বকালের সেরা ম্যাটিনি আইডলের সমান্তরাল উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে অন্যতর প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। জীবনের, জীবিকার্জনের  ছেঁড়া পাতাগুলো জুড়ে যেতে যেতে মননের মণিমুক্ত রেখে যাচ্ছিলেন। যা বাণিজ্যিকভাবেও চূড়ান্ত সফল কোনও অভিনেতার কাছে দুর্লভ। একেবারে অমূল্যরতন। কথায় কথায়   যখন মন্তব্যের মুহূর্ত এল, তখন নায়ক আরও মূখর। মোটেই রক্ষণশীল নন। সুচিত্রা সেনের মতো অভিনেত্রী হতে পেরেছেন আর  কেউ ? এই সাজেস্টিভ প্রশ্নটা এল ওঁরই বলা কথার সূত্র থেকে।  জিজ্ঞেস করতেই  গলার স্বরে প্রখর রংমশাল।  বললেন, “এক পাড়ায় থাকলে চিঠি দিতাম। কিন্তু অভিনয়ের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে আপত্তি আছে। সাবিত্রী অনেক বড় অভিনেত্রী। “মানে সৌন্দর্য বিচারে সুচিত্রা সেনের মতো অভিনেত্রী আর নেই।  কিন্তু অভিনয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ নন। এই বিতর্কের বিষয় নিয়ে অনেক ঝড় উঠেছে । বিষয়টি সেদিন ছিল আনকোরা স্রোত। আজ পলি জমতে জমতে চর পড়ে গেছে।

    মঞ্চ, জীবন, পর্দা ও পরিবেশ, সংসার ও সংকল্প নিয়ে প্রায় দুঘন্টা। অনন্ত ক্ষুধা নিয়ে তৃষ্ণার্ত চাতক আমি শুনেছি ওই উচ্চতা থেকে থেকে নীল ধারায় নেমে আসা নায়েগ্রার প্রপাতের শব্দ। সেইসব শব্দের সহস্রধারা রণিত ধ্বনিত এবং প্রাণিত করে চলেছে। সব প্রশ্ন যখন শেষ তখন একটি জিজ্ঞাসা তাঁকে জানাই। আঁচ করা যায় এ প্রশ্নের উত্তর দিলেও তা লিখতে মানা করবেন। যেমন বিভিন্ন পেশার সেলিব্রিটিরাই বলে থাকেন, “এটা বলছি , কিন্তু আমার জীবদ্দশায় প্রকাশ হোক চাই না।” আবার অনেকে সরাসরি একথা না বললেও কথা অনুযায়ীই বুঝে নিতে হয়। সেটাই সাংবাদিক বা লেখকের বোধ ও সৌজন্য। কেউ সারা জীবনে একবার বাজার করে। বাকি জীবন বাজারে ঢোকা হয় না।

    সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রশ্নটি ছিল রাজনীতি নিয়ে। “আপনি বামপন্থী হিসেবেই পরিচিত আগাগোড়া। আপনার কাজে, কথায়, সঙ্গ ও সংগঠনে তার ছায়া। কিন্তু  নির্দিষ্ট কোনও দলের মতবাদে কি আপনি আকৃষ্ট ও দায়বদ্ধ ? ” সমাজ রাজনীতি বাংলার শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নিয়ে আগেই বলেছেন গত দুঘণ্টায়। এখন বললেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। তারপর এই ষোল বছরে যার নানা ভগ্নাংশ নানা প্রসঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু  সেদিন ২০০৪ এর সেই সকালে ছিল অনুক্ত। বললেন, “আমি মৌলিক মার্ক্সবাদে বিশ্বাস করি। কিন্তু কোনও দল করিনা।  সিপিএম মার্ক্সবাদী। কিন্তু ওদের সঙ্গে সব বিষয়ে আমি একমত পোষণ করি না। হ্যাঁ বুদ্ধর প্রতি আমি দুর্বল। ওঁকে আমি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ করি।” আমৃত্যু এই মাত্রা আর ছন্দ নিয়ে চলেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।  অপুর অপার বিস্ময় আর অন্তর্গত বোধ নিয়ে জীবন সায়াহ্নে এসেও বন্ধুদের আড্ডায় দরাজ গলায় বাউল গেয়েছেন। ” চল্লিশ সেরে মিলবে পুরা মণ, প্রেম কইরো না….।”

    হ্যাঁ বুদ্ধর প্রতি আমি দুর্বল। ওঁকে আমি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ করি।

    শিল্প শুধু শিল্পের জন্য, এই তত্ত্বে তাঁর তীব্র অনাস্থা ছিল। গ্ল্যামার তপস্বী হতে চাননি। ছিলেন প্রাণতপস্যায়। নাহলে এত বিচ্ছুরণ প্রতিভাত ! এই তো প্রতিভার শীল উষ্ণ প্রস্রবণ। নন্দীগ্রামের অপ্রিয় প্রসঙ্গে যখন নন্দীভৃঙ্গী হরির লুটের বাতাসা ছড়াতে ব্যস্ত, যখন বাঘমার্কা বামকবি, দোদুল্যমান ছবি, সবই রামধনু মিছিলে, সজাগ হিসেবি হয়ে হেঁটেছেন, তখনও শিল্পের লক্ষ্য বাংলায় মরুবিজয়ের কেতন হাতে সৌমিত্র, দ্বিধা দ্বন্দ্বহীন। জীবনের কঠিন সংগ্রামে রক্তক্ষরণে , ঘামে শ্রমে উচ্চগ্রামেই কাটিয়েছেন সংকটে সন্তাপে সত্যে একাকার হয়ে। জীবনের পুঁজি রবীন্দ্রনাথ যাঁর হৃদকমলে। ইদানিং এই পরবাস বড় বিঁধছিল। মন খারাপের দিনে কি মনে হত, এ পরবাসে রবে কে ?

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    সরে গেল ‘এটিকে’ , পরের মরশুমে ঝড় তুলতে আসছে ‘মোহনবাগান সুপার জায়ান্টস’

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে বড় ঘোষণা করলেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কা। মোহনবাগানের নামের শুরু থেকে সরে গেল...

    ভারতসেরা ‘মোহনবাগান’ ! বাঙালির গর্বের দিন

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : চাপ বনাম পাল্টা চাপ। পেনাল্টি বনাম পাল্টা পেনাল্টি। অফুরান দৌড় আর স্কিলের ফুলঝুরি দেখাতে...

    ISL চ্যাম্পিয়ন এটিকে মোহনবাগান

    দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : আই এস এল ফাইনালে রুদ্ধশ্বাস জয় ছিনিয়ে নিলো এটিকে মোহনবাগান । বেঙ্গালুরু এফসিকে টাইব্রেকারে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো...

    বাড়িতে আনুন বেশকিছু হোমিওপ্যাথি ঔষধ , পাবেন বহু সমস্যা মুক্তি

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : হোমিওপ্যাথি এক পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতি। আয়ুর্বেদের সঙ্গেও এই চিকিৎসা পদ্ধতির বেশ কিছু মিল...

    বড় বড় মার্কিন ব্যাংকের পতন ! আসছে মহামন্দা ?

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার ব্যাঙ্ক – পর পর দুই বড় মাপের মার্কিন ব্যাঙ্কের...