দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো: বঙ্গে বনেদিদের মধ্যে কথিত যে যাঁরা দুর্গাপুজো করতে অসমর্থ, তাঁরাই করেন জগদ্ধাত্রীর পূজা! সত্যি ই কী তাই আর কেনই বা দুর্গা পূজার পরে হয় জগদ্ধাত্রী পূজা! আসুন পুরাণপথে ও ইতিহাস ঘেঁটে জেনে নেওয়া যাক সে বিষয়ে।
‘জয় সর্বগত দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোহস্তুতে’! জগদ্ধাত্রীও নয়, দুর্গাও নয়, দুইয়ে মিলেই দেবীর স্বরূপে প্রকাশ। তাহলে প্রণাম মন্ত্রেই প্রকাশিত যে জগদ্ধাত্রী দেবী দুর্গারই বিকল্প রূপমহিমা। এবার জেনে নেওয়া যাক পুরাণ আদতে কী বলছে- দেবীর ধ্যানমন্ত্র অনুসরণ করে দেখলে বুঝবেন – এই মহাদেবী জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলঙ্কারে ভূষিতা ও নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী। দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু, দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র ও পঞ্চবাণ। রক্তবস্ত্রপরিহিতা সেই ভবসুন্দরী প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা। নারদাদি মুনিগণ তাঁর নিত্যসেবা করে থাকেন-
“সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্
চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্
চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে
রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।”
তাহলে দুর্গার সঙ্গে সংযোগস্থলটি রূপবর্ণনাতে রয়েছে! মন্ত্রের সূত্র ধরে খুঁজতে গেলে জগদ্ধাত্রীস্তোত্র সমূহ পড়ুন। সেখানে তিন নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে-
“জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে
জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে।”
তবে পুরাণ মতে, মহিষাসুর বধের পর দেবতারা উল্লাস করছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, দুর্গা যেহেতু তাঁদেরই সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ, তাই অসুর বধ হয়েছে তাঁদেরই যুগ্ম শক্তিতে। ব্রহ্মার বরের সম্মানরক্ষা করতে কেবল ওই নারীদেহটির আবশ্যিকতা ছিল। তাঁদের ওই গর্ব দেখে পরমেশ্বরী দেবী একটি তৃণখণ্ড অলক্ষ থেকে নিক্ষেপ করলেন দেবতাদের দিকে। পরীক্ষা করতে চাইলেন তাঁদের শক্তি। ইন্দ্র বজ্রদ্বারা সেই তৃণটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেন। অগ্নি সেই তৃণ দহন করতে পারলেন না, বায়ু অসমর্থ হলেন তা উড়িয়ে নিয়ে যেতে। বরুণের শক্তি সেই তৃণটুকুর একটি অংশও জলস্রোতে প্লাবিত করতে পারল না।
দেবতাদের এই দুরবস্থা দেখে তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হল এক পরমাসুন্দরী সালঙ্কারা চতুর্ভুজা মূর্তি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ইনিই হলেন জগদ্ধাত্রী। দেবী নিজে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন ও বুঝিয়ে দিলেন যে তিনিই এই জগতের ধারিণী শক্তি।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই একই গল্প উপনিষদ এবং কাত্যায়নীতন্ত্রেও রয়েছে। তবে তফাত এই টুকু উপনিষদে দেবী প্রথমে এক যক্ষের বেশে দর্শন দিয়েছিলেন। আর স্বরূপে আবির্ভূতা হওয়ার পর দেবীর নাম জানা গিয়েছিল উমা হৈমবতী। যদিও মহিষাসুর বধের কোনও প্রসঙ্গ সেখানে নেই। আবার, যদি কাত্যায়নী তন্ত্রে দেখেন তাহলে দেখবেন উমা বা জগদ্ধাত্রী- কোনও নামটিই সেখানে নেই। সেখানে দেবী কেবল হৈমবতী অর্থাৎ স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা। এর থেকে এই প্রমাণ হয় যে এই উমা নামটির সূত্র ধরেই উপনিষদের গল্পটি গৃহীত হয়েছে তুলনামূলক যুবা পুরাণগুলিতে। আর জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের দুর্গা নামটির সূত্রে এল ওই মহিষাসুর বধের প্রসঙ্গ।
তবে এখনো স্পষ্ট নয় যে জগদ্ধাত্রী দুর্গারই বিকল্প রূপ কিনা। কেন না, যে দেবী দেবতাদের গর্ব খর্ব করার জন্য রূপধারণ করলেন, উপনিষদ তাঁকে আদিশক্তিরূপেই ব্যাখ্যা করছে। পুরাণেও দুর্গার আবির্ভাবের আগে বেশ কয়েকবার এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে যিনি বিষ্ণুমায়া বা বৈষ্ণবী শক্তি হিসেবেই সুপরিচিতা। বিষ্ণুর মতো জগদ্ধাত্রীর হাতেও রয়েছে শঙ্খ এবং চক্র, অতএব এই দেবীর বিষ্ণুমায়া হওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। আবার, বিষ্ণুর মতোই তিনিও ধারণ ও পালন করেন এই বিশ্ব। তাহলে ঠিক কবে থেকে বোঝা গেল এই বিষয়টি!


দুর্গারই বিকল্প রূপ জগদ্ধাত্রী, তার প্রথম সুস্পষ্ট উল্লেখ শ্রীশ্রীচণ্ডীতে। সেখানে বলা হয়েছে, যুদ্ধের সময় মত্ত মহিষাসুর নানা মায়ারূপ ধরে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন দেবীকে। একবার সেই প্রচেষ্টায় মহিষাসুর ধারণ করেন হস্তীরূপ। সেই হস্তী দেবীকে বধের চেষ্টা করলে দুর্গা ধারণ করেন এক চতুর্ভুজা মূর্তি। চক্রদ্বারা তিনি ছেদন করেন হাতির শুঁড়টি। সেই রূপটিই জগদ্ধাত্রীর।
সেই জন্যই ধ্যানমন্ত্রে কোথাও উল্লেখ না থাকলেও মূর্তিতত্ত্বে দেখা গিয়েছে যে, জগদ্ধাত্রী বাহন সিংহ এক হস্তীর মৃত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে। কখনও বা সেই সিংহ খেলা করে হস্তীর কাটা মাথা নিয়ে। সংস্কৃতে হাতির একটি নাম করী, সেই অনুসারে অসুরটির নাম করীন্দ্রাসুর। তাকে বধ করেন বলে জগদ্ধাত্রীর অপর নাম করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী।
দুর্গার এই বিকল্প রূপে জগদ্ধাত্রীর আরাধনা কালে কালে জনপ্রিয় হয়েছে এই বাংলাতে। তবে এর জন্যে সমস্থ কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র’র। কারণ ইতিহাসের দিকে মুখ ফেরালে দেখবেন দুর্গাপূজা করতে অসমর্থ হয়ে বিকল্পে জগদ্ধাত্রী আরাধনা বঙ্গে তিনিই প্রথম প্রচলন করছেন। ইতিহাস অনুযায়ী, তখন বঙ্গের শাসনে নবাব আলিবর্দি খাঁ। তাঁর রাজত্বকালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করা হয়। কৃষ্ণচন্দ্র তা দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদে। অবশেষে কুটনৈতিকভাবে ছাড়া পেয়ে রাজা যখন নদিপথে কৃষ্ণনগরে ফিরছেন, শুনতে পেলেন দূর্গাপুজোর বিসর্জনের বাজনা।
বিসর্জনের বাজনা শুনে ভারাক্রান্ত হল রাজার মন। বারে বারে তাঁর মনে হতে থাকলো এ বছর আর দুর্গাপুজো করা হয়ে উঠল না! জনশ্রুতি, সেই রাতেই রাজাকে স্বপ্নে দর্শন দেন দেবী জগদ্ধাত্রী। রাজাকে পূজার নির্দেশ দেন যা আদতে দুর্গাপূজারই সমতুল! অবশেষে সেই ১৭৬৬ সাল থেকে কৃষ্ণনগরে দুর্গাপুজোর বিকল্পর হিসেবে প্রচলিত হল জগদ্ধাত্রীর পূজা। আর ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ল বঙ্গের প্রতিটি কোনায় কোনায়।