দিদির নির্দেশ ছিল, তৃণমূলের সবাইকে ত্যাগ করে প্রমাণ করতে হবে তারা অন্যদের মতো নয়। স্বতন্ত্র সংস্কৃতি তৃণমূলের। সুতরাং নেত্রীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন ইদানিং বাগী বা বিদ্রোহী মোডে সক্রিয় শুভেন্দু অধিকারী। খানকতক মন্ত্রকের মন্ত্রী ও গুটিকয়েক পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং খান পাঁচেক জেলার পর্যবেক্ষণ বা সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। তৃণমূলের মূল পীঠস্থান নন্দীগ্রামের এমএলএ পদটি ছাড়া আর সবই ত্যাগ করেছেন। পদে তো বটেই, বিপদেও এটা পরিষ্কার যে তিনি ” ছাগলের তৃতীয় সন্তান ” কোনও কালেই নন। তাঁর দলের দুর্মুখ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা যতই ভেংচি কাটুন। লাভের মধ্যে লাভ হল, পরিবর্তনের এপিসেন্টার মেদিনীপুরে বেশ বড়সড় একটা ফাটল পেল বিরোধী রাজনীতি। যে ফাটলে খাল কেটে কুমির ঢোকার পথ করে দেওয়া হল।


ইতিহাস এমনই পরিহাসপ্রিয় যে আসলে দলে বা শাসনে যারা অজ থেকে অজগর হতে চায় তাদের চাপেই শুভেন্দু প্রান্তিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বড় হয়েছেন তো তৃণমূলের ৯৯% নেতাই। একা শুভেন্দু কেন ? তবে শুভেন্দুর চাল চুলো দুইই ছিল। মমতা তাঁর মাথায় রেখেছেন বাংলার বামবিরোধী শক্তির জোরালো প্রতীক হিসেবে তাঁর ডান হাতে আঁকা জোড়া ফুল। এটা স্বাভাবিক, যে বাম বিরোধিতার সেই উর্বর জমিতে গজানো চারা গাছটি মেরুকরণের খরায় শুকিয়ে মরার আগে সেই উর্বর ভূমি খুঁজবে। সেই ভূমিতেই তার ভূমিকা হবে দুরন্ত। কারণ, তার সিলেবাসের পুরনো পড়া মুখস্থ করা আছে। সিলেবাস বদলে এখন সিপিএমের জায়গায় বিজেপি করলে হবে ? তার ওপর আছে আয়ারাম মানে কেনারামদের কসরত। সব দলে, সংগঠনে, সংস্থাতেই পরজীবী পরগাছা থাকে। স্বভাবতই সেই অকেজো-রা কেজোদের কোণঠাসা করার মতো সুযোগ খোঁজে। একটা যোগ এলেই সেটিকে সুযোগ করে নেয়। সম্প্রতি তৃণমূলের এক দুর্মুখ নেতাকে দিয়ে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী যেভাবে অধিকারী পরিবারকে ও শুভেন্দুকে তুলোধোনা করেছে সেরকম ঘটনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কখনও ঘটেনি তাঁর কংগ্রেস ছাড়ার প্রাক্কালেও।
তাছাড়া রাজ্য নেতারা কোণঠাসা করতে চাইলেও শীর্ষ নেতারা তা হতে দেননি। কলকাতায় ভাঙনের মুখেও এআইসিসির অধিবেশনে চাচা কেশরীর ” বেটি বেটি ” কর আকুলিবিকুলি সবার মনে আছে। শেষ পর্যন্ত মমতার গতিপথের পদাঙ্ক শুভেন্দু অনুসরণ করবেন কিনা অদূর ভবিষ্যত বলবে। তবে তৃণমূলে শুভেন্দুবধ কাব্যের প্রথম অঙ্কে নেতৃত্ব নয়, সুযোগসন্ধানীরা সফল। শুভেন্দুর ত্যাগের ইচ্ছা ধনকরের করকমলে পৌঁছলে মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর চেয়ারের মর্যাদা রক্ষায় তা গ্রহণ করতেই হয়। তার আগে সৌগত রায়ের পরামর্শ গতস্য শোচনা বলে ধরেছেন নন্দীগ্রামের নেতা।


সৌগত রায়ের কথাতেই স্পষ্ট আঁচ মেলে যে খোদ নেত্রীর কথাতেই তিনি শুভেন্দুকে বাগে আনছিলেন। যে কাজের ভার শিশিরবাবুকে না দিয়ে দলের সাংগঠনিক কাজে সাধারণভাবে অনাহূত সৌগতকে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ দিদি কখনোই চাননি শুভেন্দু মন্ত্রীত্ব ছাড়ুন এবং তৃণভূমিতে গোচারণ হোক। এখানে কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোখার তাগিদের চেয়েও বড় উদ্বেগ তৃণমূলের মূল ভূখণ্ডে ভোটের বাঁটোয়ারা। এলোমেলো করে দে মা। এটুকু হলেই বা কম কী। ভারতমাতা কি জিন্দাবাদ ধ্বনিতে গরিব মানুষ না বুঝলেও যাদের যাদের বোঝানোর জন্য বলা তারা সবাই বুঝেছেন। মেরুর দুদিকেই। নাহলে যাদের ঘর ভেঙেছে, মুর্শিদাবাদে মালদায় কিংবা ঝাড়গ্রামে বা বাঁকুড়ায়, মানে আগাগোড়া বাংলায়, দল ছেড়েও বিধায়কের পরিচিতি পুরনো থেকেছে, তাঁরা তো সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন নি। অধীর বা সূর্যবাবুরা অল্প কথায় কর্মফলের কথাটা শুধু বলেছেন। এবং আরও একবার প্রমাণ হয়েছে যে সবাই খগেন মুর্মু বা মানস ভুইয়াঁ নন। অন্তত বড় নেতাদের মধ্যে ওই ছোঁয়াচ টা লাগেনি। ভাইরাস যতই তীব্র হোক, সামাজিক দূরত্ব তার মোক্ষম দাওয়াই।
নাহলে অধীর চৌধুরী কী না হতে পারতেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের দায়িত্ব নিতেন। বাংলার সভাপতির পদ সেখানে অমূলক। আর মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য যারা পদপ্রান্তে পড়ে আছেন, তাঁদের হাল কস্মিনকালেও হতনা। এতদিনে প্রজেকশন সারা হয়ে যেত। যে শীর্ষ নেতা এমন ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যাঁর বিকল্প নেই বিজেপিতে। সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং দলের ভেতরে বাইরে লড়াকু ও সেকুলার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে চলার কারণেই ব্যক্তিগত পরিচিতি। সে সুযোগ শুভেন্দুর নেই। তাঁকে মুকুলকে মুরুব্বি পেয়েই অকুলে সাঁতরাতে হবে। আর দেখার কথা একটাই। জনভিত্তিশালী সব নেতাকেই সব দলে সর্বকালে বেগ পেতে হয়। সুভাষ বসু থেকে জ্যোতি বসু, মমতা থেকে অধীর কেউ ছাড় পাননি। সুতরাং আজ নিতান্তই নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে একটি ঘাসফুলকে ফুটে ওঠার পীড়া তো পোহাতে হবেই। পদচিহ্ন তো সামনে অনেক পাবেন। তার মধ্যে যে পায়ের ছাপের ওপর এখনও হেমন্তের শিশিরমাখা সুগন্ধ ফুটে আছে সেটাও পথ , আবার অন্য কোনও পদচিহ্ন , যা অকালেই মুছে গিয়েছে বহু পদের ছদ্ম পদ্মবনের পথে। এখন কোন পথে যাবে নন্দীগ্রাম ? মেদিনীপুরের ছেলে কোন পদচিহ্ন দেখে পা ফেলবেন ? পথ তো দুটোই। হয় ক্ষুদিরাম নতুবা নাথুরাম।