এবার ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ও বর্তমান বোর্ড সভাপতি সৌরভকে রাজনীতিতে টেনে আনার ছক কষছে বিজেপি। কষছে না বলে, বলা ভালো, মাস ছ’য়েক কি একবছর আগে ছকে নেওয়া চিত্রনাট্যের অদলবদল করছে। শিগগিরই ওপর্ব শেষ হলে গর্ব করার মতো মশলা মিলবে ভোটারদের মধ্যে ফ্লোটার বঙ্গবাসীর। আর, সেই লক্ষ্যেই বাজিমাত করার স্বপ্ন দেখছে বিজেপি। বাজপাখির মতো হাই অলটিচ্যুড থেকে নজর রাখা হচ্ছে ক্রিকেটীয় রাজনীতির কলাকারদের দিকে। কারণ এই সুবে বাংলার মসনদ পাওয়ার স্বপ্নপূরণের জন্য চাই এক কোহিনুর।
কেন্দ্রের শাসকদলের মার্গদর্শক সংঘ মনে করছে, দলের মুকুট কোহিনুরখচিত হলে দোদুল্যমান ভোটাররা তো বটেই, অন্য তিন বড় দলের কমিটেড ভোটাররাও অনেকেই ভোট দেবেন পরিবর্তনের করকমলে। তাই খুব সন্তর্পণে পা ফেলা হচ্ছে এব্যাপারে। এখানে যদু মধুদের করার কিছু বা বলার কিছু নেই। তাঁরা এতে হাত দিয়ে অত্যুৎসাহে হাত পোড়াতে যাচ্ছেন না। মধ্যেখান থেকে শুভেন্দুকাণ্ডের শিখণ্ডী হয়ে এক প্রবীণ প্রাজ্ঞ তৃণমূল নেতা অকারণেই রাজনীতিতে সৌরভের দরকার নেই বলেই কার্যত সোচ্চার হয়েছেন। সেই সঙ্গে, সৌরভ বড়লোকের ছেলে, গরিবদের জন্য কবে কী করেছেন, এসব মন্তব্যের পুষ্পবৃষ্টিও হয়েছে “দাদা”র রাজনীতিতে যোগদানের সম্ভাবনা দেখে।


যদিও ঐ মন্তব্য নিয়ে কোনও দলের নেতারই কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া আসেনি। সংবিধান যে অধিকার দেয়, সে অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন নেই। তাছাড়া এই মন্তব্যকারী নেতা তাঁর দলের যে সতীর্থদের সঙ্গে নির্বাচিত, তাঁদের কেউ ফিল্ম, কেউ ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের স্টার। বড়লোকের ছেলে কিংবা গরিবলোকের সেবক এই গুণগত বিচার ছাড়াই তাঁরা তৃণমূলস্থ হয়ে ছেন। সুতরাং নীতি কি তবে মানুষ বুঝে হবে? এদিকে, একুশের চেতনা যত ছড়িয়ে পড়ছে, একুশের ভোটে ‘হারজিতের এই খেলাতে জীবনটারে মিলাতে’ নেতাদের জার্সি বদলের মরশুম শুধু একটি জেলা, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ নেই। শুভেন্দুর পরে একে একে রব তুলেছেন এবং চলে গেছেন বা যাচ্ছেন আরও কেউ কেউ।
আরও পড়ুন: SPECIAL FEATURE প্রণম্য দিদিকে কেন শুভেন্দুর শুকনো “নমস্কার ?” – দেবারুণ রায়
মিহির গোস্বামী চলে গেছেন। শোনা যাচ্ছে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, শীলভদ্র দত্ত এবং সবশেষে বৈশালী ডালমিয়ার কথা। এই শেষ নামটি তথ্যাভিজ্ঞদের লক্ষ্যভেদের সূত্রে প্রাপ্ত। প্রয়াত ক্রিকেট প্রশাসক ও স্বনামধন্য জগমোহন ডালমিয়ার মেয়ে বৈশালী সম্প্রতি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তোলা “বহিরাগত” নিয়ে গর্জে উঠেছেন, এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বহিরাগত ইঙ্গিত করার বিরুদ্ধে জোরালো প্রশ্ন তুলেছেন। বৈশালীর এই প্রশ্ন বা বিরক্তি মোটেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়। স্পষ্ট রাজনীতির সংকেত। প্রাদেশিকতার প্রশ্নে বিভাজন হলে তো এটাই তার অন্যতম পরিণাম।
সৌরভ বড়লোকের ছেলে, গরিবদের জন্য কবে কী করেছেন, এসব মন্তব্যের পুষ্পবৃষ্টিও হয়েছে “দাদা”র রাজনীতিতে যোগদানের সম্ভাবনা দেখে।
ধর্মের নামে বিভাজন যেমন দুই ধর্মের সংকীর্ণতাবাদীদেরই পুষ্ট করে, তেমনি ভাষাভাষীদের মধ্যে বিভাজনরেখাও দলের রাজনীতি বা অবস্থান মানেনা। প্রাদেশিকতার সুড়সুড়িতে মানুষ সাড়া দেয়। তখন আর রাজনৈতিক সীমারেখা মনে থাকে না। তাই একটা সংকীর্ণতা দিয়ে আরেকটা সংকীর্ণতাকে রোখার চেষ্টা সর্বনাশা। দল জানে, তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি হিসেবে যা বলা যায় না তাই বলেছেন ডালমিয়া। এবং তিনি বলতে না বলতেই দোহার ধরেছে বিজেপি।
দলের মুখপাত্র বলেছেন, “বৈশালীর পরিবারের সঙ্গে সংঘ-বিজেপির বহুদিনের সূসম্পর্ক। বৈশালী ,যা বলেছেন তা’তো অকাট্য।” এরপরও দলকে ব্যবস্থা নিতে গিয়েও হাজারবার অগ্রপশ্চাৎ ভাবতেই হচ্ছে এবং বৈশালী প্রসঙ্গে এগোতে গেলেও বিজেপির পক্ষে সুখের, আবার পিছোতে গেলেও জনমানসে তার ভুল সংকেত যাচ্ছে। সুতরাং তুরুপটি তৈরি রাখার জন্য বিজেপিকে আর বেগ পেতে হচ্ছে না। রসদ তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে অন্যরাই। ডালমিয়া পরিবারের সঙ্গে বাংলার মহারাজের যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য। জগমোহন ডালমিয়া ছিলেন তাঁর অভিভাবকতুল্য। বৈশালীর তোলা বহিরাগত নিয়ে ঝড়ের বার্তা তিনিও পেয়েছেন বৈকি!
সৌরভ ও বৈশালী ডালমিয়া, ছবি: গুগল
এই ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই সৌরভকে নিয়ে সুসমাচার আরও পল্লবিত। জনপ্রিয়তার নিরিখে বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে আইকন হিসেবে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আবেদন সবচেয়ে বেশি। উপযুক্ত মুখের খোঁজে বিজেপি এখনও বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট নাম না নিয়ে কার্যত সর্বনামে আছে। সংঘ, বিজেপি ও কর্পোরেট জগতের কয়েকজন মাথা সর্বোচ্চ স্তরে এনিয়ে সক্রিয়। কারণ টিম ইন্ডিয়ার স্বাভিমানের প্রতীক “দাদা” রাজনীতিতে এলেও তাঁর টিমের জয়ের সূচক হবে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য।
ডালমিয়া পরিবারের সঙ্গে বাংলার মহারাজের যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য। জগমোহন ডালমিয়া ছিলেন তাঁর অভিভাবকতুল্য।


বাংলায় বিজেপির জয় সুনিশ্চিত করার জন্য ‘শাহ’জাদা জয়ও যথেষ্ট সচেষ্ট রয়েছেন। বিসিসিআইয়ের ভারসাম্যের সমীকরণ জড়িয়ে আছে এই প্রক্রিয়ায়। অদূর ভবিষ্যতে আইসিসিতেও তার ছায়া পড়বে প্রাসঙ্গিকভাবে। আজ শুভেন্দু অধিকারীর ঘোষণার পর বৈশালী ডালমিয়ার অবস্থান একের পর এক ইট সাজানোর মতোই। দলের দোদুল্যমানদের ‘দিদি’ স্বাভাবিক ভাবেই সবচেয়ে বেশি চেনেন। তাই “যারা যেতে চান, চলে যান” এর মতো মন্তব্য করেছেন দ্বর্থ্যহীন মুদ্রায়।