30 C
Kolkata
Tuesday, May 30, 2023
More

    সোমেন মিত্রের মিথ এবং বাংলার শত্র‌ু মিত্র – দেবারুণ রায়

    ” দিদিমণি, তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ছেলে মেয়েদের নিয়ে লড়াইয়ের  ময়দানে থাকো। চারদিকে নজর রেখে মুভমেন্ট চালিয়ে যাও। কংগ্রেসের ছেলে মেয়েরা তোমার সঙ্গে আছে। আর চিন্তা কী। আমি তোমার সঙ্গে আছি। যতটা সাহায্য করা যায় করে যাচ্ছি। সাউথের ছেলেরা ইতিমধ্যেই পৌঁছচ্ছে  আমাকে জানিয়েছে। আমার এলাকার তো বটেই, উত্তর কলকাতা থেকেও ছেলেরা পৌছে যাবে যেকোনও সময়। সবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তোমাকে এসব ভাবতেই হবেনা। তুমি আন্দোলনের মধ্যে আছ। শুধু সেটাকে সফল করে তোলার চিন্তা কর। বাইরের ব্যাপারে আমি দেখছি। আমি আর অন্য কোথাও বেরচ্ছিনা। তোমাকে আমি আধঘন্টা পরে পরে ফোন করব । তুমি জানাবে লেটেস্ট সিচুয়েশন। আমি চিন্তায় থাকব।”

    দেবারুণ রায়

    মমতার ফোন ছেড়েই যুব কংগ্রেসের অনুজ নেতাদের ফোন করলেন। বেশ কয়েক জনকেই জানালেন যাদবপুরের হাল হকিকত । আরও ছেলে পাঠাতে বললেন। পুলিশ, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কয়েক জনকে ফোন করে বললেন , যুবনেত্রীর নিরাপত্তার কথা।  যাদবপুর থানা ঘেরাও করার যে কর্মসূচি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সেদিন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তার অনেকটা লজিস্টিকসই জুগিয়েছিলেন সোমেন।

    সেটা মোবাইলের যুগ নয়। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৫। প্রদেশ কংগ্রেসের

    সভাপতি পদে প্রণব মুখোপাধ্যায় তখনও আছেন। সম্পাদক সোমেন মিত্র। সাংসদ এবং যুবনেত্রী মমতা কংগ্রেসের গণ আন্দোলনরথের সারথী। উপদলীয় টানাপোড়েনে তখন সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব। এবং চিরকাল সুব্রত-সোমেনের অন্তর্লীন সান্নিধ্য বোঝা কঠিন হত, বাইরের রেষারেষি, দ্বৈরথের দরুণ। সুব্রত ওইদিনের থানা ঘেরাওয়ের কর্ম সূচিতে ছিলেন না। কিন্তু সোমেন ছিলেন মমতার সেদিনের আন্দোলনের পশ্চাদভূমি , এককভাবে। আন্দোলনের বিষয় ছিল আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার অভিযোগ। ৩৫৬ ধারা জারি করার দাবির পাশাপাশি “নিষ্ক্রিয়” থানায় থানায় দড়ি কলসী নিয়ে পৌছতেন কংগ্রেস কর্মীরা। পুলিশ কর্তাদের হাতে তুলে দিতে। সেদিন যাদবপুর থানায় ছিল সেই কর্মসূচি।

    ১৯৮৪-র অক্টোবর শেষ হল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিধন দিয়ে। নারকেলডাঙার ষষ্ঠীতলায় এসে থেমে গেল বাস। আর যাবেনা কোনওদিকেই। একজন যাত্রীর পকেট ট্রানজিস্টার নিয়ে কাড়াকাড়ি। শেষে ভদ্রলোক সেটা ফুল ভলিউমে দিয়ে উঁচু করে ধরলেন। সব কোলাহল থেমে গেল। সবাই ওঁকে গোল হয়ে ঘিরে কানখাড়া। দিল্লির হিন্দি খবর হচ্ছে। তখনই ঘোষণা হচ্ছে সেই “দুখদ সমাচার।” “প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আজ সকালে তাঁর দুই দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। অভূতপূর্ব শোকে নিমজ্জিত সারা দেশ। ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে মানুষ। নানা রাজ্য থেকে সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ হিংসার বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলির খবর আসছে। দিল্লিতেও বিক্ষুব্ধ মানুষ পথে নেমেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট সরকার জনগণের কাছে শান্তিরক্ষার আবেদন জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক বসেছে তৎকাল জরুরি সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করতে।”

    এরপর সোজা পায়দলে আমার কাগজের অফিসের দিকে হাঁটা দিলাম। রাস্তায় বাসের ওই যাত্রীরা ছাড়া আর কেউ নেই। চারদিক শুনশান। রাস্তায় কিছু পুলিশি ব্যারিকেড আর পুলিশের গাড়ি ছাড়া অন্য কিছু নেই। নারকেলডাঙা মেন রোডে পড়ে আছে শুধু পাটকেল। দোকানপাট একটাও খোলা নেই।

    আপার সার্কুলার, মানে এপিসি রোডে পৌছে রাজাবাজার ট্রাম ডিপো পর্যন্ত এসে দেখি , ইএসআই হসপিটাল থেকে মৌলালীর দিকে শুধুই আগুন আর কালো ধোঁয়া। তবু হাঁটছি মির্জাপুর পর্যন্ত তো যেতেই হবে। ওটুকু গিয়ে দেখলাম আগুন ও ধোঁয়ার উৎস। কাইজার স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে একটা হেলে পড়া ডবল ডেকার। সম্ভবত এইট বি রুটের। পুরো বাসটাই জ্বলছে আগুনের গোলা হয়ে। পুলিশ আর পুলিশ ভ্যান ছাড়া আর কিছু নেই। ওই এলাকা শিয়ালদা বিধানসভা কেন্দ্রের কেন্দ্রবিন্দু। যে কেন্দ্রের বিধায়ক সোমেন মিত্র। শুধু বিধায়ক বললে কিছুই বলা হয় না। সোমেন মিত্রকে নিয়ে গড়ে ওঠা মিথ-এর মূল মাস্তুল এই শিয়ালদা। সেদিনের বিক্ষোভের আগুন তখনও নেভেনি। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা অদৃশ্য। পুলিশের তেমন জমায়েত বা টহলদারি কোনওটাই চোখে পড়ল না। ১৪৪ ধারা ছাড়া আর কোনও নিষেধাজ্ঞাও নেই। এবং সারা দেশের সঙ্গে কলকাতার ও বাংলার অসঙ্গতিটাই ছিল সেদিনের জ্যোতি বসু প্রশাসন এবং বিরোধীদল কংগ্রেসের গর্বের বিষয়। দিল্লির দাঙ্গার আগুনের আঁচে দেশের নানা রাজ্য পুড়লেও বাংলা ছিল সম্প্রীতির মডেল। একজন সর্দারের গায়ে আঁচড় কাটতে পারেনি সাম্প্রদায়িক উন্মাদ । অবশ্যই বাংলার কংগ্রেস নেতারা ওই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর উর্ধে ছিলেন। বিশেষ করে কলকাতার বুকে কংগ্রেসের ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠনের নিয়ন্তা ছিলেন সোমেন। মাস বেসড দল কংগ্রেসের রাজনীতিতে যা ছিল ব্যতিক্রম। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অবিভক্ত কংগ্রেসে অতুল্য ঘোষের সাংগঠনিক ঘরানার অনেকটাই ছিল ইন্দিরা কংগ্রেসের তরুণ সংগঠক সোমেন মিত্রের মধ্যে। যে জন্যে বাম জমানায় কংগ্রেসের শীর্ষ রাজ্য নেতাদের প্রায় কেউই সোমেনকে বাদ দিয়ে চলতে চাননি। ব্যতিক্রম শুধু সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। সেদিনের শীর্ষ কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে নিরানব্বই ভাগই রাজ্যে কংগ্রেসের দুর্দশার জন্যে সিদ্ধার্থর “পুলিশরাজ”কে দায়ী করতেন। বাহাত্তর থেকে সাতাত্তর যে সরকারের ” দুঃস্বপ্নের বিভীষিকা ” বামফ্রন্টকে শক্তিশালী ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিল , তার নেতা সিদ্ধার্থ ওরফে মানুবাবু সরকার তো বটেই, দলও চালাতেন পুলিশ দিয়ে, একথা রাজ্যে কেন্দ্রে গণ্যমান্য কংগ্রেস নেতাদের কাছেই শুনেছি। এবং রাজ্যের বহু কংগ্রেস নেতা সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যায়ন শুনে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো যাচাই করে নিয়েছি। একান্তে এমন নালেখা কথামালা তো কতই আছে বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে। সোমেন দার কাছে শোনা একটা কথা তাঁর বিপরীত শিবিরের প্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধুরাও স্বীকার করেছেন। জরুরি অবস্থার কিছুটা আগের ঘটনা। যা শুনলে মনে হবে বাংলাই ছিল জরুরী অবস্থার ল্যাব। বাহাত্তর থেকেই এই পরীক্ষাগারে পুলিশ রাজের পরীক্ষা শুরু। ওই সময় উপদলীয় সমস্যা মেটাতে একটি বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে হাজির মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থবাবু একেকজন নেতার নাম করে করে তাঁদের সতর্ক করে দেন। সোমেনের পালা এলে” মানু দা” তাঁকে আঙুল তুলে বলেন, অ্যাই গুণ্ডা ( এভাবেই ডাকতেন সোমেনকে ),সব রিপোর্ট পাচ্ছি। কথা না শুনলে একদম মিসা করে দেব। মেইনটেন্যান্স অফ ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা মিসা-কে বিরোধীরা বলেন কায়দাকানুন। ইন্দিরার নামের সঙ্গে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ বিশেষণটি ছুড়েছিল যে যে কারণে তার প্রথম ছিল মিসা। এবং এটা কোনও ফাঁকা আওয়াজ ছিলনা মানুদার। তার কারণ, তাঁর মনোনীত একটি নির্দিষ্ট কোটারির নির্দেশে বাংলার যে কোনও নাগরিককে তুলে নিয়ে যাওয়ার অসংখ্য ঘটনার কথা শোনা গেলেও অপরাধ চিহ্ন রাখেনি।স্বাধীন ভারতে সেই প্রথম এনকাউন্টার শব্দের আমদানি পুলিশ হেফাজতে বন্দি বা ধৃতের নিহত হবার ঘটনায়। তো সেই জমানায় বিরোধী রাজনীতির লোকদের পাশাপাশি কংগ্রেসের তরুণ নেতা সোমেনও ছিলেন মানুদার কুনজরে থাকা কংগ্রেসিদের একজন।

    ৮৪-র শেষে তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হল। তখন রাজ্য রাজনীতিতেও কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের নবযুগের ছায়া। রাজ্যের কংগ্রেস রাজনীতি তখন ছিল, দুটি মূল লয়ে বাঁধা। প্রণব ও বরকত। দুজনই  রাজ্যের বড় নেতা ও কেন্দ্রের প্রভাবশালী মন্ত্রী। এবং দুজনেই ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহধন্য হিসেবে পরিচিত।কংগ্রেসের যুবছাত্র আন্দোলনের মূল তিন নেতার মধ্যে রাজনৈতিক সমীকরণে সুব্রত মুখোপাধ্যায় প্রণব শিবিরে, সোমেন মিত্র বরকত ক্যাম্পে ও প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি কার্যত নিজেই একটি শিবির। যদিও সেটি ওই দুই শি বিরের মতো বড় ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। রাজীব গান্ধীর ক্যাবিনেট থেকে বাদ পড়লেন প্রণববাবু। দায়িত্ব ও গুরুত্ব কমল বরকত সাহেবের। প্রণব মুখোপাধ্যায় কে করা হল প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। ওঁকে ক্রমাগত কোণঠাসা করে সরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছিল যোজনাবদ্ধভাবে । প্রণব সবই জানতেন। কিন্তু তীক্ষ্ণ বোধ , পাণ্ডিত্য ও রাজনীতি – কূটনীতির দক্ষ বিশ্লেষক হিসেবে এসবের জবাব দিতে অভ্যস্ত প্রণব তাঁর কমিটিতে সাধারণ দায়িত্ব  দেন সোমেন কে। কমিটির নানাপদে প্রণববাবুর আস্থাভাজন অনেকেই ছিলেন। কিন্তু সোমেন ছিলেন তাঁর কমিটির সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম। ফলে রাজীব গান্ধী একদিকে অজিত পাঁজা আর অন্যদিকে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সিকে দিয়ে তৈরি বৃত্তের ভেতরে যেভাবে অর্থহীন করে দিতে চেয়েছিলেন প্রণববাবুকে তা ভেস্তে যায় সোমেনের কুশলী সাহচর্যে। এরাজ্যের ইন্দিরা কংগ্রেসের মূলস্রোত ছিল প্রণব বরকতকে নিয়ে। সেই ধারাদুটি মেলালেন সোমেন। ফলে শক্তিশালী বিরোধী দলের রাজনীতিটাই রাতারাতি বদলে যেতে লাগল। কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশিদিন চলেনি।

    প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দল ছাড়া, অন্য দল করা ও ফিরে আসা পর্বে প্রদেশের নেতা হয়েছেন প্রিয় ও বরকত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসে নবনির্মাণের ধ্বনিতে মুখর বঙ্গরঙ্গমঞ্চ।

    প্রণব ও বরকত যেমন দিল্লির রাজনীতিতে জীবন কাটালেও বাংলার কংগ্রেসে তাঁরা জীবন্ত প্রতিষ্ঠান।সর্বভারতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নীতি নির্ধারক মঞ্চে থেকেই বাংলার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। প্রণবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর বরকতের জনপ্রিয়তাই বাংলার কংগ্রেসে প্রাণবায়ু সঞ্চার করেছে।প্রিয় কংগ্রেসের প্রাসাদপ্রিয় একদা তরুণ ব্রিগেডের নেতৃত্বে থাকার দরুণ, নবীন থেকে প্রবীণ হওয়া দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশের সমর্থন পেয়েছেন। ফলে দিল্লির দাবি মিটিয়ে আর বাংলায় সময় দিতে পারেন নি। যেটা প্রণব মুখোপাধ্যায় পেরেছেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায় মমতার দলে গিয়ে দান ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে সোমেন শেষ পর্যন্ত বাংলা কংগ্রেসে দ্বিতীয় প্রজন্মের তিন মূর্তির মধ্যে একা কুম্ভ। কিন্তু ওঁরও শেষরক্ষা হলনা।

    রাহুল জমানায় কীভাবে যে সোমেনের পুনরুত্থান হল, তা অনুসন্ধান করলে মানতে হয় অধীরকে সরানোর বাধ্যতাকে সহনীয় করে একই মূলস্রোতের গভীরে যেতে ভুল করেননি তিনি। এব্যাপারে রাহুলের তরুণ ব্রিগেডের রিডিং যে নির্ভুল তার প্রমাণ কংগ্রেসের ও বিরোধীদের সর্বস্তরের মূল নেতাদের শোকবার্তা। বিশেষত অধীরের গুরুপ্রণামটাই সোমেনের মোদ্দা আইডেন্টিটি। সঙ্গে প্রণববাবুর আর দিল্লির নেতাদের কথাও। দেবপ্রসাদ রায়কে ভোট না দিয়ে জয়ন্ত ভট্টাচার্যকে জেতানো যদি দলের ক্ষতি করা হয়ে থাকে তাহলে অনেক বড় প্রেক্ষিতে গান্ধী ও ইন্দিরাকেও একই দোষে দোষী বলতে হবে। সুভাষচন্দ্র নির্বাচিত হওয়ার পর হেরোপ্রার্থী পট্টভির জন্য প্যার্বি করে গান্ধীজী অন্যায় করেছিলেন একথা কংগ্রেস স্বীকার করেনা। এছাড়া, রাষ্ট্রপতি ভোটে দলের প্রার্থী সঞ্জীব রেড্ডিকে হারিয়ে দিয়ে ইন্দিরা ভিভি গিরিকে বিরোধীদের সঙ্গে মিলে জিতিয়েছিলেন। সেটা কি ইন্দিরার অপরাধ ? নব কংগ্রেস তো তা স্বীকার করেনি। ওই ইস্যুতে কংগ্রেস ভেঙেছিল।

    সুতরাং কংগ্রেসের ব্যাদে আছে এমন রাজনীতি। এবং মিঠু রায়ের জন্য সোমেনকে ব্ল্যাক লিস্টেড করেও, দল ভেঙে যাওয়ার দায় অনেকটা সোমেনের ঘাড়ে চাপিয়েও এবং আস্ত ও টুকরো কংগ্রেসের আমলে মমতাকে বারবার আঁকড়ে ধরেও শেষমেশ সঠিক মূল্যায়ন করেছেন। রাহুল যতই চান, কংগ্রেসে মূল শক্তির উৎস সনিয়াই ।

    দেখাই যাচ্ছে জ্যোতি বসুর শাসনের শেষ দিকে কীভাবে আসন বেড়েছে কংগ্রেসের। ৮০ পেরনোর পরের ভোটেই তো অবিভক্ত কংগ্রেস এককভাবেই গরিষ্ঠতা পেতে পারত। বাম জমানার আয়ুস্কাল ৩৪-এর জায়গায় হতেই পারত ২৪। দলটা ভেঙে না গেলে সোমেন মমতার যৌথ শক্তিতে ২০০১ এই তো কংগ্রেস সরকার কায়েম হতে পারত। কিন্তু ঐ সময় শুধু একটা দল ভাঙেনি। …”..এই বাংলায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর …..।”

    বাংলার পরিবর্তনের ছায়া অনেকটা দীর্ঘায়ত। সোমেন মিত্রও পরিবর্তিত হলেন। না হলে ডায়মন্ডহারবারের সূর্যোদয় তাঁর এজীবনে দেখা হতনা। রাজনীতি তো শুধু রাজনীতি সবার জন্য নয়। পরিবার, পরিজন, পরিবর্জন, পরিমার্জন, পরিবর্তন। তবে একটা সময় আসে যখন হয়তো অন্তরাত্মার আওয়াজ অহরহ কানে আসে। কান থেকে মন প্রাণ ছেয়ে যায়। একটা সময় আসে যখন হাতের মুঠোয় কী আছে তা দেখা যায়। মুঠোটা আলগা হয়ে যায়। বজ্রমুষ্ঠি যা কখনও খোলেনি।

    তৃণমূলের সাংসদ হিসেবে বেশ ঘটা করে দেখা হল তাঁর নতুন বাংলোয়। আগে তো কালীপুজোর রাতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের আড্ডায় দেখা হত। হয়তো রাত দুটো। পুজো হচ্ছে। তখন আর কোনও ভিড় নেই। দেখা হলেই পাশে বসিয়ে অল্প অল্প কথা। চা কফি। ওটা নেতা আর রিপোর্টারের রিলেশন নয়। একেবারে ব্যক্তিগত। তার একটা কারণও ছিল। সোমেন দার অধ্যাপকের কন্যা আমার জীবনসঙ্গিনী হতে যাচ্ছে একথা আমি কেন বলিনি বলে অনুযোগ ও স্নেহের তিরস্কারের পরই ৪৫, আমহার্স্ট স্ট্রিটের তেতলার ঘরে পেটেন্ট খালি গা ধূতি পরনে সোমেন দার উঠে এসে জড়িয়ে ধরা। ভালবাসার অভিব্যক্তি এমন কি আর হয় রাজনীতিতে ?

    শিয়ালদায় থাকতেন তাঁর বিখ্যাত মাস্টারমশাই অধ্যাপক এ.সি.সরকার। পিওর সায়েন্সের পুরোটাই তাঁর কাছে পড়া। বিশেষ করে অঙ্ক। স্যার বলতেন, সোমেন তোমার লেখাপড়া কিসসু হবেনা। তুমি কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেবে না পড়বে ? কিন্তু তিরস্কার যতই হোক মাথা নিচু করে বইখাতায় চোখ রাখাটা কিন্তু স্যারের নজর এড়াত না। বিনয় তাঁর ভূষণ থেকেছে আজীবন। ছাত্র রাজনীতির খণ্ডযুদ্ধেও তাঁর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যের কোনও অভিযোগ আসেনি। ভোটের সময় প্রত্যেকবার স্যারের আশীর্বাদ নিতে যেতেন। যদিও জানতেন স্যার বাম ভাবনায় বিশ্বাসী। তবু আশীর্বাদ তো চাই। ড. হীরেন মুখার্জি সাতাত্তরেও দাঁড়ালেন । সেবার তিনি কংসঙ্গী। তবু হীরেনবাবুকে না দিয়ে কি প্রতাপ চন্দ্র ! অসম্ভব। সেবার প্রচারে বাম মহলে সমাদৃত যুবনেতা সোমেনের নির্বাচনী রাজনীতিটা পাকেচক্রে শুরু কিন্তু জোট দিয়ে। সেবার সিপিআই ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে। সিপিএম তাদের বিপরীত মেরুতে।

    ইতিমধ্যে গঙ্গায় কত স্রোতের আনাগোনা। কোথাও চর পড়া, কোথাও পার ভাঙা। এলাকায় সবাই জানত বিধায়ক বাড়িওলা ভাড়াটের বিবাদ ছাড়া আর সব সমস্যা মেটান। কিন্তু স্যারের ক্ষেত্রে সেখানেও ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত ছিল সোমেনের। পুরনো বাড়ি ভাড়াটে শুদ্ধু কমদামে কিনেছেন পুরনো দিনের ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার সুনীল নন্দী। নিয়েই প্রবীণ অধ্যাপককে হুমকি বাড়ি ছেড়ে দিন। ঝামেলা করবেন না। নাহলে কীভাবে ছাড়াতে হয় জানি। এসব বলে আসছে মাস্তানের দল। স্যার অসহায় অবস্থায় সোমেন কে জানালেন সব। বললেন, তোমাকে কখনও একথা বলতে হবে ভাবিনি। সোমেন স্যারকে দেখেই তার ভিড়ে ঠাসা বৈঠকখানায় চেয়ার ছেড়ে উঠে ওঁকে বসতে দিলেন। বললেন, আপনাকে বাড়ি ছাড়তে হবেনা। এনিয়ে কোনও চিন্তাও করতে হবেনা। ইস্টবেঙ্গলের কর্মকর্তা পল্টু দাস সোমেনেরই কাছের লোক। পল্টুকে ডেকে বুঝে নিলেন। কারণ সেই খেলোয়াড় ইতিমধ্যেই পল্টুর আশ্রয়ে। সোমেন তাঁর বন্ধু ও সচিব বাদল ভট্টাচার্যকে বললেন, স্যার ওই বাড়িতেই যাতে আমৃত্যু থাকতে পারেন সেটা পল্টুকে বলে দে। ব্যস সেকথার আর নড়েচড় হয়নি।

    সম্ভবত সেটা বিরাশীর বিধানসভা ভোট। অধ্যাপক সকালে উঠে একাই ভোট দিতে গেলেন। বাড়ির অন্যদের জন্যে অপেক্ষা না করে। ভোট দিয়ে ফিরে এসে স্ত্রীকে বললেন, ” জীবনে এই প্রথমবার কংগ্রেসকে ভোট দিলাম। ওঁর চোখ ছলছল করছে। সোমেনের কথা ফেলতে পারলাম না। ও আমার ছেলের কাজ করেছে।”

    ডায়মন্ডহারবার থেকে জিতে এমপি হলেন সোমেন দা। এমনি সময় দিল্লি গেলে বঙ্গডবনে বা বসু লজে ওঁর আতিথ্যে হাজির হতেই হত বাংলার রিপোর্টার বন্ধুদের। এবার সাংসদের সেলিব্রেশনে নিশ্চয়ই বাড়তি জাঁক । একদিন সকালে বাড়িতে ফোন । সোমেন মিত্র বলছি । কেমন আছ ? ওই দিন সন্ধেটা ফ্রি রেখো। আমার নেত্রীর নির্দেশে তোমাকে ফোন করছি। বলব বলেই বলি, সেকি সোমেনদা, নির্দেশ না দিলে ফোন করতেন না ?

    এবার কিছুটা হাসি। আমার নতুন বাংলোয় গৃহপ্রবেশ উপলক্ষ্যে ডিনারে তোমাকে আসতে হবে।

    যথারীতি এত আন্তরিক মানুষ। বললাম, আপনি যতটা লয়্যাল ততটাই কমিটেড।

    কলকাতায় ফিরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন দার কাছে আজ যাব কাল যাব করতে করতে ফোন করলাম। নাম বলতে হবে ? শোনার আগেই স্বভাবসুলভ ভাবে, না গো , একদম ভুলে গেছি। এসো । হ্যাঁ অফিসে। যখন খুশি।

    সোমেন দা বেশ ভাল হয়ে উঠছিলেন। এই করাল সময় কোনও ভালবাসা মানেনা। প্রিয় মানুষকে দেখতে যাওয়াটাও তার বাড়তি বিড়ম্বনা। খবর পাচ্ছিলাম । মনের জোরে ভাবছিলাম, এত লড়াকু লোক, উঠে যখন দাঁড়িয়েছে ঠিক ফিরে আসবে। রাত দুটো কি আড়াইটেয় সবার আগে দুঃসংবাদ পোস্ট করেছে সম্রাট। তপাদার। ওই একটা মুহূর্ত শুধু স্টিল। তারপর আর কোনও জন্মমৃত্যুর ভেদাভেদ নেই। জীবনের যত লগ্ন, তত লগ্নী , সুখের ভঙ্গুর স্মৃতি, সর্বনাশে সব নাশে অগ্নি ?

    আপনি শেষ শয্যায়। চুলের রূপোলি শীর্ষে অন্য কোনও আনন্দের রেখা। লেখা আছে শরীরের শেষ জতুগৃহে , চিতাভষ্ম থেকে ওঠা ফিনিক্সের মতো হবে দেখা।

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    বাতিল হতে চলেছে ২০০০ টাকার নোট !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : বাজার থেকে ২০০০ টাকার নোট তুলে নিচ্ছে RBI। এমনই বড় সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করল...

    শীঘ্রই আসছে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ! চলছে শেষ পর্যায়ের ট্রায়াল

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : বর্ষার মরসুম শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। ফি বছরে বর্ষা মরসুম মানেই ডেঙ্গির...

    কেষ্ট গড়ে তৃণমূলে ধস ! বিজেপিতে যোগ দিল বহু মুসলিম পরিবার

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। জোরকদমে প্রচার চালাচ্ছে শাসক-বিরোধী। তার আগে ভাঙন অস্বস্তিতে বিপাকে পড়ছে...

    সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে বেশ কিছু দেশ ! জানুন সেই দেশ গুলি সম্পর্কে

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : উষ্ণায়নের কারণে গোটা বিশ্বজুড়ে অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। কোনও কোনও জায়গায় গ্রীষ্মকালে তুষারপাত হচ্ছে...

    শুরু থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ , কি আছে বিতর্কিত ছবিতে ?

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ইউটিউবে ছবির ট্রেলার দেখেই বিতর্কের মেঘ ঘনিয়েছিল। মুক্তির পর তোলপাড় ফেলে দিয়েছে পরিচালক সুদীপ্ত...