পুরুলিয়া: সোমবার ১৮ কামরার একটি স্পেশাল ট্রেনে পুরুলিয়া থেকে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে ফিরবে নাগা বাহিনী। দীর্ঘ এক দশক পর জঙ্গলমহল পাহারার দ্বায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছে এই কেন্দ্রীয় বাহিনী। এর পর জঙ্গল মহলের এই শিবিরের দ্বায়িত্ব নিচ্ছে ৪ কোম্পানি সিআরপিএফ। মোট দু দফায় সিআরপিএফ এই দ্বায়িত্ব গ্রহণ করবে। আপাতত নাগা বাহিনীর ৬ টি শিবিরের দায়িত্ব নেবে রাজ্য পুলিশ।
সিআরপিএফের পশ্চিমবাংলা সেক্টরের আইজিপি প্রদীপ কুমার সিং বলেন,”পরুলিয়ার ৬ টি নাগাল্যান্ড আর্ম পুলিশের শিবিরের মধ্যে ২ দফায় ৪ কোম্পানি সিআরপিএফ ৪ টি শিবিরের দায়িত্ব নেবে।” যা আশা করা যাচ্ছে তাতে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দুটি শিবিরে চলে আসবে সিআরপিএফ। দ্বিতীয় ধাপে সিআরপিএফ আসবে আরো কয়েকদিন পর।


উল্লেখ্য, ২০১০ এর অগাস্ট মাসে জঙ্গলমহলে মাওবাদী কার্যকলাপ রুখতে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে ৬ টি সেনা ক্যাম্প তৈরী হয়। কারণ সেই সময়ে অন্যান্য জেলার পাশাপাশি জঙ্গলমহলের পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে মাওবাদীদের একটি প্লাটুন এই জেলার মাথা ব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই সমস্যাকে রুখতে স্বরাষ্ট্র দফতর জঙ্গল যুদ্ধে পারদর্শী নাগাল্যান্ড সশস্ত্র বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নের ৬ টি কোম্পানি পুরুলিয়ায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে বলরামপুরের কুমারিকানন, পাথরবাঁধ;বাগমুন্ডির পিপিএসপি ও হিলটপ এবং অর্ষার সিরকাবাদ ও কোটশিলার মুর্গামাতে এই বাহিনীর শিবির করে। তার পর প্রথম ২০১০ সালের ১১ ই নভেম্বর কোটশিলার মুর্গাম জলাধারের ওপরে ঠাকুরচাটান এলাকায় পুলিশের সাথে মাওবাদীদের গুলির লড়াই হয়। তাতে মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের দুই সদস্য বিপ্লব ও রিমিল মারা যায়। উদ্ধার হয় দুটি বন্দুক।
২০১১ সালের ১৪ ই নভেম্বর বলরামপুর থানার অযোধ্যা পাহাড় ঘেঁষা ঘাঁটবের অঞ্চলের খুনটাঁড় গ্রামে শিক্ষক প্রকট ও তার ছেলেকে খুন করে ফেরার পথে বারোডালিয়াতে পুলিশের গুলিতে মারা যায় মাওবাদীদের আরো দুজন গেরিলা সদস্য সুরেশ ও সুবল। সেখানেও উদ্ধার হয় দুটি বন্দুক। তবে সেই সংঘর্ষে মাওবাদীদের গুলিতে মৃত্যু হয় একজন নাগাল্যান্ড সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানের। জখম হন আরো একজন।
এরপর আসতে আসতে কোনঠাসা হয়ে নাগাবাহিনীর হাতে একের পর এক মাওবাদী সদস্য গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণ করে। অবশেষে ২০১২ সালের মাঝামাঝি এই অযোধ্যা স্কোয়াডের মাস্টারমাইন্ড তথা সিপিআই মাওবাদীরা রাজ্য কমিটির সদস্য অর্নব দাম ওরফে বিক্রমকে বলরামপুরের বিরামদির সহিস পাড়া থেকে ধরে ফেলেন তৎকালীন জেলা পুলিশের ডিএন্ডটিডিএসপি অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় ও তার টিম।


এরপর কেটে গেছে প্রায় ৮ বছর। মাঝে মধ্যে দুএকটি বিক্ষিপ্ত পোস্টার ছাড়া তেমন ভাবে এই অঞ্চলে মাওবাদীদের কোনো কার্যকলাপ চোখে পড়েনি। ২ বছর অন্তর পাল্টেছে নাগাল্যান্ড সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাটেলিয়ন। কিন্তু বর্তমানে লাগাল্যান্ডের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজেদের বাহিনী চেয়ে পাঠায় সেখানকার সরকার। ফলে চলতিমাসেই এই নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয় দুর্গাপুরে। সেখানে রাজ্য পুলিশের আধিকারিক ছাড়াও ছিলেন কেন্দ্রিয় বাহিনীর আধিকারিকরা। ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় ৩১ অগাস্ট এই বাহিনী পুরুলিয়া ছেড়ে লাগাল্যান্ড এ পাড়ি দেবে। পরিবর্তে ঝাড়গ্রামের ধেরুয়া ও চন্দ্রি থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে আইন শৃখলা সামাল দিতে যাওয়া সিআরপিএফ এর ১৮৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ২ টি কোম্পানি সেখান থেকে পুরুলিয়ার মুর্গাম ও কুমারিকাননে দায়িত্ব নেবে।


এমত অবস্থা পাহাড়ি রাস্তায় ধস নামার ফলে শ্রীনগরে আটকে পরে সিআরপিএফের ওই কোম্পানি। সোমবার শিবির খালি করে ১৮ কামরার একটি স্পেশাল ট্রেনে পুরুলিয়া থেকে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে ফিরবে নাগাল্যান্ডের সশস্ত্র বাহিনী। আর তাদের ৬ টি শিবিরেই আপাতত দায়িত্ব সামলাবে রাজ্য পুলিশের স্ট্রাকো ও জুনিয়র কনস্টেবলের মাওবাদী দমনে প্রশিক্ষিত বিশেষ বাহিনীর জওয়ানেরা।


এই এক দশকে নাগা জওয়ানরা যেভাবে পাহাড় জঙ্গল ঘেরা পুরুলিয়ার মানুষদের আপন করে নিয়েছিল তা ভুলতে পারছেন না এই বাহিনীর অধিকাংশ জওয়ান। নালাগান্ড সশস্ত্র বাহিনীর ১৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের সিও মুন্ডক যানচু বলেন-”এখানকার মানুষের আমাদের সবরকম সহযোগিতা করতো। এতো আপন করে নিয়েছিল আমাদের তা আমরা কখনোই ভুলতে পারবো না।”
আর মানুষ কেনই বা আপন করবে না! মেঠো রাস্তায় দুলি করে হাসপাতালে রুগীকে পৌঁছানো থেকে উঠোনে বাঁশের বেড়া দেওয়া। খেলা ধুলোয় সাহায্য থেকে দরিদ্র মানুষের ঘরের খড়ের চাল মেরামত করা কি না করেছে এই বাহিনী। প্রথম প্রথম এই বাহিনীকে নিয়ে যতোটা আতঙ্কিত ছিল এলাকাবাসীরা পরে ধীরে ধীরে ততটাই আপন করেছিল এই বাহিনীর জওয়ানদের। এই বাহিনী চলে যাচ্ছে বলে মন খারাপ পুরুলিয়ার বুধু-পিন্টুদের।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পুরুলিয়া পুলিশ সুপার এস সিলভা মুরুগন বলেন,”সোমবার ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটালিয়নে নাগাল্যান্ড সশস্ত্র বাহিনীর ৬ কোম্পানি ফোর্স চলে যাবে। সেই জায়গায় ৪ কোম্পানি সিআরপিএফ আসবে। বাকি ২ কোম্পানি রাজ্য সশস্ত্র বাহিনী সামলাবে।”