30 C
Kolkata
Thursday, June 8, 2023
More

    সূচ কাণ্ডে দৃষ্টান্তমূলক সাজা ঘোষণা, নিহত শিশুর মা সহ দুই দোষীকে ফাঁসির নির্দেশ পুরুলিয়া জেলা আদালতের

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো :

    অবশেষে চার বছরের মাথায় নরকীয় সূচ কাণ্ডের ঘটনায় দুজনকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যু দণ্ডের সাজা ঘোষনা করলো পুরুলিয়া জেলা আদালত। ২০১৭ সালে এই নরকীয় ঘটনায় রাজ্য ছাড়াও সারা দেশের মানুষ ধিক্কার জানিয়েছিলেন। সাড়ে তিন বছরের শিশুকে তার মা এবং মায়ের প্রেমিক মিলে শিশুটির শরীরে ৭টি সূচ ঢুকিয়ে দেয়। যার কয়েকদিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মায়ের কোল সন্তানের সব থেকে বেশি নিরাপদ স্থান। সেই মায়ের কোলেই সড়যন্ত্রের শিকারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। মঙ্গলবার সেই মামলার রায় ঘোষণা করেন পুরুলিয়া জেলা আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দ্বিতীয় কোর্ট এর বিচারক রমেশ কুমার প্রধান। এই দিন এই দৃষ্টান্ত মূলক রায় দেন। 

    এদিন সকাল থেকেই পুরুলিয়া জেলা আদালতে কড়া নিরাপত্তার ঘেরা টোপে নিয়ে আসা হয় দোষী সাব্যস্ত ওই দুই আসামীকে। গত শুক্রবার এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত তারা। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দ্বিতীয় কোর্টে এই মামলা চলছে গত চার বছর ধরে। পূর্বনির্ধারিত দিন অনুযায়ী সোমবারই সাজা ঘোষণার দিন ঠিক থাকলেও সরকারী আইনজীবীর দৃষ্টান্ত শাস্তির আবেদন করেন। তারপরেই বিচারক ওইদিন রায়দানে বিরত থাকেন এবং মঙ্গলবার রায়দানের দিন ধার্য করা হয়। সেই মতো এদিন দুপুর ১২টায় বিচারক রায়দানের জন্যে এজলাসে চলে আসেন।পেশ করবে দোষী সাব্যস্ত দুই আসামিকে।

    পুরুলিয়া মফস্বল থানা এলাকার নদীয়াড়া গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত হোমগার্ড সনাতন গোস্বামী। তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা যান ২০১৬ সালে। পুরুলিয়া মফস্বল থানার ভুল-সতেরো গ্রামের বাপের বাড়িতে থাকতো স্বামী পরিত্যক্তা মঙ্গলা গোস্বামী।সঙ্গে থাকত তাঁর সাড়ে তিন বছরের শিশুকন্যা সুপ্রিয়া গোস্বামীও।ওই পরিবারের সাথে সনাতনের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক থাকার সুবাদে মঙ্গলা ও তাঁর শিশুকন্যাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে অভিযুক্ত সনাতন গোস্বামী। গ্রামবাসীরা জানান মূলত অবসর নেওয়ার পর ঝাড়ফুঁক, বশিকরণ,ওঝাগিরি করতেন সনাতন। সেইসঙ্গে খোল কীর্তন বাজিয়ে ধর্মীয় গানও গাইতেন তিনি।
    ২০১৭ সালের ১১জুলাই, দুসপ্তাহ র বেশি সময় ধরে দিনের অধিকাংশ সময় কান্নাকাটি করতো। সঙ্গে জ্বর, সর্দি কাশি উপসর্গ নিয়ে ভুগছিল সাড়ে তিন বছরের ওই শিশুকন্যা সুপ্রিয়া গোস্বামী । কিন্তু বাচ্চাটির চিকিৎসা করাতে নারাজ ছিল শিশুটির মা মঙ্গলা গোস্বামী।

    তারপরই সনাতনের পুত্রবধূরা চাপ দেয় চিকিৎসা করানোর কিন্তু তার পরেও কথা শোনেনি তারা।এর পরেই  প্রতিবেশী মহিলারা সনাতনের বাড়িতে জড়ো হয়ে শিশুটির চিকিৎসা করানোর চাপ দিতে শুরু করে।এমনেই একদিন পুরুলিয়ার মফস্বল থানার একটি পুলিশ গাড়ি গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, পুলিশ কর্মীরা মহিলাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘটনাস্থলে এসে তাদের বাড়িতে ঢুকে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। এরপরই পুলিশ গাড়িতে করে  জ্বর, সর্দি কাশি উপসর্গ নিয়ে পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালে (বর্তমানে পুরুলিয়া মেডিক্যাল কলেজে)মেডিক্যাল কলেজ & হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশুকন্যাকে । শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ দীনবন্ধু সাহানার নেতৃত্বে চিকিৎসা চলছিল শিশুটির।

    চিকিৎসার পরেও তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় সন্দেহ হয় চিকিৎসকদের। তারপরই হাসপাতালে এক্সরে রিপোর্ট দেখে চমকে উঠেন চিকিৎসকরা।দেখা যায় ওই শিশুর পাঁজরে, তলপেটে ও যৌনাঙ্গে মোট ৭ টি সূচ রয়েছে ।এই ঘটনাটা জানাজানি হতেই এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত সনাতন ঠাকুর ১২ জুলাই পুরুলিয়া থেকে পালিয়ে যায়। ১৪ জুলাই সনাতন ও মঙ্গলার বিরুদ্ধে জেলা চাইল্ড লাইনের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের করা হয় পুরুলিয়া মফস্বল থানায়।ওইদিন সন্ধ্যায় পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

    সেখান থেকে ১৫ জুলাই অর্থাৎ পরের দিন আবার স্থানান্তর করা হয় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানে তিন দিন পর্ষবেক্ষনে রাখা হয় ওই শিশুকন্যাকে।অবশেষে ১৮ জুলাই কলকাতা এসএসকেএমে অস্ত্রোপচারে বের হয় ৭টি সূচ। কিন্তু বাঁচানো যায়নি তাঁকে। ২০ জুলাই রাতে এসএসকেএম হাসপাতালে মৃত্যু হয় ওই শিশুকন্যার। ২১ তারিখ ময়নাতদন্ত হয় বাঙ্গুর হাসপাতালে। এই ঘটনায় জেলা থেকে রাজ্য এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতীবাদ ধিক্কারের ঝড় ওঠে।

    পুরুলিয়া মফস্বল থানায় সনাতন ঠাকুর ও মঙ্গলা গোস্বামীর বিরুদ্ধে খুন, ষড়যন্ত্র, তথ্য গোপন, যৌন নিগ্রহ সহ একাধিক মামলা রুজু করা হয় মামলা । ২২ জুলাই রাতে অভিযোগের ভিত্তিতে শিশুর মা মঙ্গলা গোস্বামীকে গ্রেফতার করে মফস্বল থানার পুলিশ।তাঁকে জেরা করে হাড় হিম করা ঘটনার কথা জানতে পারেন তদন্তকারী আধিকারিক।জানা যায় এই কান্ড ঘটিয়েছে তাঁর প্রেমিক সনাতন।

    এই মামলায় মূল অভিযুক্ত সনাতন গোস্বামীর খোজ পেতে তৎকালীন পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে  ৪ জন পুলিশ কর্মীর একটি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়।ওই অভিযুক্তরা খোঁজে প্রথমে তারা পাড়ি দেয়  দিল্লি ও পরে উত্তরপ্রদেশ। উত্তরপ্রদেশের শোনভদ্র জেলার পিপ্রী থানার রেনুকোট ফাঁড়ির অধীনে বালাজি ক্যাবেলসের ৫ টি কারখানা রয়েছে । ওই সমস্ত কারখানায় মোট ৫ লক্ষ কর্মচারী কাজ করত ।সেখানে তাদের কম্পিউটার থেকে কর্মীদের লিস্ট বার করা হয় । সেখানেই সনাতন ঠাকুরের আত্মীয়র খোঁজ পাওয়া যায়।এর পরেই ওই আত্তীয়র আবাসনের নম্বর নিয়ে পুলিশ হানা দেয়। সেখানেই বাড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় সনাতনকে।

    পরের দিন ওই জেলার রবার্টগঞ্জ কোর্টে তাকে পেশ করা হলে বিচারক তাকে ৬ দিনের ট্রানজিট রিমান্ড দেয়।এর পর ট্রেনে করে তাকে পুরুলিয়ায় নিয়ে এসে পুরুলিয়া আদালতে তোলা হয়। সনাতন গোস্বামীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডবিধি ৩২৩/ ৩০৭/৩৭৬/৩০২/২০১ ও ১২০বি এবং পকসো আইনের ৬ নম্বর ধারায় মামলা চলে এবং শিশুকন্যার মা মঙ্গলা গোস্বামীর বিরুদ্ধে ৩২৩/ ৩৭৬/৩০২/ ২০১/ ১২০বি এবং পকসো ১৮ নম্বর ধারা দেওয়া হয় । ঘটনার ৫৭ দিনের মাথায় ১২ সেপ্টেম্বর পুরুলিয়া জেলা আদালতে প্রায় ৫৫০ পাতার চার্জশিট পেশ করেন এই ঘটনার তদন্তকারী আধিকারিক সব ইন্সপেক্টর গোপাল মান। ওই চার্জশিটে ৩৭ জন সাক্ষীর নাম উল্লেখ থাকে । তাদের মধ্যে ১৭ জন চিকিৎসক, একজন সিনিয়র নার্স এবং  পুলিশ কর্মী ছাড়াও সনাতনের পুত্রবধূরাও সত্য ঘটনাই আদালতের কাছে  সাক্ষ্য দেন।

    এই নৃশংস ঘটনার পর সনাতনের পরিবার এতটায় ক্ষুব্ধ ছিল যে তার সপক্ষে কোনো আইনজীবী দেননি।ফলে বিধি অনুযায়ী ডিএলএসএ থেকে তাদের দুজনের জন্যে আইনজীবী নিয়োগ হয়। চার বছর কাস্টডি ট্রায়াল চলার পর গত শুক্রবার এই মামলায় পুরুলিয়া জেলা আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক দ্বিতীয় আদালতের বিচারক রমেশ কুমার প্রধান ওই  দুজনকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। তাদের বিরুদ্ধে ৩০২/১২০বি/৩৪ আই পি সি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন।
    এই মামলায় সোমবার সাজা ঘোষনার দিন ধার্য করা হলেও সরকারী আইনজীবীর দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির আবেদনের পর রায় দানে বিরত থাকেন। বিচারক জানান মঙ্গলবার এই মামলার রায় ঘোষণা করবেন। সেই মতো এদিন দুপুর ১টায় এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত দুজনকে কড়া নিরাপত্তা সহকারে আদালতের এজলাসে নিয়ে আসা হয়।এজলাসে ২ মিনিটের মধ্যেই তাদের সাজা শুনিয়ে দেন বিচারক।

    এটি একটি বিরলতম খুনের ঘটনা। যে মায়ের কোল সব থেকে সুরক্ষিত মনে করেন শিশুরা সেই কোলেই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠল বলে মণে করেন এই মামলার সরকারী আইনজীবী আনোয়ার আলী আনসারী ও অরূপ ভট্টাচার্য। সেই জন্যই তাদের দুজনকেই মৃত্যু দণ্ডের নির্দেশ দিলেন বিচারক। এই রায়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই খুশি জেলাবাসী।পাশাপাশি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সনাতনের গ্রামের বাড়িতে তার ছেলে – বৌমারা।আদালত সূত্রে খবর,শেষ ৯০ এর দশকে পুরুলিয়া জেলা আদালতে একটি ঘটনায় মৃত্যু  দণ্ডের নির্দেশ হয়েছিল।

    লেখা —— অমিত সিং দেও

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    হেডের দুরন্ত সেঞ্চুরি WTC প্রথম দিনেই চালকের আসনে অস্ট্রেলিয়া।

    দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : হেডের দুরন্ত সেঞ্চুরি প্রথম দিনেই চালকের আসনে অস্ট্রেলিয়া। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে টসে জিতে রোহিত শর্মা ফিল্ডিং...

    কোচ হতে চলেছেন ‘কলকাতার মহারাজ’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ১৪ ম্যাচে মাত্র পাঁচটি জয়। ১০ পয়েন্ট নিয়ে নয় নম্বরে শেষ করেছিল দিল্লি ক্যাপিটালস। তখনই দেওয়াল লিখন...

    ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের শ্রদ্ধা নিবেদন ভারতীয় ক্রিকেট দলের ।

    দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল শুরু হওয়ার আগে ভারতীয় ক্রিকেট দল বালেশ্বরে হওয়া ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ব্যাক্তিদের উদ্দেশে...

    অভিষেকের বিরুদ্ধে পোস্টার খোদ সিঙ্গুরেই ।

    দ্য কালকাটা মিরর ব্যুরো : এবার অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে পোস্টার পড়লো তৃণমূল কংগ্রেসের ভিত্তিভূমি খোদ সিঙ্গুরের । ' চোর ডাকাতের যুবরাজ নট...

    ১০০ দিনের কাজ নিয়ে কেন্দ্রকে তলব কোলকাতা হাইকোর্টের ।

    দ্য কালকাটা মিরর ব্যুরো : ১০০ দিনের কাজের টাকা নিয়ে কেন্দ্র রাজ্য তরজা লেগেই ছিলো । একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানির পর কোলকাতা...