দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো:আজ দোল পূর্ণিমা। চৈত্র মাসের দাবদাহ থাকা সত্ত্বেও আজ সবার মন নানা রঙে রঙিন। দোল এক অপূর্ব সুন্দর উৎসব। বহু বছর ধরে এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উনিশ শতকে বাবুদের আমলেও হত এই উৎসব। দেখা যাক তার রূপটি কেমন ছিল। শোনা যায় যে প্রথম যখন ফিরিঙ্গীরা আমাদের দোল উৎসব দেখেছিল, যেখানে ছেলেরা মেয়ে সেজে নৃত্য করছে, তারা অবাক হয়েছিল। বাবু আমলের কলকাতার হোলি উৎসব প্রায় মদনোৎসবের বা কামোৎসবের রূপ নিয়েছিল।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরে এক শ্রেণীর মানুষ ক্ষমতায় আসা ইংরেজদের সাথে ব্যবসা শুরু করে। কারুর ছিল নিমক মহল তো আবার কেউ করতেন মশলা আর কাপড়ের ব্যবসা। অনেকে আবার এই সরকারের অধীনে বেশকিছু পদ পেয়েছিলেন। যেমন তালুকদার, জমিদার, ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার বেনিয়া ছিলেন। এসব করে তাঁরা প্রভুত অর্থ উপার্জন করে রেখে গেলেন। এঁরা হলেন বাবুদের প্রাণপুরুষ বা পূর্বপুরুষ। এঁদের পরবর্তী প্রজন্ম হলো আসল বাবু। দিনে বুলবুলির লড়াইয়ে আর রাতে বাঈজী বাড়িতে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন এঁরা। ঝাড়বাতি, আতর, সুরা সবমিলিয়ে এক স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি হত সেখানে।
বাগানবাড়ি ছিল বাবুদের আমোদ-প্রমোদের প্রধান স্থান। দোলের ক্ষেত্রেও তাই হত। কারুকার্য করা রুপোর রেকাবিতে আতর মেশানো আবীর রাখা থাকত। রুপোর পিচকারিতে থাকত সুগন্ধী রঙিন জল আর গ্লাসে থাকত রঙিন পানীয়। সব মিলিয়ে বেশ আনন্দেই কাটত হোলি। বন্ধুদের সাথেই থাকতেন তাঁরা এদিনে।
ঈশ্বর গুপ্ত বাবুদের রঙ খেলার বিবরণ দিতে গিয়ে বলছেন, “ক্রমেতে হোলির খেলা, নবীনা নাগরী মেলা, ছুটে মুটে যায় এক ঠাঁই। …যার ইচ্ছা হয় যারে, আবির কুমকুম মারে, পিচকারি কেহ দেয় কায়। উড়ায় আবীর যত, কুড়ায় লোকেতে কত, জুড়ায় দেখিলে মন তায়। ঢালিয়া গোলাপ জল, অঙ্গ করে সুশীতল, মাঝে মাঝে হয় কোলাহল।” এখানে থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় তাঁদের দোলযাত্রা কেমনতর হত।
আজকের দিনের মতো তখনকার দিনেও দোলের দিনে গরিব বড়লোক নির্বিশেষে সবাই আবেগে মেতে উঠতেন। কারুর জামা রঙ ছাড়া থাকত না। সাদা পাঞ্জাবিতে রঙের ছাপ বেশ লাগত। এ বিষয়ে ইতিহাস বলছে, ‘সে সময়ে কোনও ব্যক্তির বেদাগ বস্ত্র থাকিত না, দলে দলে মিছিল বাহির হইতেছে, পিচ্কারি ও আবিরে পথঘাট ঘরবাড়ি লালে লাল হইয়া যাইতেছে।’
লখনৌর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ মেটিয়াবুরুজে আসার পর তাঁর সতীর্থদের সাথে জমিয়ে দোল খেলতেন। এই উপলক্ষে একাধিক গান ও নাটক রচনা করেছেন তিনি। শোনা যায় যে তিনি গোপিনীদের মাঝে নিজেই কৃষ্ণ সেজে থাকতেন। সত্যজিৎ রায়ের ” সত্রঞ্চ কে খিলাড়ি ” চলচ্চিত্রে এই দৃশ্য আমরা দেখতে পাই।
বাবুদের কোনো উৎসব গানবাজনা ছাড়া সম্পূর্ণ হত না। বাঈনাচ , ঠুমরি , দাদরা ইত্যাদি না হলে আসর জমত না। গহরজান , নিকি , মলকাজান , হীরা বুলবুল প্রমুখ ব্যক্তিরা আসতেন গান শোনাতে। শোনা যায় যে মেঝেতে আবীর দিয়ে তার ওপরে কাপড় দিয়ে দেওয়া হত। তার ওপরে নাচ হত। নাচের শেষে কাপড় তুলে দেখা যেত যে আবীরের মধ্যে ফুলের ছবি ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবে। কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত গান রয়েছে হোলি নিয়ে, ” ব্রজগোপী খেলে হোরি…”। কোথাও আবার ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর বসত।
আরও পড়ুন:তুমিও ঘুরে দেখ কলকাতাঃ পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বাড়ির গল্প!- সায়নদীপ ঘোষ
আজকের মতো তখনকার দিনেও চটুল পরিবেশনার সাক্ষী ছিল বাবু আমলের কলকাতা। ঐতিহাসিকরা বলছেন, ‘…মিছিলওয়ালারা সুশ্রাব্য ও অশ্রাব্যগীতিতে পাড়া মাতাইয়া এবং নরনারী যাহাকে সম্মুখে পাইত, তাহাকে আবির ও পিচকারিতে ব্যতিব্যস্ত করিয়া চলিয়া যাইত। এমন অশ্রাব্য গীত এবং কুৎসিত সং প্রকাশ্যে পথে বাহির করিতেন যে, এখনকার লোকে তাহা কল্পনা করিতে পারে না। কর্তারা কিন্তু তাহা লইয়া আমোদ করিতেন। গৃহিনীও বালক-বালিকাদের সহিত শ্রবণ ও দর্শন করিতেন।’
তবে আর যাই হোক, এই বাবুরা ছিলেন ধর্ম অন্তঃপ্রাণ। এইদিনে তাঁদের বাড়িতে বড় করে পুজো হত। বেশিরভাগ বাড়িতেই রাধাগোবিন্দের বিগ্ৰহ বর্তমান ছিল। যেমন বাগবাজারের গোকুল মিত্রের বাড়ি। নানান রকমের মিষ্টি তৈরি হত। সরবত তৈরি হত। এই নিয়ম আজকের দিনেও রয়েছে কিছু পরিবারে।
আজকে বাবুরা আর নেই, নেই তাদের বিলাসিতাও। কিন্তু ঐতিহ্যের দোলযাত্রা আর হোলি উৎসব রয়ে গিয়েছে। সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে আনন্দ করছে। বসন্ত কালে বসন্ত উৎসবের রঙিন আভা যেন সেকাল আর একালের এক অসামান্য যোগসূত্র।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা : বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য , ঈশ্বর গুপ্ত , আনন্দবাজার পত্রিকা।