দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরোঃ সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার অভিশাপ হলো ডিভোর্স। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির, সমাজের মেরুদন্ড কে জর্জর করে দিয়েছে এই ‘অন্ধকার অভিশাপ’। এই প্রক্রিয়া শুধু একটি সম্পর্ক বা দুটি মানুষের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায় তাই নয়, বিচ্ছেদ ঘটায় সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের, বিচ্ছেদ ঘটায় দুটি পরিবারের, অধিকারের, অভ্যাসের। তবে ডিভোর্সের আরও করুণ পরিস্থিতি দেখা যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে।
এইসব দেশে, কারো ডিভোর্স হলে সমাজ প্রথমেই তার গায়ে কালো দাগ লাগিয়ে দেয়। তার পরিবারের সম্মান কে ‘খেলো’ করা, ওই সমাজের অন্যান্য মানুষগুলি নিজেদের অধিকার ভাবতে শুরু করে। সবথেকে হাস্যকর বিষয় হল- যে দুটি মানুষের ডিভোর্স হলো, তারা দুজনেই তাদের সমাজে একইভাবে আক্রান্ত হন। দুজনেই তাদের সমাজের কাছে দোষী, চরিত্রহীন প্রতিপন্ন হন। যার সরাসরি প্রভাব পড়ে পরিবার দুটির উপর। তাদের বাবা-মা ও পরিবারের লোকজন হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করেন। তারাও দোষ দিতে থাকে ওই দুটি বিপর্যস্ত মানুষকে। তারাও ভাবতে শুরু করে তাদের মাথা হেঁটের কারণ তাদের সন্তানরা। সেজন্য যখন সাপোর্ট সিস্টেম হয়ে পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন, তখন তারা দোষ নির্ণয় করতে বেশি সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। এবং কার্যত মানুষটাকে এক ঘরে করে দেওয়া হয়। তাকে ভাবতে বাধ্য করা হয় সে তাদের জীবনের কলঙ্ক।


তাই বিবাহ বিচ্ছেদের পর অনেক সময় মানুষগুলি চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আবার কেউ সারা জীবন একা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। তার মনের আঘাত থেকে ভয়ের সঞ্চার হয়, যার ফলে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে নেয় সারা জীবনের জন্য। সে হাসতে ভুলে যায়, দ্বিতীয়বার কারো সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়।
পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়, যদি তাদের সন্তান থাকে। কারণ তাদের জীবনে হঠাৎ করে ‘দুটি দেশের কাঁটাতারের মতো’ তাদের প্রিয় মানুষ গুলোর মধ্যে একটি অদৃশ্য কাঁটাতার লাগিয়ে দেয়া হয়। তাকে তার প্রিয় মানুষগুলোর কাছে যেতে হলে- সময়ের, অনুমতির, অপেক্ষা করতে হয়। তাদের স্কুলের সহপাঠী, থেকে পার্কের বন্ধু, খেলার সাথী সবকিছু এক নিমেষে বদলে যায়। যার ভয়ঙ্কর প্রভাব, চিরতরে নষ্ট করে দেয় তাদের শৈশবকে। কখনো কখনো তারা বিবাহের মত পবিত্র সম্পর্ককে ভয় পেতে শুরু করে। সারা জীবন নিজেকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, স্বাভাবিক জীবন কাটাতে ভুলে যায়।


যদিও বর্তমানে এই পরিস্থিতি একটু একটু করে বদলাচ্ছে। সুশিক্ষিত সমাজব্যবস্থা তাদেরকে অগ্নিচক্ষুর বদলে বোঝার চেষ্টা করছে। তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করার চেষ্টা করছে। তবে, এই সমস্যা তখনই দ্রুত সমাধান হবে; যখন বিবাহবিচ্ছেদ ঘটা দুটি ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারবর্গ বিষয়টি সহজ করে দেখতে পারবেন। নিজেদেরকে অপরাধী না ভেবে, একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর মিথ্যা চেষ্টা না করে, একে অপরের দিকে কাঁদা না ছুড়ে, পরস্পর পরস্পরের সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে পারবেন।
ডিভোর্সের কারণ অনেক কিছুই হতে পারে। সেটা নিজেদেরকে ভালো রাখতে চাওয়া থেকে শুরু করে, মতবিরোধ। অনেক সময় নিজেদের শ্রেষ্ঠ টা দেওয়ার পরও, মনের মতো ফল বা সম্মান পাওয়া যায় না। তখন সেখান থেকে সরে আসাটা কিছু দোষের নয়, বুঝতে হবে। মনের অমিল বা বিশ্বাস এর ঘাটতি থাকলে, সম্পর্ক বোঝা মনে হতে শুরু করে। কারণ মন সুস্থ, আনন্দিত না থাকলে, টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ির সুখ, শুধু কর্কশ কংক্রিটের স্তুপ মনে হতে থাকে, তখন সেখান থেকে সরে আসাটা অসম্মানের কিছু নয়। কারণ মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে, একটা সময় পর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে বাধ্য।
তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভালোভাবে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা ভীষণ প্রয়োজন। কারণ এই একটি সিদ্ধান্ত জীবনকে আমূল পরিবর্তন করে দেবে প্রয়োজনে একসঙ্গে ভালো সময় কাটাতে হবে। দরকারে সমস্ত তিক্ততা ভুলে ভালো আছি ভেবে, সম্পর্কের সুন্দর সময় গুলিকে মনে করে, আবার তেমনভাবে সময় কাটাতে হবে। বেশি বেশি করে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে হবে। অভিমান, রাগ কে দূরে সরিয়ে রেখে মনের কথা খুলে বলতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য, পুরোপুরি সচেষ্ট হতে হবে। তারপর সবকিছু পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এবং একে অপরের মতামতকে সম্মান করতে হবে।


তবে সম্পর্ক ভেঙে গেলে হতাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে হবে। নিজেই নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। জীবনকে আবার নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করতে হবে। বর্তমানে উন্নত চিন্তাধারার ছেলে ও মেয়েরা, সমাজের চোখ রাঙানি কে পরোয়া না করে, একজন বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া মানুষের হাত ধরতে এখন আর পিছুপা হচ্ছে না। তাই তাদের সঙ্গে জীবন শুরু করা যেতেই পারে। নিজেকে অপরাধী ভাবার প্রয়োজন নেই। একবার খারাপ অভিজ্ঞতা হওয়া মানেই পরবর্তীতে ও সব খারাপ হবে এমন কোনো কারণ নেই।
সব সময় মনে রাখতে হবে একটি খারাপ সম্পর্ক ও অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। অনেক ভালো মুহূর্তের স্মৃতি দেয়। তবে পুরানো ভুলগুলি বুঝে নিয়ে, যাতে কোনো ভাবেই সেগুলি রিপিট না হয়, খেয়াল রাখতে হবে। নিজের ধৈর্য্য, সহ্য ক্ষমতা বাড়াতে হবে। অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। একটি আঘাত মানুষকে অনেক পরিণত করে দেয়। এই সব কিছুকে পাথেয় করে, জীবনের পথে এগিয়ে চলুন। নিজের জীবনের মাপকাঠি, নিজে ঠিক করুন। অন্য কারো কথায় প্রভাবিত হবেন না। নিশ্চয়ই সামনে আপনার জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
লেখা – তানিয়া তুস সাবা