দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরোঃ ‘রেড গোল্ড’ অর্থাৎ ‘লাল সোনা’ বলা হয় জাফরানকে। একটি অতি পরিচিত মূল্যবান মসলাজাতীয় খাবার যা প্রধানত খাবারে স্বাদ বাড়াতে এবং রং আনতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি একটি মূল্যবান প্রসাধনীও বটে। পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি জায়গাতেই পাওয়া যায় এই জাফরান। শুধু নামের সঙ্গে সোনা জোড়া নয়, জাফরানের ওজন ও করা হয় ‘ভরি’তে। ১ কেজি জাফরানের দাম প্রায় ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হয়।
বৈজ্ঞানিক ক্রোকাস স্যাটিভা(Crocus sativus) প্রজাতির একটি গাছ হল এই জাফরান গাছ। বিভিন্ন দেশে বা স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত জাফরান। তারমধ্যে পরিচিত কয়েকটি হলো স্যাফ্রন, জ্যাঁফারান, কেসার বা কেশর, জাফরান। কেশর আসলে ফুলের পুংকেশর। এক ধরনের বেগুনি রঙের ৬ পাপড়ি বিশিষ্ট একটি ফুল থেকে তা পাওয়া যায়। স্পেন, ইতালি, ইরান, কাশ্মীর জাফরান চাষের জন্য বিখ্যাত। জাফরানের উৎসভূমি মনে করা হয় ইরান কে। তবে কারো কারো মতে তা স্পেন। জাফরান উৎপাদনে ভারত তৃতীয় স্থানে আছে। জম্মু ও কাশ্মীরের পাশাপাশি এখন হিমাচল প্রদেশেও চাষ করা হয় জাফরানের।


তবে জাফরানের দাম সম্পর্কে সবারই একটা চাপা কৌতূহল আছে। যে, সামান্য একটি জিনিসের এত দাম কিভাবে হয়? চলুন সেটাই জেনে নেওয়া যাক এবার। এই ক্রোকাস ফুল হেমন্তকালে মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য ফোটে। ছয় পাপড়ি বিশিষ্ট বেগুনি রঙের এই ফুলটি সকালের সূর্যোদয়ের সাথে প্রস্ফুটিত হয়, আবার সূর্যাস্তের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যায়। একেকটি ফুলে মাত্র তিনটি করে পুংকেশর থাকে। এই পুংকেশর গুলি ওই সময়ের মধ্যেই সংগ্রহ করতে হয় এবং পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় স্বহস্তে। কোন মেশিনের সাহায্য নেওয়া যায়না এ কাজের জন্য।
ফুলগুলি সংগ্রহ করে অতি সাবধানের সঙ্গে ফুল থেকে পুংকেশর গুলিকে আলাদা করে নিতে হয়। তারপরে সেগুলিকে এয়ারটাইট পাত্রে রেখে, শুকিয়ে নিয়ে তৈরি করা হয় এই জাফরান বা কেশর। ১৫০ টি ফুল থেকে পাওয়া যায় মাত্র ১ গ্রাম কেশর। ১ কেজি জাফরান পেতে হলে ১ লাখ ১০ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার ফুলের প্রয়োজন হয়। আবার ৭২ গ্রাম তাজা কেশর কে শুকালে তা থেকে মাত্র ১২ গ্রাম জাফরান পাওয়া যায়।


১ কেজি জাফরান পেতে যে পরিমাণ ফুল এর প্রয়োজন হয় তা সংগ্রহ করতে সময় লাগে প্রায় ৪০ ঘন্টা। যা প্রায় দুটো বড় ফুটবল মাঠের সমান জায়গা জুড়ে চাষ করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি তে কোন অটোমেশনের সুযোগ নেই, সে কারণেই জাফরানের দাম এতো আকাশ ছোঁয়া। এই গাছের কোনো বীজ হয় না। ক্রোম থেকে নতুন চারা তৈরি করতে হয়। ক্রোম গুলো মাত্র এক বছর বেঁচে থাকে।


অতীতকালে রাজা-বাদশাদের পরিবারে এই জাফরান ছিল একটি অতি প্রয়োজনীয় নিত্য উপাদান। জাফরান কে তারা সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করতো। রূপচর্চার জন্য ব্যবহার করতো এবং ব্যবহার হতো খাবারে। সুগন্ধির দিক থেকে সেরা জাফরান পাওয়া যায় স্পেনের লা- মাঞ্চা অঞ্চলে। এই জাফরান প্রধানত দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে ‘মাঞ্চা’ আর দ্বিতীয়টি ‘ক্যুপে’।


স্প্যানিশ সরকারের স্বীকৃতিতে সেরা হচ্ছে ‘ক্যুপে’। আবার ‘মাঞ্চা’র জনপ্রিয়তা উজ্জ্বল লাল রং এর জন্য এবং সুন্দর হালকা সুবাস এর জন্য। তবে রঙের জন্য আলাদা সুখ্যাতি রয়েছে ইরানি জাফরানের। যা অন্যান্য দেশের জাফরানের তুলনায় অতুলনীয় সুন্দর দেখতে। যদিও দামের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে সস্তা ইরানি জাফরান। তাই বাজারে বিভিন্ন ব্লেন্ডিং এ তা কিনতে পাওয়া যায়।
জাফরান বাজার থেকে কেনার সময় এর গন্ধ এবং রঙের দিকে খেয়াল রাখলে আসল জাফরান আপনিও সহজেই চিনে কিনতে পারবেন। প্রচুর নকল জাফরান বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। খোলা জাফরান না কিনে প্যাকিং করা লেবেল লাগানো জাফরান কেনাই ভালো। এয়ারটাইট পাত্রে করে ঠাণ্ডা জায়গাতে রেখে দিলে অনেকদিন পর্যন্ত তা ভালো থাকবে। ১ গ্রাম ভারতীয় জাফরানের সর্বনিম্ন দাম ৭৯ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫৭০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।


জাফরানের উপকারিতা:
শুধু সুগন্ধ, বা দামের দিক থেকেই উল্লেখযোগ্য নয় বিশ্বের এই সব থেকে দামী মশলা। এর ঔষধি গুণ অপরিসীম।জাফরানের প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে, স্বাস্থ্যগুণও অনেক। অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি ফাঙ্গাল, ম্যাংগানিজ রয়েছে জাফরানে, যা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে।এতে থাকা ভিটামিন-C, শরীরকে ইনফেকশন বা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও দৃষ্টিশক্তি, ত্বক ও চুলের জন্য ভীষণ উপকারী।
** জাফরানে ক্রোসিন নামক এক ধরনের ক্যারোটিন থাকে। এই ক্রোসিন কেমোথেরাপিউটিকের এজেন্ট। যা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সাহায্য করে। ফলে জাফরান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
**জাফরানের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি উপাদান বাতের ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা সারিয়ে তুলতে পারে। শারীরিক দূর্বলতা কাটাতে এটা দারুণ কাজ দেয়।
**জাফরান রেটিনার ক্ষয় রোধ করে এবং ছানি পড়া রোধ করে দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে।


**জাফরানে রয়েছে ক্যালসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং শরীরের প্রয়োজনীয় হরমোন বিকাশ করে, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায় এবং উচ্চ রক্তচাপ কমাতেও ভীষণ ভাবে কার্যকরী। জাফরানে থাকা পটাশিয়াম হার্টের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে।
**মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য জাফরান ভীষণ ভাবে উপযোগী।আলজাইমার এবং পার্কিনসন রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে,মানসিক চাপ ও বিষন্নতা মুক্ত রাখে। ও মস্তিষ্ককে রিল্যাক্স রাখে।
আরও পড়ুন : বিবাহ-বিচ্ছেদ মানে সামাজিক বিচ্ছেদ নয়। নতুন করে উড়ান ভরুন আবার
**হজমের সমস্যা, ওজন কমাতে, যেকোনো ধরনের কাটা, পোড়ার ক্ষত সারাতে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, পিরিয়ডের সময়ের ব্যথা-যন্ত্রণা হাত থেকে রক্ষা করে, লিভারকে সুরক্ষিত রাখে, যৌন ক্ষমতা বাড়ায়, ত্বক উজ্জ্বল করে, ত্বক ময়েশ্চারাইজ করে, চুল পড়া কমিয়ে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে, অনিদ্রা দূর করে, সর্দি – কাশিতেও যথেষ্ট উপকারী জাফরান।


জাফরানের অপকারিতা:
এতো উপকারী হওয়ার পাশাপাশি, অপরিমিত ব্যাবহারে জাফরানের প্রচুর ক্ষতিকারক দিক রয়েছে। যেমন – জাফরানের ধরণ গরম প্রকৃতির। বেশি পরিমাণে শরীরে গেলে ডায়ারিয়া,জন্ডিস বা ঠোঁট, নাক, বা চোখের পাতা থেকে রক্ত ক্ষরণ ঘটাতে পারে। শারীরিক অস্থিরতা, মাথা যন্ত্রণা, বমি, মাথা ঘোরার সমস্যাও হতে পারে। জাফরানের বেশি সেবনের ফলে ফুসফুস ও কিডনি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। গর্ভবতী মহিলারা ৫ গ্রামের বেশি জাফরান খেয়ে ফেললে তা জরায়ু সংকোচন ঘটিয়ে গর্ভপাত ঘটাতে সক্ষম।
ছোটো বড়ো সবার খাদ্য তালিকাতে জাফরান রাখা যেতেই পারে। তবে জাফরান ব্যাবহার করার আগে অবশ্যই তার পরিমাণ সম্মন্ধে সঠিক ধারণা রাখতে হবে। না হলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।
লেখা – তানিয়া তুস সাবা
***************************************************************************************************