২০০২ সাল। আন্তর্জাতিক আইন সম্মেলন হবে দিল্লিতে।একই উড়ানে আমি,বাংলাদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডঃ কামাল হোসেন, নেদারল্যান্ডের আইনের অধ্যাপক নিক্ক স্কাইভার আর অধ্যাপক পল ডি ওয়াট্র যাচ্ছি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।আর সবার দেকভাল করছেন রাম নিরঞ্জন ঝুনঝুনওয়ালা। উড়ানে চলাকালীনই ডঃ হোসেন আমি ব্যাঙ্গালর ল স্কুলের মানবাধিকার আইনের ছাত্র শুনে খুশি হলেন। বোধহয় আরও প্রফুল্ল হলেন আমার সম্পাদিত বইয়ের উদ্বোধন জেনে। করবেন স্বয়ং ব্রিটিশ বিচারপতি গরডন স্লাইন( LAW LORD of appeal, HOUSE OF LORDS)।কথায় কথায় এল কেশবানন্দের মামলা।তাঁর কথাতেই জানা গেল যে ১৯৮৯ সনে বাংলাদেশ সরকারও নাকি সেই মামলার মূল বিষয়টি তাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে (আনয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ)।


লেখকস্মরজিত রায় চৌধুরী
কে এই কেশবানন্দ?
১৯৪০ সালের ৯ই ডিসেম্বর এই যোগী পুরুষের আবির্ভাব।মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি সন্ন্যাস নিয়ে তার দুবছর পর কেরালার এদনীর মঠের প্রধান হন। আদি শঙ্করাচার্যের প্রথম চার শিষ্যের অন্যতম শ্রী থতাচারিয়া এই মঠের প্রতিষ্ঠাতা। কাসরগড জেলার মধুবাহিনি নদীর ধারে এই মঠে অদ্বৈত মতে দক্ষিণামূর্তি আর গোপালের পূজো হয়। ইনি স্মারথ ভগবতের অদ্বৈত দর্শনে বিশ্বাসী। পাশাপাশি কর্ণাটকি সংগীতে তাঁর দক্ষতা নাকি অসাধারন।
১৯৭০ সালে তিনি কেরালা ল্যান্ড রিফরমস (সংশোধনী) আইন ১৯৬৯ কে সংবিধান বিরোধী দাবি করে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন(wp/c/135/1970)।তার দাবি এই আইন চালু হলে মঠের সব সম্পত্তি হাতছাড়া হবে। সে সময় তাঁর আইনজীবী ছিলেন এম কে নাম্বিয়ার,কে কে বেনুগোপালের বাবা। পরে মামলা লড়তে আসেন ননি পাল্কিওয়ালা, সহযোগী ছিলেন ফলি নরিম্যান ও সোলি সোরাবজি।
মামলার বিষয়ঃ
মামলায় সওয়াল করতে গিয়ে তাঁরা বলেন এই আইন প্রয়োগ হলে সংবিধানের ২৫,২৬,১৪,১৯(১)(এফ) ও ৩১ অনুচ্ছেদ খর্ব হবে।মামলা থাকাকালীন ফের কেরল সরকার ওই আইনে সংশোধনী আনে যা রাষ্ট্রপতি ছাড়প্ত্র দেন ১৯৭১ সালের ৭ ই আগস্ট।মামলা শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর ।সেই প্রথম ১৩ জন বিচারপতির কাছে মামলার শুনানি শুরু হয়।পাল্কিওয়ালা বলেন ৬৭ সালের গোলোকনাথ মামলার(Golok Nath vs.State of Punjab /AIR 1967 SC 1643) রায় অনুযায়ী দেশের সংসদ সংবিধানের মূল পরিকাঠামোর কোন পরিবর্তন করতে পারে না।কারন সেই আদেশ দিয়েছিল ১১ বিচারপতির বেঞ্চ।তাই সম্পত্তির অধিকার খর্ব করা মানে মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা।এর আগে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সংবিধানের ২৪,২৫,২৬ ও ২৯ তম সংশোধনে মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ সহ সম্পত্তির অধিকার,রাজন্য ভাতা তুলে দেওয়া ও ভুমি সংস্কার আইনের সংশোধন করেন ৫ ই নভেম্বর ১৯৭১ থেকে ৯ ই জুন ১৯৭২ এর মধ্যে(আজ অবধি মোট ১০৪ বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে)। ফলত একের পর এক মামলা শুরু হয়।আর সি কুপার বনাম ভারত সরকার( ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ ),মাধব রাও বনাম ভারত সরকার (রাজন্য ভাতা)।এই সব কিছুই কেশবানন্দ মামলায় উঠে আসে।টানা ৬৮ দিন শুনানির পর ২৪শে এপ্রিল ১৯৭৩ সনে ৭০৩ পাতার আদেশে প্রধান বিচারপতি এস এম সিক্রি জানান সংবিধান হাজার বার সংশোধন করা যেতে পারে কিন্তু মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রাখতে হবে।মামলায় ৭ জন বিচারপতি পক্ষে ও ৬ জন বিপক্ষে ছিলেন। আদেশ দেবার পরদিনই বিচারপতি অবসর নেন।
মজার বিষয় এই যে মামলায় কিন্তু কেশবানন্দ হেরে যান কিন্তু সরকারও যে জিতেছে তা বোধহয় বলা যাবে না। আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত হল জিতেছে সংবিধান। সেই কেশবানন্দ মারা গেলেন গত রবিবার,হেরে গিয়েও যিনি আজও সবার কাছে চর্চিত। রায়ের ঠিক দুদিন পরে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হন আজিত নাথ রায় ।তিন জন বিচারপতিকে( যে এম শেলাত,কে এস হেগড়ে,এ এন গ্রভার) অতিক্রম করে তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই নিয়োগপ্ত্র দেয়। যা আজও ভারতীয় বিচারবিভাগের এক কালো দিন।প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মহম্মদ হিদয়তুল্লার এই নিয়োগকে “not creating forward looking judges but judges looking forward” বলে বর্ণনা করেন।ফের ১৯৭৭ সালে এম এইচ বেগকে প্রধান বিচারপতি করা হয় এইচ আর খান্নাকে অতিক্রম করে। সেই ট্র্যাডিশন অবশ্য আজও অব্যাহত। এইচ আর খান্নার ভ্রাতঃষ্পুত্র সঞ্জীব খান্নাকে ২০১৯ সালে সুপ্রীম কোর্ট কলিজিয়াম ৩৩ জনকে অতিক্রম করে দিল্লি হাইকোর্ট থেকে সুপ্রীম কোর্টে নিয়োগ করে যিনি প্রধান হবেন ঠিক ধনঞ্জয় চন্দ্রচুরের পরই।