

সালটা ১৯৯৬… ক্রিকেটে সদ্য হাতেখড়ি হওয়া কেনিয়া দুরমুশ করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। মাত্র ৯৩ রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল রিচি রিচারডসন, চন্দ্রপল, আথারটন আর ব্রায়ান চার্লস লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কেনিয়ার ১৬৬ রানের জবাবে মাত্র ৩৫ ওভারে শেষ হয়ে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হেরেছিল ৭৩ রানে। বিশ্বকাপের গ্রুপ লীগের শেষ ম্যাচ ছিল সেটা। পরের ম্যাচ কোয়ার্টার ফাইনাল। সেই ম্যাচের জন্য সব উত্তর জমিয়ে রেখেছিল “কালো ছেলেগুলো”। সেবারের বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার হ্যান্সি ক্রোনিয়ের দক্ষিণ আফ্রিকার উপর সব রাগ মিটিয়ে নিয়েছিল ওরা। মাত্র ৯৪ বলে ১১১ বেরিয়ে এসেছিল ব্রায়ান লারার ব্যাট থেকে। আর তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল চরম সত্যিটাই , “সাদাদের কাছে তো হারিনি”। কেনিয়া ম্যাচের পরে তার প্রতিভা নিয়েই তো প্রশ্ন তুলেছিল সাদা চামড়ার পৃথিবী।
জাতি ধর্ম বর্ণ কিংবা লিঙ্গের কোনও বৈষম্যে বা বিদ্বেষে আমার কোনও সমর্থন নেই। বরং যথেষ্ট ঘৃণা আছে। কিন্তু দিনের পর দিন এসব কারনে মার খেতে খেতে কেউ যদি উত্তর দিতে শেখে তার নিজের ভাষায় তখন হয়তো আমার অজান্তেই হাত দুটো এক হয়ে হাততালি দিয়ে ফেলে। ন্যাটওয়েস্ট এর ফাইনালে লর্ডস এর ব্যালকনিতে সৌরভ গাঙ্গুলি যখন খালি গায় জামা ওড়ায় তখন আমিও বদলামুখর হয়ে উঠি। কাইফ কিংবা যুবরাজের ব্যাটে তখন ভর করেছে তিতুমীর আর ভগত সিং এর আত্মা। ফ্লিনটফ কিংবা পিটারসেনের পূর্বসূরিরাই তো মিথ্যে বিচারে ওঁদের খুন করেছিল, ঝুলিয়েছিল ফাঁসির দড়িতে। দেশ পরাধীন হওয়া স্বত্তেও স্টিকের যাদুতে হকির মাঠে ধ্যানচাঁদ যখন ব্রিটিশের জ্বাল কাঁপিয়ে দিত তখন কি ওটা শুধুই খেলা থাকত ! পরাধীন ভারতের অবরুদ্ধ যন্ত্রণাও কি মুক্তি পেত না ধ্যানচাঁদের যাদুতে !
কি করবো ! আমি যে আসলে কালো চামড়ার একজন। নিজের রং বদলানোর সাবান নেই, নেই ইচ্ছেটাও।
তাই চুইং গাম চিবোতে চিবোতে যে ছেলেটা লিলি কিংবা থমসনকে মাঠের বাইরে ফেলে দেয় সেই আমার নায়ক। স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান রিচার্ডস। একবার ওঁর সেরা ইনিংসগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সব সাদা চামড়ার বিরুদ্ধে। এডি হেমিংসকে টানা চারবার মাঠের বাইরে ফেলেছিল কপিল দেব। টেস্ট ক্রিকেটে। টানা দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনের যন্ত্রণা থেকে কিছুটা মুক্তি কি ঘটেনি ? যুবরাজ সিং যখন ক্রিস ব্রডকে পরপর ছবার মাঠের বাইরে ফেলে দেয় তখন কি জালিয়ানওয়ালাবাগের শহিদদের আত্মাও মুক্তি পায় না?
না খেলা মানেই খেলা নয়। সব থেকে ভালো বোঝা যায় বক্সিং এর রিং-এ। রিং এর বাইরে যে ছেলেগুলোকে ঘৃণা দিয়েছো, থুতু ছিটিয়েছো শুধু কালো বলে… কিংবা যার দেশ পরাধীন বলে কেড়ে নিয়েছো যার রুটি … শুধু একবার … শুধু একবার যদি তাকে রিং এর মধ্যে পায় কোনও কালো ছেলে …তাহলে জমিয়ে রাখা সব ক্রোধ বেরিয়ে আসে মুক্তির আকাঙ্খা নিয়ে। হয়তো সেই অপরাধবোধ থেকেই সাদা চামড়ার কেউই বক্সিঙে আসতে চায় না। কিংবা ভয় থাকে কালো ছেলেদের কাছে বেদম মার খাওয়ার। অনেক চেষ্টা করেও বক্সিং এর রিং এর কোনও সাদা ছেলের নাম মনে করতে পারছি না … ব্রিজেন্দ্র, সুরেশ কিংবা মহম্মদ আলি থেকে টাইসন … সব কালো। আমার মত … সব বাঙালির মত… সব ভারতীয়র মত।
একই ঘটনা ফুটবলের মাঠেও। লাতিন আমেরিকার বস্তি থেকে উঠে আসা, ঠিকমত খেতে না পাওয়া যে ছেলেগুলো ন্যাকড়া জড়ানো বল নিয়ে কাটায় শৈশব তাদের মধ্যে থেকেই জন্ম হয় পেলে থেকে শুরু করে ভাভা, ডিডি, পাসারেলা, কেম্পেস, স্যানটোস, গ্যারিঞ্চা, রোনাল্ডিনহো থেকে শুরু করে হাল আমলের মারাদোনা কিংবা মেসি। নিখুঁত ড্রিবলিং দিয়ে সাদা চামড়ার পৃথিবীকে বল পায়ে নাচানোর ইচ্ছেটা ওঁদের আজন্মপ্রাপ্ত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। তাই ফুটবল মাঠে একের পর এক বিপক্ষকে ড্রিবলিং করার যে সাহস লাতিন আমেরিকার গড়পড়তা ফুটবলারের থাকে তা ইউরোপের পাওয়ার ফুটবলে পাওয়া যাওয়া না। এক আধজন ক্রুয়েফ, ইউসেবিও বা রোনালডো থাকলেও তা নিছক ব্যাতিক্রম বলেই গণ্য হয়। ইউরোপীয় হলেও উল্লিখিত তিনটি নামের প্রথম দুজনের শরীরেই রয়েছে কালো রক্তের উত্তরাধিকার। সেই কালো ছেলেগুলোই ফুটবল মাঠে আলোর নাচন দেখায়।
মাঠে ওরা আসে ছবি আঁকতে। ১৯৫০ সালের ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হেরে সুইডেনের কোচ মন্তব্য করেছিলেন, “আমার ছেলেদের কাছে রঙ আর তুলি দিলে বাড়ির পুরো বেড়াটায় আলকাতরার মত মাখাবে, ব্রাজিলের ছেলেদের হাতে দিন, ওরা মাটিতে মোনালিসা আঁকবে”। শুধু ট্রেনিং দিয়ে হয়তো ৯০ মিনিট একই গতিতে দৌড়ে যাওয়া শ্রমিক বানানো যায়, শিল্পী নয়। ১৯৯৪ সালে ডোপ নেওয়ার জন্য মারাদোনা নির্বাসিত হলেও তার ফুটবল কেরিয়ার তাই কলঙ্কিত হয় না। তার স্বদেশের নোবেল জয়ী সাহিত্যিক জোসে সারামাগো দাঁড়ান মারাদোনার পাশেই। বলে ফেলেন, ড্রাগ নিয়ে যদি শিল্পী হওয়া যায় তাহলে ফিফা নেশা করিয়ে আর একটা মারাদোনা তৈরি করে দেখাক।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনা করেছিলেন শতাব্দীর সেরা গোলটি। সেটা দ্বিতীয় গোল। কিন্তু মারাদোনার প্রথম গোলটি সবথেকে বিতর্কিত গোল। তিনি গোলটি হাত দিয়ে করেছিলেন কিনা জানতে চাওয়ায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মারাদোনা বলেছিলেন “ ওটা ঈশ্বরের হাত”। যেটা বলেননি তা হল দ্বিতীয়টি ঈশ্বরের পা। আসলে আহত, লাঞ্ছিত প্রতিভাকেই ঈশ্বর তার হাত-পা দিয়ে দেন চরম মুহূর্তে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।
তাই হেরে গেলে ওরা কাঁদে। ১৯৯০ এর ফাইনালে হেরে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ে মারাদোনা। ১৯৮৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইডেনে হেরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ে বিনোদ কাম্বলি। জীবনের সেরা পারফরম্যান্স করে অলিম্পিকে চতুর্থ হওয়ার পর কাঁদেন পি টি ঊষা।
কাঁদে জিতে গেলেও। সব পাওয়ার পরেও। ফ্ল্যাশব্যাকে চোখ চলে যায় ২০১১ র ২ এপ্রিল বিশ্বজয়ী ভারতীয় ক্রিকেটারদের চোখে। যুবি, হরভজনরা কাঁদছে স্বপ্ন ছোঁয়ার অপূর্ব যন্ত্রণায়। এই যন্ত্রণা বুকে নিয়েই তো বছরের পর বছর ধরে লাল বল হাতে ছুটছে হল, গ্রিফিথ, রবার্টস, মার্শালরা। উইকেট না পেলেও যে বলের গতিতে বারবার ছিটকে গেছে বিপক্ষের হেলমেট। জীবনে পাওয়া সব ঘৃণা ক্রোধ হয়ে বেরিয়ে আসে সবুজ মাঠে। প্রাকটিসে বেশি রুটি চেয়ে অপমানিত ছেলেটি হয়ে ওঠে কপিল দেব। সম্ভবত সেই ধারাবাহিকতার নতুন সংযোজন জোফ্রা আর্চার। হোক না ইংরেজ, গায়ের রঙ যে কালো…