দ্যা ক্যালকাটামিরর ব্যুরো: অসাধারণ কারিগরি নিপুণতা এবং নান্দনিক বয়ন নকশার “জামদানী” আমাদের তাঁতশিল্পের এক উজ্জ্বলতম উদাহরণ। মসলিনের পর সারাবিশ্বে আমাদের বয়নশিল্পের গৌরব ধরে রেখেছে এই জামদানী শাড়ী। এমন কোন বাঙালি মেয়ে বোধ করি খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যার আলমারীতে অন্তত পক্ষে একটি জামদানী শাড়ী খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আজ আমরা জেনে নেব এই জামদানীর সম্পর্কে কিছু তথ্য।
জামদানী আসলে আমাদের দেশীয় কার্পাস তুলো দিয়ে প্রস্তুত এক ধরনের পরিধেয় বস্ত্র। প্রাচীন কালের দামী মসলিনের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানী শাড়ী বাঙালি নারীদের অতি জনপ্রিয় বস্ত্র। ‘জামদানী’ নামের উৎপত্তি অনেকটাই অজানা। একটি মত অনুসারে ‘জামদানী’ ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফার্সি ‘জামা’ অর্থ কাপড়, আর ‘দানি’ অর্থ বুটি। সে অর্থে জামদানী অর্থ বুটিদার কাপড়।
আরেকটি মতে, ফার্সি ভাষায় ‘জাম’ এক প্রকার উৎকৃষ্ট মদের নাম এবং ‘দানি’ অর্থ পেয়ালা, যা খুবই শিল্পমণ্ডিত। অনেকের ধারণা, দুটো পন্যের উৎকর্ষতার কারণে রুপক অর্থে একই নাম ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসঃ খ্রিষ্টপূর্ব ষোড়শ সতকের ইতিহাসে দেখতে পাই , চন্দ্রগুপ্তের সভায় গ্রীকদূত মেগাস্থিনিস দেখেছিলেন ফুলেল সৌকর্যের এক অসাধারণ মসলিন। ধারণা করা হয়, মেগাস্থিনিস যে মসলিন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেটি আসলেই জামদানী ছিলো। ইন্ডিয়ান আর্ট এন্ড দিল্লি গ্রন্থে জর্জ ওয়াটের ধারণা, জামদানী ডিজাইনের নমুনাগুলো নিঃসন্দেহে ইরানি শিল্প থেকে গৃহীত।
যদিও মসলিন ও জামদানী কাপড়ে তেমন কোন পার্থক্য নেই। সেদিক দিক থেকে, জামদানী মসলিনেরই একটি প্রজাতি। কিন্তু মসলিন থেকে জামদানির ব্যাতিক্রম হচ্ছে, এর পাড় ও জমিনে বিভিন্ন রঙের অপেক্ষাকৃত মোটা সুতোয় বুননের মাধ্যমে অসংখ্য দৃশ্যমান কারুকাজ।
এছাড়াও জামদানী শিল্প অদ্বিতীয় মূলত দুটি কারণে।
প্রথমত, এর রয়েছে বৈশিষ্ট্যমূলক জ্যামিতিক প্যাটার্নের ধারাবাহিকতা। যা ইরানি প্রভাবে প্রভাবিত।
দ্বিতীয়ত, এর মোটিফ, যা বুননের সময়েই কাপড়ে খুব সুন্দর ভাবে গেঁথে যায়।
জামদানী শাড়ীর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর সুনির্দিষ্ট মোটিফ, অত্যন্ত সহজসরল কয়েকটি বাঁশের খণ্ডের সমন্বয়ে তাঁত, সাধারণ সুতো, সিল্ক ও জড়ি ইত্যাদি উপকরণ এবং তাঁতিদের স্মৃতিতে ধারণ করা কবিতার ছন্দে হাতে তোলা নকশার বয়ন পদ্ধতির কৌশল।
প্রাকৃতিক রুপ ও ছন্দের জ্যামিতিক রুপায়নে হাজার বছরের বিবর্তিত মোটিফ হচ্ছে জামদানী নক্সার মূল প্রাণশক্তি, যা দিয়ে আজো জামদানী শিল্পকে তার ব্যক্তিত্বে শনাক্ত করা যায়।
জামদানী পাড় ও আঁচলের নকশাঃ
জামদানীর জমিনের নকশা মূলত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত এবং তা হল বুটা, জাল ও তেছরি। এর মধ্যে জনপ্রিয় হল- ফুল, সিঙ্গারা, বেলপাতা, ফড়িং ফুল, শঙ্খমতি ।
করলা পাড়


কলকা পাড়


জামদানী শাড়ীর প্রকার:
জামদানী শাড়ি মূলত: দুই প্রকার।
১। হাফসিল্ক জামদানীঃ যার আড়াআড়ি সুতোগুলো হয় রেশমের আর লম্বালম্বি সুতোগুলো হয় সূতির সুতোর।
২। ফুল কটন জামদানিঃ যা পুরোপুরি তুলোর তৈরি সুতোয় তৈরি হয়।
জামদানী শাড়ি ব্যবহারে চাই বিশেষ যত্ন। শাড়ি পরার পর অবশ্যই ভালো ভাবে হাওয়াতে শুকিয়ে তুলে রাখতে হবে, এছাড়াও অনেক দিন পড়ে থাকলে সাদা ছোপ পড়ে আপনার শখের জামদানী নষ্ট হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ২/১ মাস পর পরই শাড়ি বের করে হাওয়াতে শুকিয়ে নিয়ে রাখতে পারেন। কয়েক বার পরা হলে ড্রাইওয়াশ করে নেয়া উচিত।


আমাদের নদীয়ার শান্তিপুরে অনেক কম দামে জামদানী পাবেন। তবে সেক্ষেত্রে একটু সাবধান হতে হবে। অথবা জামদানী সম্পর্কে ভালো বোঝে এমন কাউকে সাথে নিয়ে যাবেন। নকল জামদানীর পিছনে দেখবেন কাটা কাটা সুতো, নিখুঁত নয়। আর আসল জামদানীর উল্টো দিকের ডিজাইনগুলোও নিখুঁত হয়।
জামদানী আমাদের বাংলার গর্ব, আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। তাই যেকোনো অনুষ্ঠানেই জামদানী পড়ুন। বিয়েতে পড়ুন পারলে প্রিয়জনকে উপহার দিন। জামদানী পড়ে হয়ে উঠুন সবার মাঝে অনন্যা।