দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরোঃ পরিবারে “নুন আনতে ফুরিয়ে যায় পান্তা” এ যদি শুধু প্রবাদ হয় তবে থাংগারাসু নটরাজনের জীবনে এটাই ছিল কঠিন বাস্তব। বাবা স্টেশনের একজন সামান্য কুলি। স্টেশনের পাশেই কসাইখানা চালান মা। আর এরই মধ্যে বড় ছেলেকে পেয়ে বসেছে ক্রিকেটের নেশা। সাদা বা লাল ডিউজ বলের স্বপ্ন তখন দুরস্ত। হালকা সবুজ টেনিস বলটাই তখন নটরাজনের একমাত্র অস্ত্র। কোথায় বাবাকে একটু সাহায্য করবে বড় ছেলে, তা নয় সারাদিন তার শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেট। দিন নেই রাত নেই সবুজ বলটা নিয়ে চলেছে অনুশীলন। আর ম্যাচ জুড়ে সারাদিনের তীব্র রাগ উগরে দেওয়া। পাড়া-প্রতিবেশী ব্যাপারটা যে ভাল চোখে নেবেনা তাইতো ছিল স্বাভাবিক। শত হোক পরিবারের বড় ছেলে বলে কথা। সে একটু বাবার হাত ধরবে না এ কেমন ছেলে। গোটা পরিবারের সারাদিনের আয় ওই তিনশো টাকা মত। বাবা-মা সকলেই চান পরিবারকে একটু সাহায্য করুক থাংগারাসু। বাবার বকাঝকায় কখনো কখনো কুলির কাজ যে করেননি তা নয় কিন্তু মন কি মানে? মন পড়ে আছে তার সবুজ মাঠে। কখন বাঁহাতের দুরন্ত ইয়ার্কারে তিনি উড়িয়ে দেবেন বিপক্ষের ব্যাটসম্যানের স্টাম্প। ঠিক কাল যেমন ভারতীয় দলে অভিষেকের দিনে তার বল সামলাতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম উঠতি তারকা লাবুসানে।
কিন্তু সেসব তখন স্বপ্ন। ওই পরিবার থেকে ভারতীয় দলের জার্সি। ভাবা যায়? স্বপ্ন কি অতো বড় দেখা সম্ভব? সম্ভব তা বুঝিয়ে দিয়েছেন নটরাজন। টেনিসবনের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতে খেলতেই একদিন তার আলাপ হয়ে যায় জয়প্রকাশের সাথে। এই জয় প্রকাশই যে একদিন তার জীবনের আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়াবে তা হয়তো তখন ভাবেননি নটরাজন। কিন্তু চেন্নাইয়ের এই ক্রিকেটার নটরাজনের পরিবারকে প্রথম অভয় দেন, বলেন, “আমি আপনাদের ছেলের পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছি। ওকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। ও একদিন অনেক বড় কিছু করবে।”
কিন্তু সে তো সবে শুরুর দিন থাংগারাসুর। ভাগ্যও যেন সেদিন হেসে বলেছিল,’এ তো সবে শুরু নটরাজন।’ কাটার মাস্টার নটরাজন হতে তার তখন অনেক দেরি। এর পরেই কোচিংয়ের জন্য নিজের শহর ছেড়ে নটরাজনকে চলে আসতে হয় চেন্নাই। ভরসা সেই গুরু জয় প্রকাশ। পরে তার তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে থাংগারাসু বলেন,“আমি আজ যা, সবই তাঁর কল্যাণে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমার ওপর ভরসা রেখেছেন। ক্রিকেটার না হলে আজ আমি কুলিই হতাম। আইপিএলের ওই খবরটা পাওয়ার পর তাঁর সাথেই প্রথম কথা হয়। তিনি তো কেঁদেই ফেলেছেন এসব শুনে। আমি তাঁর কাছে আজীবনের জন্য ঋণী।”
চেন্নাইয়ে অন্যতম ভারতীয় প্রাক্তন পেস বোলার লক্ষ্মীপতি বালাজির কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন নটরাজন। ২০১৫ সালে রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার বিরুদ্ধে অভিষেক হয় তার। অভিষেকের পর প্রথম ৯ ম্যাচেই তিনি তুলে নেন ২৭ টি উইকেট। এরই মাঝে তার তুলনা শুরু হয়েছে মুস্তাফিজুর রহমানের সাথে। তারপর হঠাৎই ডাক টিএনপিএলে। তার হাতের দক্ষ ইয়ার্কার দেখে চমকে ওঠে সবাই। মুরলী বিজয়, দীনেশ কার্তিকদের মতো তারকা ব্যাটসম্যানদের রীতিমতো সমস্যায় ফেলতে শুরু করেন তিনি। একদিন কলেজ পৌঁছাতে পারেননি নটরাজন। ভেবেছিলেন জীবনটা হয়তো কেটে যাবে পরের বোঝা বইতে বইতে। কিন্তু ভাগ্য তার জন্য লিখেছিল অন্য এক স্বর্ণালী অধ্যায়।
এরপরই তিন কোটি টাকায় হায়দ্রাবাদের হয়ে আইপিএল খেলার ডাক পান তিনি। মুস্তাফিজুরের পাশাপাশি হাতে বই তুলে নিয়ে হায়দ্রাবাদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠেন। নিজের জীবনের এই অসামান্য দারিদ্র্যের দিনগুলি আর বাবা-মার কথা স্মরণ করে নটরাজন বলেন,”আমার প্রথম কাজ হবে মা বাবাকে নিজেদের কাজ থেকে দূরে সরিয়ে আনা। তাঁদের তো বহুবার বলছি এসব, কিন্তু তাঁরা আমার কথা শুনতেনই না! আমাদের ঘরটা খুব ছোট, অনেকজন মিলে থাকতে কষ্ট হয়। নতুন একটা ঘর বানাবো। বাবার নেওয়া ঋণগুলো শোধ করতে হবে। আমার ভাইবোনদের আরও পড়ালেখা করাতে চাই। তাঁরা ইঞ্জিনিয়ার ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতে চায়। আইপিএলের এই টাকা আমার অনেক কাজে দেবে।”
তবে এরপরেও ছিল বাধা। আইপিএলে ভালো পারফরম্যান্স হচ্ছিলো ঠিকই। কিন্তু খুলছিলোনা ভারতীয় দলের দরজা। ২০১৮ সাল থেকে আইপিএল খেলছেন নাটরাজন। বয়সও বাড়ছে আস্তে আস্তে। আর কানাঘুষো শোনা যায় ভারতীয় দল খোঁজে তরুণ প্রতিভা। ২৯ বছর বয়সী নটরাজন কি ডাক পাবেন? হয়তো বা নয়। কিন্তু ২০২০ আইপিএলে মন-প্রাণ ঢেলে দিলেন তিনি।যশপ্রীত বুমরাহের মত প্রতিষ্ঠা বোলারের থেকেও বেশি ইয়ার্কার এল নটরাজনের হাত থেকে। ভুবনেশ্বর কুমার না থাকা সত্বেও হায়দ্রাবাদের পেস বোলিং অ্যাটাক সামলে পারলোনা মহা মহা তারকারা। তার অন্যতম প্রধান কারণ টি নটরাজন। প্লে-অফসে হারলেও ভাঙ্গাচোড়া দলকে শেষ চারে পৌঁছে দিতে নটরাজনের লড়াই ভুলতে পারবেনা ক্রিকেট দুনিয়া। কিন্তু তাও অস্ট্রেলিয়াগামী ভারতের প্রথম একাদশে জায়গা পেলেন না তিনি। জায়গা পেয়েছেন বরুণ চক্রবর্তী। হয়তো তখন সব আশা শেষ হয়ে গিয়েছিল এই বাঁ হাতির। কিন্তু হঠাৎই জানা গেল চোটের জন্য অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে বাদ পড়েছেন বরুণ চক্রবর্তী এবং তার জায়গায় দলে এসেছেন থাংগারাসু।তখনো হয়তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। কিন্তু শুধু ভারতীয় দলে নয় ডাক এলো কঠিন ম্যাচে ভারতকে জেতানোর। ইতিমধ্যেই সিরিজ হেরেছে ভারত। তাই মুখ্য বোলারদের বিশ্রাম দিতে সাইনি এবং মোহাম্মদ শামিদের জায়গায় একাদশে স্থান পেলেন নটরাজন।
আর তারপরেই এই বাঁহাতির কামাল দেখল সারা ভারতবর্ষ। দুরন্ত বোলিংয়ে মাত্র ৭ রানে লাবুসানের স্টাম্প উপড়ে নটরাজন বুঝিয়ে দিলেন এই মাঠে খেলার যোগ্য তিনি। এরপর অ্যাস্টন অ্যাগারকেও ফিরিয়ে দেন তিনি। অভিষেক ম্যাচেই ঝুলিতে রইল ২ উইকেট। সফর হয়তো এখনো অনেক বাকি,তবে নটরাজন বুঝিয়ে দিলেন স্বপ্ন দেখতে জানলে একদিন তা সত্যি করা যায়।