দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরোঃ আজ শেষ হল রোমাঞ্চকর শিউলির বহরমপুর থেকে কলকাতা যাত্রা। খড় হোগলার নৌকা নিয়ে ১১ জন সাহসী অভিযাত্রী ডিসেম্বরের ৪ তারিখ যাত্রা করেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। আজ দুপুরে কলকাতার আউট্রাম ঘাটে পৌঁছান তারা। দ্য সি এক্সপ্লোরার্স ইনস্টিটিউটের কর্ণধার ডক্টর শিউলি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি এ ছিল এক অভিনব শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। আট দিনের এই যাত্রায় ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূলতা। কিন্তু হাল ছাড়েননি অভিযাত্রীরা। যেমন ছিলেন জলের অভিযাত্রী তেনজিং নরগে পুরস্কারপ্রাপ্ত তাপস চৌধুরী, আন্দামান অভিযাত্রী পুষ্পেন সামন্তরা। তেমনি ছিলেন পাহাড়ের অভিযাত্রী শ্রী রুদ্রপ্রসাদ হালদার। এভারেস্ট বিজয়ী এই বাঙালি অভিযাত্রীর এটাই ছিল প্রথম নদীর অভিযান।


আজ তীরে পৌঁছানোর পর উষ্ণ অভ্যর্থনায় তাদের বরণ করে নেন দ্য সী এক্সপ্লোরার্স ইনস্টিটিউটের সদস্যবৃন্দ তথা এক ঝাঁক সমর্থকরাও। এই অভিযানে ছিল নানা প্রতিকূলতা। আগেই যেমন আমরা খবরে প্রকাশ করেছিলাম, নদিয়ায় বালির চরে আটকে গিয়েছিল শিউলি। সেখানে প্রায় ২২ ঘণ্টা আটকে থাকার পর স্থানীয় মানুষ এবং প্রশাসনের সাহায্যে নৌকাটিকে আবার জলে ফেরানো হয়। শুধু তাই নয়, পথে বিভিন্ন ব্রীজগুলি পার করার সময়ও হয়েছে একাধিক সমস্যা। ক্যালকাটা মিররকে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে পাহাড় প্রেমী তথা জল প্রেমী রুদ্রপ্রসাদ বাবু বলেন,”আমি পিনাকী চট্টোপাধ্যায় এবং ডিউকের সেই আন্দামান অভিযানের কথা প্রথম পড়েছিলাম। সেখান থেকেই আমার মনে জলে অভিযান করার স্বাদ জন্মায়।পিনাকী-ডিউকের মতো আমিও একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম আন্দামান যাব। কিন্তু পাকেচক্রে আমি রক ক্লাইম্বিংয়ের দিকে চলে যাই। তবে শেষ পর্যন্ত এই অভিযানের কথা যখন পুষ্পেন আমায় বলে তখন আমি খুবই উৎসাহী হয়ে উঠি। অভিযান খুবই রোমাঞ্চকর ছিল, পুষ্পেন, তাপস চৌধুরীর মত জলের দক্ষ অভিযাত্রীদের কাছে বহু কিছু শিখলাম। বিশেষত যাতায়াতের পথে রাত্রিকালীন অনেকগুলি ব্রিজ পার করতে হয়। যেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে প্রাণনাশী বিপদের মত হতে পারত। চার ইঞ্চির ব্যবধানে কিছু কিছু সংঘর্ষ থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি। তাই আমার কাছে এই অভিযান ভীষণ রোমাঞ্চকর ছিল। পরে আমি সুযোগ পেলে এই ধরনের আরও অভিযানে যুক্ত হতে চাই।”


এই সাহসী অভিযানের অন্যতম প্রধান মুখ তথা তেনজিং নরগে পুরস্কার বিজয়ী আন্দামান অভিযাত্রী তাপস চৌধুরী বলেন,”আমরা এই বোট কোন মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করিনি। এই অভিনব পরিকল্পনা এসেছে পুস্পেনের মাথা থেকে।ও মনে করে ভাসতে চাইলে যেকোনো কিছু নিয়েই ভেসে থাকা যায়।পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরোটাই তৈরি করেছেন আমাদের অভিযাত্রীরা। এমনকি পথে অনেক মাঝি-মাল্লাও এই বোট দেখে অবাক হয়েছে। ওরা ভাবতেই পারেনি কিভাবে খড় হোগলার একটি নৌকা এতদিন ধরে ভেসে থাকতে পারে। দীর্ঘ ৩৭০ কিলোমিটার রাস্তা ম্যানুয়াল বোটে অতিক্রম করে সফলভাবে অভিযান শেষ করা সত্যিই কঠিন। তবে আমরা শেষ পর্যন্ত বহরমপুর থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছেছি যা আমাদের কাছে খুবই ভালো লাগার বিষয়। বেশকিছু রাত আমাদের সারারাত দাঁড় বাইতে হয়েছে। স্ল্যাগ ওয়াটার টাইডকে সঠিকভাবে গণনা করতে না পারলে আমরা এখানে সঠিক সময় পৌঁছাতে পারতাম না। মূলত আমরা ভাটাতেই দাঁড় টেনেছি কারণ এই নৌকা নিয়ে জোয়ারে দাঁড় টানা সম্ভব নয়। তাছাড়া মূলত আমরা রাতের দিকেই যাত্রা করেছি।”


এদিন আমরা যোগাযোগ করেছিলাম অভিযানের একমাত্র মহিলা অভিযাত্রী কেকা জানার সাথেও।তিনি বলেন,”আমি মূলত একজন সাঁতারু তাই জলের সাথে পরিচয় আমার অনেকদিন থেকেই। এর আগে ম্যানুয়াল বোটে আমি অনেক এক্সপিডিশন করেছি। কিন্তু খড় হোগলার এই নৌকায় অভিযানের কথা শুনে প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম। তবে পরে যখন দেখলাম পুষ্পেন এবং অন্যরা রয়েছেন তখন আমি রাজি হই সম্পূর্ণ উৎসাহ নিয়েই।অভিযানে নৌকার কারণে সেভাবে কোন অসুবিধা হয়নি। দু তারিখ যখন আমি দলের সঙ্গে এসে যোগ দিই ভেবেছিলাম এত বড় বোট জলে ভাসবে কিনা। কিন্তু একবার নামানোর পর কোন অসুবিধা হয়নি। আশপাশে অনেক বোট থাকায় শেষ কদিন আমাদের দাঁড় টানতে হয়েছে রাতে। তবে দেখলাম নৌকো আমাদের তরতরিয়ে নিয়ে চলে এলো। একবার জলে নামানোর পরেই বুঝেছিলাম এ লম্বা রেসের ঘোড়া।”


শেষ হলো ৩৭০ কিলোমিটারের এক রোমাঞ্চকর অভিযান। কিন্তু এতো শুধু যাত্রা নয় মাঝে ছিল কোভিদ সচেতনতা প্রচার, গঙ্গা দূষণ মাপা ইত্যাদি নানান কর্মসূচি। সেগুলিও সফলভাবে পালিত হয় এই আট দিনে।তাপস বাবুর কাছে আমরা প্রশ্ন রেখেছিলাম। গ্রামের দিকে কোভিড সচেতনতা প্রচার করতে গিয়ে কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো তাকে? এ সম্পর্কে তিনি বলেন,”এটা ঠিক যে দেখেছি বেশিরভাগ মানুষের মুখেই মাস্ক নেই। তারা কোভিড সম্পর্কে জানেন, শুনেছেন। কিন্তু তাদের কাছে সবচেয়ে বড় সত্যি পেটের টান।তাই অনেকেই সেভাবে কোভিড সম্পর্কে জানলেও সমস্ত বিধি-নিষেধ বা সচেতনতা মানতে পারছেন না। তবুও আমরা আমাদের মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।”
গঙ্গা দূষণ সম্পর্কেও তাদের মতামত খুব আশা জনক নয়। তারা বলেন গঙ্গায় এখনো নানা জায়গায় মৃত পশুর শরীর এবং অন্যান্য আবর্জনা ভাসতে দেখলাম। নিশ্চয়ই আমাদের বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়া হবে। কিন্তু এইসব বিষয়ে আমাদের আরো বেশি সচেতন হওয়া দরকার। এদিন তাদেরকে পুষ্পস্তবক ও মিষ্টান্ন দিয়ে বরণ করে নেন সী এক্সপ্লোরার্স ইনস্টিটিউটের সদস্যরা। মিষ্টান্ন পাঠানো হয় অন্যান্য নানা তরফেও। আবাদাবলাম দুর্ঘটনার পর এভারেস্ট বিজয়ী বাঙালি সত্যরূপ সিদ্ধান্ত এই অভিযানে যোগ দিতে পারেননি ঠিকই তবে আজ তিনি সতীর্থদের সাথে সময় কাটাতে উপস্থিত হন গঙ্গার পাড়ে। এই দীর্ঘ অভিযানের জন্য সকলকেই শুভেচ্ছা জানান তিনি।