24 C
Kolkata
Tuesday, March 21, 2023
More

    ব্রোঞ্জ জয়ের ৫০ বছর পূরণ, আজকের দিনেই এশিয়ান গেমসে জাপানের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিল ভারত — ঋতব্রত দেব

    একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো। এখনকার সুনীল ছেত্রীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় ফুটবল দল খেলতে নামছে হিউন মিং সনের সাউথ কোরিয়া কিংবা তাকুমি মিনামীনো, টাকেফুসো কুবো সমৃদ্ধ জাপানের বিরুদ্ধে এবং হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়ছেন প্রীতম কোটাল, গুরপ্রীত সিং সান্ধুরা। অসম্ভব লাগছে তো? কিন্তু একসময় ব্যাপারগুলো অসম্ভব ছিল না। আজ থেকে ৫০ বছর আগের এই দিনেই ১৯৭০ এশিয়ান গেমসে সৈয়দ নৈমুদ্দিনের ভারত জাপানকে হারিয়ে দেশকে ব্রোঞ্জ উপহার দিয়েছিল। সেটাই ছিল এশিয়ান গেমসে ভারতের শেষ পদক।

    ইসলামাবাদ শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ানোর টানা দ্বিতীয়বারের জন্য ব্যাংককেই আয়োজিত হয় সেইবারের এশিয়ান গেমস। আচমকা এই পরিবর্তনের কারণে ক্রীড়া সূচি হয়ে যায় ভয়ংকর রকমের জটিল। ৯ দিনের মধ্যে ৬ টি ম্যাচ খেলতে হয়েছিল ভারত সহ সবকটি দেশকে। প্রাক্তন ফরোয়ার্ড শ্যাম থাপার সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি জানিয়েছেন “পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ছিল তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু আমাদের কোচ বাশা স্যার (গুলাম মহম্মদ বাশা) আর প্রদীপ দা (পি-কে ব্যানার্জি) যেভাবে ম্যাচের আগে ভোকাল টনিক দিয়ে তাতিয়ে তুলতেন, তাতে ব্যাপারটা বেশ খানিকটা সহজ হয়ে যেত।” সেই দলের অধিনায়ক সৈয়দ নৈমুদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ বেপরোয়া হিন্দিতে বলেন “মুশকিল তো থা, পর কিয়া করে, দেশকে লিয়ে খেল রাহে থে। ও বহত বড়ি বাত থি”।

    টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া ১০টি দেশকে ভাগ করা হয়েছিল তিনটি গ্রূপে। ভারতের গ্রূপে ছিল আয়োজক থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই ভারত মুখোমুখি হয় আয়োজক দেশ থাইল্যান্ডের। ৬০০০০-এর বেশি থাই সমর্থকদের সামনে তাদের দেশের ফুটবল দলের বিরুদ্ধে খেলতে হয়েছিল ভারতকে। সেই ম্যাচে ২১ মিনিটের মধ্যে ২ গোলে পিছিয়ে পড়ে ভারত। কিন্তু জ্বলে উঠেন সুভাষ ভৌমিক। ৩৫ ও ৫৭ মিনিটে দুটি দুর্দান্ত গোল করে ভারতকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন তিনি। অল্পের জন্য নষ্ট করেন নিজের হ্যাটট্রিক এবং নিজের দেশকে আয়োজকদের বিরুদ্ধে জেতানোর সুযোগ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান- “জীবনে অনেক গোল মিস করেছি, কিন্তু থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওপেন নেট মিস করার সেই যন্ত্রণা আজও ভুলিনি। বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন খুব, তার মধ্যেও লড়াই করে জয়টা প্রায় তুলে এনেছিলাম, কিন্ত অল্পের জন্য শুধুমাত্র ড্রয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল সেই ম্যাচে।” যদিও তাতে কোনও অসুবিধে হয়নি ভারতের। হাবিব এবং মগন সিং-এর গোলে ২-০ ফলে ভিয়েতনামকে হারিয়ে গ্রূপশীর্ষে থেকে কোয়ার্টারে পৌঁছেছিল ভারত।

    কোয়ার্টার ফাইনাল অবশ্য নক-আউট ম্যাচ ছিল না। ১০ টি দলের মধ্যে থেকে কোয়ার্টারে পৌঁছনো ছয়টি দলকে দুটি গ্রূপে ভাগ করা হয়। ভারতের গ্রূপে ছিল জাপান ও ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে দরাইস্বামী নটরাজ, মগন সিং এবং শ্যাম থাপার গোলে ভর করে ৩-০ ফলে ম্যাচ জেতে ভারত। জাপানের কাছেও হারে ইন্দোনেশিয়া। অর্থাৎ ভারতের সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যায়। জাপানের বিরুদ্ধে নামার আগে দলের কিছু সিনিয়র খেলোয়াড় কোচ গুলাম মহম্মদ-কে অনুরোধ করেন প্রথম একাদশে নিয়মিতদের বিশ্রাম দিয়ে বেঞ্চের ফুটবলারদের খেলিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু গুলাম মহম্মদ কিংবা পি-কে ব্যানার্জি, কেউই তাতে রাজি হননি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের শেষে ৮৮ মিনিটে গোল খেয়ে ১-০ ফলে জাপানের কাছে হেরে গ্রূপের দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনালে পৌঁছে বার্মার মুখোমুখি হয় ভারত। সুভাষ ভৌমিক এই বিষয়ে বলেন “আমরা তরতাজা ভাবে যাতে বার্মার বিরুদ্ধে নামতে পারি, তাই গ্রূপে জাপানের বিরুদ্ধে একটু বিশ্রাম চেয়েছিলাম। কিন্তু কোচরা শুনলেন না। জাপানের বিরুদ্ধে ম্যাচটা খেলেছিলাম ১৬ তারিখ, ১৮ তারিখেই সেমিতে বার্মার বিরুদ্ধে নামি। দুর্ভাগ্যবশত আমার একটা শট আর মগনের একটা হেড পোস্টে লেগে ফিরে আসলো, আমরা ২-০ তে হারলাম”। বার্মার বিরুদ্ধে হেরে তারপরের দিনই তৃতীয় স্থানের ম্যাচের জন্য ফের জাপানের মুখোমুখি হয় ভারত, যারা দ্বিতীয় সেমিফাইনালে হেরে গিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে। সেই সময় জাপানের দলে ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার ‘কামামটো’। ফুটবল সম্রাট ‘পেলে’ তখন নিজের দেখা সেরা ৪০ ফুটবলারের লিস্টে রেখেছিলেন এই প্রতিভাবান জাপানি ফুটবলারকে। জন্ডিস সারিয়ে উঠে টুর্নামেন্টে তিনটি গোলও করে ফেলেছিলেন তিনি। এহেন কামামটোর বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার নামার আগে একটি সমস্যার মুখোমুখি হয় ভারত। চোটের কবলে পড়েন সেন্টার ব্যাক চন্দ্রেস্বর প্রসাদ। বাধ্য হয়ে ২০ বছর বয়সী তরুণ রাইট ব্যাক সুধীর কর্মকার-কে স্টপার হিসাবে খেলাতে হয় কোচ গুলাম মহম্মদকে। সকলকে আশ্চর্য করে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন সুধীর কর্মকার। তার এবং অধিনায়ক নৈমুদ্দিনের জুটি গোটা ম্যাচে বোতলবন্দি করে রাখেন জাপানি সুপারস্টারকে। অনিয়মিত একজন স্টপারের সাথে জুটি বেঁধে বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের একজনকে সামলাতে হবে, দুশ্চিন্তা হয়নি? এই প্রশ্নের জবাবে বেকেনবাউয়ার ভক্ত নৈমুদ্দিন জানান “খেলার মাঠে যে কোনও চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি থাকতে হবে, আমরা মানসিকভাবে তৈরি ছিলাম এবং শেষপর্যন্ত সফল হই”। শ্যাম থাপার পাস থেকে প্রথমার্ধেই গোল করে ভারতকে এগিয়ে দিয়েছিলেন অমর বাহাদুর। গোটা ম্যাচে একবারই সুযোগ পেয়েছিলেন কামামটো। কিন্তু তার দুরন্ত হেড দুর্দান্তভাবে বাঁচান ওই টুর্নামেন্টে ছটি ম্যাচেই ভারতের তেকাঠীর নিচে থাকা কুপ্পুস্বামী সম্পথ।

    সেই শেষবার কোনও মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায় পদক এনেছিল ভারতীয় ফুটবল দল। তারপর থেকে প্রাপ্তির ভাঁড়ারটা শূন্য। শ্যাম থাপা রীতিমতো আফসোসের সুরে জানান “কোথায় ছিলাম আর এখন কি অবস্থা, অনেকবার ফেডারেশনের সঙ্গে কথা হয়েছে, পরিকল্পনা তৈরি করে দিয়েছি। কিন্তু কেউ গা করেনি। ভারতীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ কর্তারা ফুটবলের উন্নতির চেয়ে অন্য কিছুতে বেশি ব্যস্ত। উল্টোদিকে যেই মধ্যপ্রাচ‍্যের দেশগুলি একসময় অনেক পিছিয়ে ছিল ফুটবলে, তারা দৌড়ে দৌড়ে কতটা এগিয়ে গেল। ভাবলে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু যাদের কিছু করার ক্ষমতা ছিল তারাই উদাসীন”। একইসঙ্গে তিনি এটাও জানান যে ব্রোঞ্জ নয়, তাদের প্রাপ্য ছিল সিলভার অর্থাৎ রুপো। তিনি বলেন “ফাইনালটা ড্র হয়েছিল এবং তখন টাইব্রেকারের ব্যবস্থা না থাকায় যুগ্মভাবে সোনা জিতেছিল বার্মা এবং কোরিয়া। সেই হিসাব অনুযায়ী আমাদের রুপো প্রাপ্য ছিল, কিন্ত তখন আমরা অত কিছু বুঝতাম না, তাই কোনও প্রতিবাদ করিনি।”

    ৫০ বছর আগের সেই দলের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। মঞ্জিত সিং, সুকল্যান ঘোষ দস্তিদার, অমর বাহাদুর, নির্মল সেনগুপ্ত ওরফে ঝুনু সেনগুপ্ত-রা আজ পৃথিবীতে নেই আর। যারা আছেন তাদের একে অপরের সাথে যোগাযোগ নেই। সেই নিয়ে একরাশ আফসোস ঝরে পড়ছিল সেই ঐতিহাসিক দলের অধিনায়ক নৈমুদ্দিনের গলা থেকে। ফোনে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় মাঝে মাঝেই চুপ হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। যেন মনে মনে অতীতে ফিরে ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন স্মৃতিগুলোকে। বারবার স্মৃতিচারণা করছিলেন কলকাতায় খেলে যাওয়া দিনগুলির। জ্যোতিষ গুহ, কালিবাবু গুপ্তা, পিটার থঙ্গরাজ-দের সাথে কাটানো সোনালী মুহূর্তগুলির। বলছিলেন কিভাবে সেই এশিয়ান গেমসে ভিলেজের বন্দোবস্ত না থাকায় স্কুল বাড়িতে থেকে তাদের অত বড় মাপের প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছিল। শ্যাম থাপা আর সুভাষ ভৌমিকের সাথে এই নিয়ে কথা হয়েছে শুনে জানতে চাইলেন “ওরা আমার কথা কিছু বলেছে?” সেই দলের গোলকিপার কুপ্পুস্বামী সম্পথের সঙ্গে, সুধীর কর্মকারের সাথে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। খুব কম লোকই মনে রেখেছেন তাদের কথা। বেঙ্গালুরুতে সম্প্রতি প্রচুর জাতীয় দলের ম্যাচ হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু বিশেষ হিসাবে আমন্ত্রণ আসেনা সম্পথদের কাছে। এই অবহেলা নিয়ে একরাশ হতাশা দেখা গিয়েছে শ্যাম থাপা, নৈমুদ্দিন-দের গলায়। ইন্টারভিউ শেষে কলকাতা মিরর-কে ধন্যবাদও জানিয়েছেন তারা অতীত স্মৃতি গুলোকে সকলের সামনে তুলে আনার প্রচেষ্টার জন্য। আর একটু পরিচিতি, আর একটু বেশি সম্মানের যোগ্য হয়তো তারা ছিলেন। মনে করেন সেই বিখ্যাত ভারতীয় দলের অধিনায়ক সৈয়দ নৈমুদ্দিন।

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    সরে গেল ‘এটিকে’ , পরের মরশুমে ঝড় তুলতে আসছে ‘মোহনবাগান সুপার জায়ান্টস’

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে বড় ঘোষণা করলেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কা। মোহনবাগানের নামের শুরু থেকে সরে গেল...

    ভারতসেরা ‘মোহনবাগান’ ! বাঙালির গর্বের দিন

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : চাপ বনাম পাল্টা চাপ। পেনাল্টি বনাম পাল্টা পেনাল্টি। অফুরান দৌড় আর স্কিলের ফুলঝুরি দেখাতে...

    ISL চ্যাম্পিয়ন এটিকে মোহনবাগান

    দ্য ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : আই এস এল ফাইনালে রুদ্ধশ্বাস জয় ছিনিয়ে নিলো এটিকে মোহনবাগান । বেঙ্গালুরু এফসিকে টাইব্রেকারে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো...

    বাড়িতে আনুন বেশকিছু হোমিওপ্যাথি ঔষধ , পাবেন বহু সমস্যা মুক্তি

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : হোমিওপ্যাথি এক পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতি। আয়ুর্বেদের সঙ্গেও এই চিকিৎসা পদ্ধতির বেশ কিছু মিল...

    বড় বড় মার্কিন ব্যাংকের পতন ! আসছে মহামন্দা ?

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার ব্যাঙ্ক – পর পর দুই বড় মাপের মার্কিন ব্যাঙ্কের...