নিখিলদার (নিখিল নন্দী) মৃত্যু মানে ময়দান থেকে আরও একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোকের চিরঘুমের দেশে চলে যাওয়া। কয়েকমাস ধরেই ভুগছিলেন। মাঝে করোনায়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন। মঙ্গলবার চিরবিদায় নিলেন একদা ময়দানে ‘হিউম্যান লোকোমোটিভ’ নামে খ্যাত অলিম্পিয়ান ফুটবলার নিখিল নন্দী। চার দশক আগে প্রথম নিখিলদার মুখোমুখি হওয়া। তারপর অজস্রবার দেখা ও কথা হয়েছে। আমার থেকে বয়সে ২৭ বছরের বড়। প্রথম পরিচয়ের দিন ‘আপনি’ সম্বোধন করেছিলেন। আপত্তি জানিয়েছিলাম। কিন্তু শোনেননি। পরে বহুবার বলেছি। তবু তিনি ওই ‘আপনি’ থেকে কখনও বেরিয়ে আসতে পারেননি। দেখেছি ওটাই ওঁর ‘স্বভাব’। ওঁকে দেখে কখনও বোঝার উপায় ছিল না, কত বড় ফুটবলার ছিলেন। সহজ-সরল মানুষ। কোনওরকম ঔদ্ধত্য, নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ছিল না। নির্বিবাদ মানুষ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই।


চট্টগ্রাম, রানাঘাট, নারকেলডাঙা হয়ে ইস্টার্ন রেলের চাকরি থেকে অবসরের পর থিতু হয়েছিলেন নাগেরবাজারে। যখন যেখানেই থেকেছেন, ফুটবলই ছিল নিখিলদার সর্বক্ষণের সঙ্গী। শুধু নিখিলদার কেন, ওঁদের ৪ ভাইয়েরই। ওঁর বাবা গোপালচন্দ্র নন্দী ছিল একসময়ের নামী বডি বিল্ডার। কিন্তু ওঁর ৪ ছেলেই অজিত, অনিল, নিখিল ও সুনীল হয়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার। এর মধ্যে অনিল ও নিখিল খেলেছেন ভারতের হয়ে অলিম্পিক ফুটবলে। ১৯৪৮-এ লন্ডনে অনিল এবং ১৯৫৬ সালে মেলবোর্নে নিখিল। ফুটবলে ছেলেদের সাফল্য অবশ্য বাবা দেখে যেতে পারেননি। গোপালচন্দ্র নন্দী অডিট অফিসার ছিলেন। তখন পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। নদীয়ার রানাঘাটের আদি বাসিন্দা হলেও চাকরি সূত্রে তখন পুরো পরিবার নিয়েই থাকতেন চট্টগ্রামে অডিট অফিসের কোয়ার্টার্সে। নিখিলের বয়স যখন ৯ বছর ওই চট্টগ্রামেই অফিস থেকে কোয়ার্টার্সে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় গোপালচন্দ্রের। অফিস থেকে রেল লাইন পার হয়ে আসতে হত। সন্ধ্যায় অন্ধকারে রেল লাইন পার হচ্ছিলেন। দ্রুত গতিতে আসা একটি ট্রেনের ধাক্কায় সব শেষ! গোপালচন্দ্রের মৃত্যুর পর পুরো পরিবার আবার রানাঘাটে ফিরে আসে।


চট্টগ্রামে থাকার সময়ই ফুটবলে লাথি মারা শুরু। রানাঘাটে আসার পরই তৈরি হয় বড় ফুটবলার হওয়ার ভিত। রানাঘাটের তরুণ ব্যায়াম সমিতিতে দাদাদের সঙ্গে যাওয়া শুরু নিখিল নন্দীরও। ওখানে হরিপ্রসাদ কুণ্ডু ছিলেন নিখিলের প্রথম কোচ। রানাঘাটের লালগোপাল হাই স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন চুটিয়ে খেলেছেন ওখানকার নানান প্রতিযোগিতায়। পরবর্তীতে মাঝমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও তখন খেলতেন সেন্টার ফরোয়ার্ডে। অনিল নন্দী ততোদিনে জায়গা করে নিয়েছেন রেল দলে। রানাঘাট থেকে প্র্যাকটিসে আসতেন কাঁচরাপাড়ায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিখিলও সুযোগ পেয়ে যান কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কশপের ফুটবল দলে। ইস্টার্ন রেলের ফুটবল দলের সব কিছুই তখন বাঘা সোম। তিনি ঘুরে ঘুরে ইস্টার্ন রেলের বিভিন্ন ইউনিটের ফুটবল দলের অনুশীলন দেখতে যেতেন। ওঠা ছিল আসলে ইস্টার্ন রেল দলের জন্য ভাল ফুটবলার খোঁজা। কাঁচরাপাড়ায় প্র্যাকটিসে নিখিলকে দেখে তিনি কলকাতায় ইস্টার্ন রেলের অনুশীলনে আসতে বলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ইস্টার্ন রেল দলে সুযোগও পেয়ে যান নিখিল নন্দী। তবে সেবার ১৯৪৭ সালে ইস্টার্ন রেলের প্রথম একাদশে ছিলেন না। কিন্তু আর পেছনে তাকাতেও হয়নি। পরের বছর থেকেই দলে অপরিহার্য়। চাকরির জন্যই কখনও দলবদল করেননি। ১৯৬৩ পর্যন্ত টানা ইস্টার্ন রেলের হয়ে খেলেছেন। মাঝে একবার ১৯৫৭ সালে মোহনবাগানে সই করেও পরে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তিন বড় ক্লাবের বাইরে ইস্টার্ন রেলই প্রথম কলকাতা ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, ১৯৫৮ সালে। সেই দলের মেরুদন্ড ছিলেন নিখিল। সেবার লিগের দ্বিতীয় পর্বে মোহনবাগানের সঙ্গে খেলায় গ্যালারি থেকে উড়ে আসা ইটের টুকরোর গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন কপালে। আহত অবস্থায়ও পুরো ম্যাচটা খেলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ইস্টার্ন রেলে ওই ম্যাচে ১-০ গোলে জিতেছিল।


ক্লাব ফুটবলের গণ্ডি পেরিয়ে খেলেছেন সন্তোষ ট্রফিতে। দীর্ঘদিন ভারতীয় দলেরও ছিলেন নিয়মিত খেলোয়াড়। ভারতের হয়ে খেলেছেন এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক, তখনকার চতুর্দলীয় টুর্নামেন্ট-সহ অন্যান্য প্রতিযোগিতায়।
সারা মাঠ জুড়ে খেলতেন, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ক্লান্তিহীন দৌড়। দমের কোনও ঘাটতি দেখা যেত না। তাই ওঁকে বলা হত ‘হিউম্যান লোকোমোটিভ’। মাঝমাঠের খেলোয়াড় হলেও ওঁকে বাঘা সোম এমনভাবে তৈরি করেছিলেন যে গোল ছাড়া সব পজিশনেই খেলতে পারতেন। দলের প্রয়োজনে খেলেওছেন।
খেলা ছাড়ার পর কোচিংয়ে আসেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে ইরানে ফিফা কোচেস কোর্স করেন। করেছিলেন এন আই এস কোর্সও। যুব ভারতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন। সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা ও রেলওয়েজ দুই দলেরই কোচ হয়েছেন। ক্লাব ফুটবলে ইস্টার্ন রেল, পিয়ারলেসের কোচ ছিলেন। কিন্তু বড়দের চেয়ে ছোটদের কোচিং করানোই ওঁর বেশি পছন্দের ছিল। ছোটদের খেলা শেখানোর কাজটা কখনও বন্ধ রাখেননি। একসময় বারাসত এবং দমদম সেন্ট্রাল জেলের মাঠে একসঙ্গে দুটো কোচিং ক্যাম্প চালাতেন। বৃদ্ধ বয়সে, অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্তও নিয়মিত তাঁকে দেখা যেত ছোটদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে। বলতেন, ‘ফুটবল ছাড়া আমি থাকতে পারি না।’
নিখিল নন্দীর মৃত্যুতে ওই ‘ছোটরা’ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। আর ময়দান হারাল এক নির্বিবাদ মানুষকে।
প্রণাম নিখিলদা।