ভারত 1947 এর 15ই আগস্ট স্বাধীনতা পেলেও ধ্যানচাঁদের নেতৃত্ব ভারতীয় হকি দল স্বাধীনতার এগারো বছর আগেই বার্লিন অলিম্পিকে হিটলারের সম্মুখে নাৎসি জার্মানিকে হারিয়ে অলিম্পিকে সোনা জিতে 15ই অগাস্ট দিনটি কে ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে অবিস্মরণীয় করে তুলেছিলেন। এই ম্যাচে ধ্যানচাঁদের খেলা দেখে হিটলার তাঁকে জার্মানির নাগরিকত্ব পর্যন্ত প্রদান করতে চেয়েছিলেন।
ধ্যানচাঁদের ছেলে এবং 1975 বিশ্বকাপে ভারতের শিরোপা জয়ের অন্যতম নায়ক অশোক কুমার প্রায়ই বলেন, “তিনি (ধ্যানচাঁদ) কখনই সেই দিনটির কথা ভোলেননি এবং যখনই তিনি হকি নিয়ে কথা বলতেন, তিনি সেই অলিম্পিক ফাইনালের কথা উল্লেখ করতেনই।”
ভারতীয় হকি দল সমুদ্র পথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাঙ্গেরির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের দু’সপ্তাহ আগে বার্লিনে পৌঁছেলেও, অনুশীলন ম্যাচে জার্মান একাদশের কাছে 4-1 গোলে হেরে যায়। তবে টুর্নামেন্ট শুরু হতেই স্বমহিমায় দেখা যায় গত দুই বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে, ধ্যানচাঁদের চার গোলের উপর ভর করে সেমিফাইনালে ফ্রান্সকে 10-0 গোলে উড়িয়ে সহজেই ফাইনালে পৌঁছে যায় ভারত।
ফাইনালে জার্মান দল খুব ভালো করেই জানতেন যে ধ্যানচাঁদকে থামাতে না পারলে ঘরের মাঠে ফুহরারের সামনে তাদের সোনা জেতার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে, ম্যাচের শুরু থেকেই জার্মান ডিফেন্ডাররা ধ্যানচাঁদকে ঘিরে ধরে এবং জার্মান গোলরক্ষক টিটো ওয়ার্নহলজের সঙ্গে সংঘর্ষে দাঁতও ভেঙে যায় তাঁর। বিরতিতে, তিনি এবং তার ভাই রূপ সিংহ মাঠে পিছলে যাওয়ার ভয়ে জুতা খুলে খালি পায়ে খেলেন। এই ম্যাচে ধ্যানচাঁদ তিনটি গোল করে ভারতকে 8-1 ব্যাবধানে জিতিয়েছিলেন।
এই ম্যাচের আগে রাতেই ধ্যানচাঁদ দলের সব খেলোয়াড়দের তাঁর ঘরে জড়ো করে চরকার প্রতীক আকা ভারতের তিরঙ্গা পতাকার শপথ করিয়েছিলেন যে এই ফাইনাল ম্যাচটি তাঁদের যে কোনও মূল্যেই জিততেই হবে।” সেই সময় ভারত পরাধীন থাকায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়া হিসেবে খেলেছিল।
সেই সময় বিদেশী সংবাদপত্রগুলিতে ভারতের আলোচনা ছিল তিনটি বিষয় নিয়ে; স্বাধীনতা আন্দোলন, গান্ধীজী এবং ভারতীয় হকি। অনুদানের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ নিয়ে অলিম্পিক খেলতে যাওয়া ভারতীয় দলের পক্ষে, জার্মানির মতো দলকে তাঁদের মাঠে পরাজিত করা সহজ ছিল না, তবে দেশের জন্যে কিছু করার স্পৃহা থেকেই ভারত এই অসাধ্য সাধন করেছিল।
এর আগের দুই অলিম্পিকে ভারত সোনা জিতলেও এই ম্যাচটিই ভারতীয় হকিকে বিশ্বশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এর পরে, ভারতীয় হকি বিশ্বকে বলবীর সিং সিনিয়র, উধম সিং, লেসলি ক্লডিয়াস, গুরবক্স সিংহ, কেডি সিং বাবুর মতো দুর্দান্ত খেলোয়াড় উপহার দিয়েছিল।
1936 সালের অলিম্পিক ফাইনাল ম্যাচের পরে খেলোয়াড়রা যখন সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের সাথে জয় উদযাপন করলেও, তখন ধ্যানচাঁদ ছিলেন এই সব কিছুর থেকে দূরে। প্রত্যেকে তাঁর সন্ধান করছিল, তিনি যে স্থানে সমস্ত দেশের পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছিলো সেখানে একরাশ হতাশা নিয়ে বসে ছিলেন। তাঁকে এই নিয়ে জিজ্ঞাস করা হলে তিনি বলেছিলেন, যেদিন ইউনিয়ন জ্যাকের পরিবর্তে তাঁরা ভারতের তিরঙ্গা পতাকার অধীনে খেলে সোনা জিততে পারবেন সেদিন তিনি প্রকৃত অর্থে খুশি হবেন।
ধ্যানচাঁদের সেই আশা পূর্ণ হয়নি, খেলোয়াড় জীবনে এটাই ছিল তাঁর শেষ অলিম্পিক, তবে তিনটি অলিম্পিকের 12 ম্যাচে 33 টি গোল করা হকি উইজার্ড 1947 সালের 15ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার 11 বছর আগেই ভারতের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে এই তারিখটি খোদাই করে দিয়েছিলেন।