‘জাদুকর’ শব্দটির অর্থ কি? প্রচলিত অর্থে কোনো মানুষ যদি এমন কিছু কৌশল দেখায়, যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে এবং সেটা দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়, সেটাই জাদু হিসেবে বিবেচিত হয়। কাজগুলো যে মানুষটা করে থাকে, তাকেই জাদুকর বলা হয়। কিন্তু ফুটবল খেলার জাদুকর? তাঁরা আবার কে? মাঠের খেলায় জাদুর ভূমিকাটা আসলে কী? কিন্তু এটা সত্য, খেলার দুনিয়ায় এমন অনেক ‘জাদুকর’ আছেন, যাঁরা নিজেদের ক্রীড়াশৈলীতে তাঁদের নিয়ে গেছেন জাদুকরের পর্যায়ে।
ফুটবলের ‘জাদুকর’ বলতেই প্রথমে চোখে ভাসে ম্যারাডোনা-পেলের নাম। হালের মেসি কিংবা রোনাল্ডোরাও নিজেদের ফুটবলীয় ক্যারিশমায় জাদুকরের মর্যাদা পেয়েছেন।
কিন্তু আমাদের দেশেও যে একজন ফুটবলের জাদুকর ছিলেন, সেই খবর কি কেউ রাখেন? আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে সেই জাদুকর তাঁর ফুটবলশৈলীতে এ দেশের ফুটবলকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য উচ্চতায়। কালের আবর্তে অনেকেই তাঁর কথা ভুলে গেলেও তিনি যে এ দেশের ফুটবলের সর্বকালের সেরা একটি নাম—এটা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই।
ঠিকই ধরেছেন, ভারতীয় ফুটবলের জাদুকর সামাদের কথাই বলা হচ্ছে। জাদুকর সামাদ নামে পরিচিত সেই মানুষটির আসল নাম সৈয়দ আব্দুস সামাদ। ব্রিটিশ-ভারতের সময়কালে যিনি নিজেকে ফুটবল মাঠে আলাদা করেই চিনিয়েছিলেন। তাঁর দুর্ভাগ্য, তাঁর জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে অনগ্রসর এক ভূ-খণ্ডে। নয়তো, ফুটবল ইতিহাসের এক অনন্য নাম হিসেবে তাঁকে মনে করত গোটা দুনিয়া।
১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ-ভারতের বিহারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সামাদ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ফুটবল প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে শুরু করে। পড়াশোনায় একেবারেই মনোযোগ ছিল না সামাদের। সে কারণে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনায় ইতি টানেন তিনি। এ সময়ই ফুটবল খেলাতে পুরোপুরিই মনোনিবেশ করেন তিনি।
ইতিহাস বলে তাঁর গতি ছিল চিতার সমতুল্য। ড্রিবলিং ছিল মনোমুগ্ধকর। পূর্ণিয়ার জুনিয়র একাদশে শুরু করে প্রথমেই মাত করে দেন সবাইকে। খুব অল্প বয়সেই কলকাতার বড় বড় ক্লাবের কোচ-ম্যানেজাররা তাঁর বাড়িতে লাইন ধরেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি ফুটবল খেলতে পাড়ি জমান খেলাধুলার পীঠস্থান কলকাতা মহানগরে।
এরপরের গল্পটা কেবল সামাদের এগিয়ে চলারই। সামাদ প্রথম কলকাতায় খেলতে নেমেছিলেন ১৯১৩ সালে এরিয়ন্স ক্লাবের হয়ে। ১৯১৬ সালে তিনি মাঠে নামেন শক্তিশালী ইংলিশ ক্লাব সামারসেটের হয়ে। তাঁর খেলা মুগ্ধ করে জাত্যাভিমানী ব্রিটিশদেরও। ১৯২১ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত তিনি খেলেছেন বিখ্যাত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে। ১৯২৭ সালে তাঁর দারুণ এক গোলেই ইংল্যান্ডের ম্যাশউড ফরেস্ট দলের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল।
সামাদ ভারতীয় জাতীয় দলের জার্সি গায়েও খেলেছেন। ১৯২৬ সালে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব। তিনি সে সময় ভারতের হয়ে বার্মা (মিয়ানমার), সিলোন (শ্রীলঙ্কা), সুমাত্রা-জাভা-বোর্নিও (ইন্দোনেশিয়া), মালয় (মালয়েশিয়া), সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন ও ইংল্যান্ড সফর করেন। চীনের বিপক্ষে একটি ম্যাচে ভারত ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরেও তাঁর দেওয়া চারটি গোলে ৪-৩ গোলে অবিস্মরণীয় এক জয় পেয়েছিল। তাঁর খেলা দেখে ওই সময় স্কটিশ এক ফুটবলবোদ্ধার মন্তব্য ছিল, ‘সামাদ ইউরোপে জন্ম গ্রহণ করলে সে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি পেত।’ ওই সময় ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পড়ে কখনোই পাদ-প্রদীপের আলোয় আসা হয়নি ভারতীয় ফুটবলের জাদুকর সামাদের।
১৯৩৩ সালে সামাদ ক্যারিয়ারের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে যোগ দেন মহামেডানে। নিজের সেরা সময় পার করে আসার পরেও মহামেডানকে তিনি প্রায় একক কৃতিত্বে ১৯৩৪ সালে কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন করেন। মহামেডান প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে ইংরেজদের কাছ থেকে ছিনিয়ে লিগ শিরোপা জয় করে। এরপর মহামেডান পরপর পাঁচবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, যা কিনা এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। এ সময় আইএফএ শিল্ডও ঘরে তুলেছিল মহামেডান। মহামেডান থেকে পরবর্তীতে সামাদ চলে যান ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে (EBR) দলে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি চলে যান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। তবে ফুটবলের আকর্ষণটা তিনি কখনোই হারিয়ে ফেলেননি। যুক্ত হন সংগঠক হিসেবে। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বেতনভুক ফুটবল কোচ হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে সম্মানিত করে রাষ্ট্রপতি পদক দিয়ে। ১৯৬৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কালের পরিক্রমায় সামাদকে আমরা হয়তো সেভাবে মনে রাখিনি। কিন্তু তাঁর কীর্তিগুলো সামনে নিয়ে এলে এই প্রজন্ম অন্তত তাঁর স্মৃতি বুকে নিয়েই এগিয়ে যেতে পারত অনেকটা পথ।