(আজ ৫ সেপ্টেম্বর, জাতীয় শিক্ষক দিবস। এই উপলক্ষে খেলার মাঠের এক শিক্ষিকা, টেবিল টেনিস কোচ ভারতী ঘোষকে নিয়ে বিশেষ লেখা।)
শিলিগুড়ির ভারতী ঘোষ। বাংলার টেবিল টেনিস ইতিহাসের অনেকটা জুড়েই আছেন তিনি, কোচ হিসেবে। একটু বেশি বয়সেই, কলেজে পড়ার সময় টেবিল টেনিস খেলা শুরু করেছিলেন। একবার আসাম রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। খেলোয়াড় হিসেবে এর বাইরে উল্লেখ করার মতো সাফল্য নেই। অতটা বেশি বয়সে শুরু করে বেশি সাফল্য পাওয়া সম্ভবও ছিল না। যখন খেলা শুরু করেছিলেন, ভারতী ঘোষ নিজেও সেটা ভাল করেই জানতেন। আসলে শুরুর সেই দিনগুলোতেই তাঁর লক্ষ্য ছিল টেবিল টেনিস খেলাটা শিখে নিয়ে কোচিংয়ে আসা। বাচ্চাদের খেলা শেখানো। তাই খেলতে খেলতেই শুরু করে দিয়েছিলেন সেই কাজটা। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে ছোটদের খেলা শেখানোর সেই কাজটা করে চলেছেন। আর ১৬ দিন পর, ২১ সেপ্টেম্বর ৭৬ পার করে ৭৭-এ পা দেবেন। কিন্তু ভারতী ঘোষের কোনও ক্লান্তি নেই। এখনও তিনি কোচ হিসেবে সচল। বাংলায় টেবিল টেনিসের এমন কোচ বা শিক্ষক বিরল।


টেবিল টেনিসে কীভাবে এলেন? গল্প করতে করতে ভারতী ঘোষ একদিন বলেছিলেন, ‘আমার যখন ছোটবেলা, তখন মেয়েদের খেলাধুলোর জন্য এখনকার মতো পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা ছিল না। তাই শৈশবে খেলাধুলো করার সুযোগ পাইনি। আমি টেবিল টেনিস খেলা শুরু করেছিলাম কলেজে পড়ার সময়। তখন আমার কোনও কোচও ছিলেন না। কেউ আমাকে দেখিয়ে, শিখিয়ে দেওয়ার ছিলেন না। রেলওয়ে ইনস্টিটিউটে খেলতে যেতাম। সেখানে বড়দের খেলা দেখেই শেখার চেষ্টা করতাম। যেটুকু পারতাম শিখতাম। এভাবেই আমার টেবিল টেনিসে চলে আসা।’
‘বড় খেলোয়াড়’ ছিলেন না। তিনি নিজেকে ‘বড় বা ভাল খেলোয়াড়’ হিসেবে কখনও দাবিও করেননি। এখনও করেন না। তাঁর কথায়, ‘আমি বড় বা ভাল প্লেয়ার ছিলাম না। আমি নিজেও জানতাম, অত বেশি বয়সে নিজের চেষ্টায় খেলা শিখে ভাল কিছু করা যাবে না। কিন্তু মন দিয়ে খেলতাম। তখন থেকেই আমার চেষ্টা ছিল যতটুকু পারি অন্যদের দেখে শিখে নিই। ওই শিক্ষাটা আমি ছোটদের খেলা শেখানোর কাজে লাগাব। তাই খেলতে খেলতেই ছোটদের কোচিং করাতে শুরু করি। এখনও সেই কাজটাই করে যাচ্ছি।’
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য, কোচিং করানোর জন্য তখন ভারতী ঘোষের একটা চাকরি দরকার ছিল। টেবিল টেনিস খেলার সূত্রে সেই চাকরিটাও পেয়ে গিয়েছিলেন। ভারতী ঘোষ বলছিলেন সেই গল্পটা, ‘একটা নেপালি ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। ১৯৭১ সালে সেই ছেলেটা আমাকে আসামের স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আমি খেলেছিলাম। সেবার আসামের স্টেট চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম। ওই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই এন এফ রেলে চাকরি পেয়েছিলাম।’ টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে ওঁর বলার মতো একমাত্র সাফল্য আসামের ওই রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাই।
টেবিল টেনিসে বেশি সময় দিতে চেয়েছিলেন, তাই ঘর-সংসারে জড়াননি। মানে বিয়ে করেননি। তিনি নিজে বলেন, ‘টেবিল টেনিসই আমার ঘর-সংসার।’ নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন ছোটদের টেবিল টেনিস খেলা শেখানোর কাজে। যে কাজটা নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছেন এখনও। সকাল-বিকেল দু’বেলাই তিনি কোচের ভূমিকায়। কোচ হিসেবে অধিকাংশ সময়ই তাঁর কেটেছে দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়নে। সাংগঠনিক সমস্যায় বাংলার টেবিল টেনিসের যখন টালমাটাল অবস্থা তখন তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ওই ক্লাব। আসলে গোষ্ঠী রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাননি। ওখান থেকে সরে যাওয়ার কিছু পরে যোগ দেন অমিত আগরওয়াল টেবিল টেনিস অ্যাকাডেমিতে। পরে আবার দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়নে ফিরলেও ছাড়েননি অমিত আগরওয়াল টেবিল টেনিস অ্যাকাডেমিও। ফলে এখন সকাল-বিকেলে ভাগ করে সামাল দিচ্ছেন ২ জায়গার কোচিং। বলছিলেন, ‘সকালে দেশবন্ধুতে যাই। ওখানে কিছু বাচ্চার সঙ্গে ভেটারেন্স প্রতিযোগিতায় খেলার জন্য কয়েকজনও প্র্যাকটিস করে। আর বিকেলে অমিত আগরওয়াল টেবিল টেনিস অ্যাকাডেমিতে যাই। ওখানে অনেক বাচ্চা, একটু বড়রাও আসে। আসলে আমি ছোটদের শিখিয়েই তো বেশি আনন্দ পাই।’ ওঁর আলাদা আনন্দ মূকবধির ছেলেমেয়েদের খেলা শিখিয়েও। এখনও ওঁর শিক্ষার্থীদের তালিকায় মূকবধির ছেলেমেয়ে আছে। বললেন, ‘ওরা সমাজে নানাভাবে উপেক্ষিত। অনেকেই ওদের অবহেলা করে। ওদের জন্য কিছু করতে পারাটা আমার কাছে গর্বের।’


তিনি ছিলেন ‘সেলফ মেড’ টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। কারও কাছে খেলা শেখেননি। কোচ হিসেবেও তিনি ‘সেলফ মেড’। কারও কাছে কোচিং শেখেননি। কোনও কোচিং কোর্স করার কথা কখনও ভাবেননি। নিজেই নিজেকে কোচ হিসেবে তৈরি করেছেন। যেখানে কোচ হিসেবে অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, সেই দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়নেই ওঁর হাতে তৈরি হয়েছে ২ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মান্তু ঘোষ। ওখানেই গণেশ কুণ্ডু, কৌশিক দাসরাও ওঁর হাতে তৈরি। আছেন আরও অনেক সফল খেলোয়াড়। তালিকাটা দীর্ঘ। ডেফ অলিম্পিয়াড-সহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সোমা কুণ্ডু, পলি সাহা, সুরভি ঘোষরা বেড়ে উঠেছেন ওঁর কোচিংয়েই। এতদিন কোচিং করানোর পর ওঁর কোনও ক্ষোভ, হতাশা নেই। বললেন, ‘ছেলেমেয়েদের খেলা শিখিয়েই আনন্দ পাই। অনেকেই খেলোয়াড় হিসেবে নাম করেছে। সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অনেক গরিব পরিবারের ছেলেমেয়ে আমার কাছে খেলা শিখে এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত, ভাল চাকরি করছে, সংসারের হাল ফিরিয়েছে। এগুলো আমাকে তৃপ্তি দেয়। মনে হয় সমাজের জন্য তাহলে কিছু করতে পেরেছি।’
প্রতিবছর শিক্ষক দিবসেও কোনও ব্যতিক্রম ঘটে না। রুটিনটা থাকে একই। খেলা শেখাতে যাওয়া। এবার অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটছে। করোনা-আতঙ্ক আর লকডাউনের জেরে এখন ক্লাবে অনুশীলন বন্ধ। এই সময়টায় বাড়িতে বন্দিদশা কীভাবে কাটাচ্ছেন? কাজের মানুষের কাজের অভাব হয় না। ভারতী ঘোষেরও তা হয়নি। আগেও কোচিং করানোর ফাঁকে সমাজসেবার কাজে তাঁকে দেখা গিয়েছে। করোনাকালে ওই কাজটা আরও বেশি করে করছেন। শিলিগুড়ির কিছু সমাজসেবী সংস্থার সহযোগিতায় দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করছেন।
খেলা শেখাতে শেখাতে এত বছর কাটিয়ে ফেলার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে পেয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা পুরস্কার। যে পুরস্কার ওঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এবছর পেয়েছেন বঙ্গরত্ন পুরস্কার। এই পুরস্কারও নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের কিছু সংস্থা ওঁকে বিভিন্ন সময়ে পুরস্কৃত করেছে। জানুয়ারিতে বঙ্গরত্ন পুরস্কার হাতে নিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে ওঁর বার্তা ছিল, নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। এতে মন ও শরীর ভাল থাকবে। ভারতী ঘোষ বিশ্বাস করেন, খেলাধুলো করে সবাই বড় খেলোয়াড় হবে, এরকম কথা নেই। কিন্তু খেলাধুলো করে ‘আদর্শ মানুষ’ হওয়া যায়।
আজ শিক্ষক দিবসে ভারতী ঘোষকে প্রণাম। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। আরও অনেক অনেক দিন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলা শিখিয়ে বাংলার টেবিল টেনিসকে সমৃদ্ধ করুন।