27 C
Kolkata
Wednesday, October 4, 2023
More

    ট্র্যাকে মিলখা যাঁকে ‘‌ভয়’‌ পেতেন‌!‌ -নির্মলকুমার সাহা

    অনেক বছর আগে গল্পটা শুনিয়েছিলেন মাখন সিংয়ের স্ত্রী সালিন্দার কৌর (Salinder Kaur‌)‌, ‘‌আমার তখন সবে বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি জানতাম, যে আমার স্বামী হতে চলেছে সে একজন ট্রাক ড্রাইভার। এর বাইরে ওর অন্য কোনও পরিচয় আমার জানা ছিল না। কিছুদিন পর একটি ম্যাগাজিন আমার হাতে আসে। সেই ম্যাগাজিনে ওকে নিয়ে লেখা ও ছবি ছিল। দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। তখনই প্রথম জানতে পারি, মাখন অ্যাথলিট ছিল। পেয়েছে ভারত সরকারের দেওয়া অর্জুন পুরস্কারও।’‌
    ওই একই দিনে আরও পরের একটি ঘটনাও শুনেছিলাম সালিন্দারের মুখে, ‘‌একদিন আলমারির কাপড়ের ভাঁজের মাঝ থেকে একটা ছবি বের করে আমাকে দেখিয়েছিল। ঐতিহাসিক একটা ছবি। কলকাতা ন্যাশনাল গেমসের সময় তোলা। মাখন দৌড় শেষ করছে। পেছনে মিলখা সিং। ‌মাখনের জীবনের গর্বের ছবি। ছবিটা দেখে আমিও গর্বিত হয়েছিলাম। এখন ওই ছবিটার কথা মনে পড়লে খারাপও লাগে। ওর শেষ জীবনটা তো ভালো কাটেনি!‌’‌
    জাতীয় পর্যায়ে মাখন সিংয়ের প্রথম সাফল্য ১৯৫৯ সালে। কটকে ন্যাশনাল গেমসে গলায় উঠেছিল ব্রোঞ্জ পদক। পরের বছর দিল্লিতে ন্যাশনাল গেমসে জিতেছিলেন জোড়া পদক। একটি করে সোনা ও রুপো। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪, ন্যাশনাল গেমসে মাখনের পদকের সংখ্যা ১৬ (‌সোনা ১২, রুপো ৩, ব্রোঞ্জ ১)‌। ন্যাশনাল গেমসে সবচেয়ে বড় সাফল্য অবশ্যই ১৯৬৪ সালে কলকাতায় ন্যাশনাল গেমসে ৪০০ মিটারে ‘‌উড়ন্ত শিখ’‌ মিলখা সিংকে হারিয়ে সোনা জয়। মিলখা সিং সমীহ করতেন মাখনকে। মিলখার নিজের লেখাতেই রয়েছে, ‘‌দেশে ট্র‌্যাকে একজনকেই আমি ভয় পেতাম, সে হল মাখন সিং। দুর্দান্ত অ্যাথলিট ছিল। ওর লড়াইয়েই আমার সেরাটা বেরিয়ে আসত। আমরা একসঙ্গে বছরের পর বছর প্র‌্যাকটিস করেছি। আমাদের মধ্যে ট্র‌্যাকে লড়াই ছিল। কিন্তু ভালো সম্পর্কও ছিল। আমার আর মাখনের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, পরে ৪০০ মিটারে ভারতে ওরকম আর দেখিনি।’‌
    আর্থিক অনটনে মাখনের পরিবার যখন নাজেহাল, তখনও পরামর্শ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন মিলখার স্ত্রী নির্মল। তাঁর পরামর্শেই মাখনের স্ত্রী যোগাযোগ করেন তখনকার কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে। মাখনের স্ত্রীর কাছে শুনেছিলাম, ‘‌মিলখার স্ত্রী আমাদের আর্থিক দুরাবস্থার কথা শুনে আমাকে স্পোর্টস মিনিস্টার এম এস গিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। নির্মলের কাছ থেকেই নম্বর নিয়ে আমি স্পোর্টস মিনিস্টারকে ফোন করি। তিনি আমাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন।’‌
    ১৯৬২ সালে জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে‌ ভারতীয় দলে ছিলেন মাখন। জাকার্তায় ৪০০ মিটারের ফাইনালে হেরেছিলেন মিলখার কাছে। সোনা মিলখার (‌৪৬.‌৯ সেকেন্ড)‌, রুপো মাখনের (‌৪৭.‌৫ সেকেন্ড)‌। ৪x৪০০ মিটার রিলেতে জিতেছিলেন সোনা। সোনাজয়ী সেই ভারতীয় রিলে দলে ছিলেন দলজিৎ সিং, জগদীশ সিং, মাখন সিং ও মিলখা সিং। পরে মাখন সিং অংশ নিয়েছেন ১৯৬৪ সালে টোকিও অলিম্পিকেও, তবে শুধু রিলেতে। ৪x১০০ মিটার এবং ৪x৪০০ মিটার, ভারতের দুটি রিলে দলেই ছিলেন মাখন। ৪x৪০০ মিটারে হিটের প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিলেও ৪x১০০ মিটার রিলেতে ভারত উঠেছিল সেমিফাইনালে। সেই দলে ছিলেন অ্যান্থনি কুটিনহো, মাখন সিং, কেনেথ পাওয়েল এবং রাজাশেখরণ। ১৯৬৪ সালেই মাখন সিং পান অর্জুন পুরস্কার।
    মাখন সিংয়ের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই, পাঞ্জাবের হোসিয়ারপুর জেলার বাথুলা (‌Bathula)‌ গ্রামে। শৈশবে গ্রামের মাঠে অল্প স্বল্প খেলাধুলো করলেও ১৯৫৫ সালে ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দেওয়ার পরই অ্যাথলেটিক্সকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। প্রথাগত ট্রেনিং বলতে যা বোঝায় তা আর্মিতে যোগ দেওয়ার পরই নেন।
    আর্মির সুবেদার ছিলেন। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে আর্মির চাকরি ছেড়ে চলে যান নাগপুরে। সেখানে মাখনের এক বোন থাকতেন। আর্মির চাকরি ছাড়ার পর সামান্য পেনশন পেতেন। তাতে ভালোভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব ছিল না। তাই নাগপুরে গিয়ে ট্রাক চালানো শুরু করেন। নাগপুর, পুনে, মুম্বই যাতায়াত করতেন মাল বোঝাই ট্রাক নিয়ে। ওই সময়ই বিয়ে ঠিক হয় সালিন্দার কৌরের সঙ্গে। ১৯৭৪ সালে বিয়ে করেন।
    ১৯৯০ সালে দুর্ঘটনায় পায়ে মারাত্মক আঘাত পান। পরে ডান পায়ের অনেকটা অংশ কেটে বাদ দিতে হয়। ফলে ট্রাক চালানো বন্ধ করে মাখন ফিরে আসেন পাঞ্জাবের গ্রামে। ডাক্তার কৃত্রিম পা লাগাতে বলেন। কিন্তু টাকার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে গ্রামবাসীদের আর্থিক সহায়তায় কৃত্রিম পা লাগান। সংসার চালানোর জন্য stationery দোকান খোলেন, ১৯৯৫ সালে। যা ছিল মাখনের মাখনের বাড়ি থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে Chabewal-‌এ। ট্রাই সাইকেল চালিয়ে যেতেন সেই দোকানে। বন্ধু হিসেবে তখন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ‘‌উড়ন্ত শিখ’‌ মিলখা সিং। নিজে উদ্যোগ নিয়ে কেরোসিন তেল বিক্রির লাইসেন্স বের করে দিয়েছিলেন মাখনকে। ওই দোকানে কিছুদিন বিক্রি করেছেন কেরোসিন তেল‌‌‌ও। যাওয়া-‌আসার পরিশ্রম একসময় অসুস্থ শরীরে নিতে পারছিলেন না। ফলে বছর চারেক পরে ওই দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। তরপরই তো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ২০০২ সালের ২১ জানুয়ারি।
    মাখনের ৩ ছেলের ২ জন ইন্দারপাল ও গুরবিন্দার মারা গিয়েছেন অল্প বয়সেই। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়ি থেকে ফোনে সালিন্দার বললেন, ‘‌টাকার অভাবে ঠিক মতো চিকিৎসা করাতে পারিনি। দুটো ছেলে কম বয়সে মারা গেল!‌’‌ বড় ছেলে পারমিন্দারের রয়েছে শারীরিক সমস্যা (‌physically challenged)‌। পিওনের কাজ করেন জেলার প্রশাসনিক দপ্তরে। পুত্র, পুত্রবধূকে নিয়ে বাথুলা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন মাখনের বিধবা স্ত্রী সালিন্দার। স্বামীর মৃত্যুর পর ২০ বছর কেটে গেল। ওই বাড়িতেই স্বামীর যাবতীয় পুরস্কার, স্মারক আগলে রেখেছেন তিনি। কাল, শুক্রবার মাখনের মৃত্যু বার্ষিকী। সালিন্দার বললেন, ‘প্রতিবছর এই দিনটায় ওর কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে। ওর ছবি, স্মারকগুলো নেড়েচেড়ে দেখি। কালও তাই হবে।’‌ এরপরই সালিন্দারের গলায় ক্ষোভ, ‘‌কতবার এখানকার এম এল এ, এম পি, জেলা প্রশাসনে বলেছি, মাখনের নামে একটা রাস্তা বা খেলার মাঠ করতে। কথা দিয়েও কেউ কথা রাখেননি!‌’‌ ‌

    জন্ম:‌ ১ জুলাই, ১৯৩৭
    মৃত্যু:‌ ২১ জানুয়ারি, ২০০২

    Related Posts

    Comments

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    সেরা পছন্দ

    চলতি আইএসএলে জয়যাত্রা শুরু করল ইস্টবেঙ্গল !

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : এই ম্যাচে কিছুটা অ্যাডভান্টেজে থেকে খেলতে নেমেছিল হায়দরাবাদ। তার কারণ এটাই তাদের প্রথম...

    জানেন ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কি কি ? উপসর্গ দেখে সতর্ক হোন

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ডেঙ্গির জ্বর মৃদু ও গুরুতর উভয় ধরনের হতে পারে। এমন পরস্থিতিতে এর লক্ষণও...

    জানেন বিশ্ব কাঁপানো গোয়েন্দা সংস্থা কোন গুলি ? জানুন অজানা তথ্য

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : কোন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা সবচেয়ে দুর্ধর্ষ-এমন কৌতূহল অনেকের মধ্যে আছে। তবে ইন্টারনেটের বিভিন্ন...

    ১০ সেকেন্ডের টর্নেডো ! তছনছ হাবড়ার কুমড়া গ্রাম

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : হাবড়ায় ১০ সেকেন্ডের সাইক্লোন। নিমেষে লণ্ডভণ্ড গোটা এলাকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের...

    কতদিন বৃষ্টি চলবে দক্ষিণবঙ্গে ? জানাল আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর

    দ্যা ক্যালকাটা মিরর ব্যুরো : ঝাড়খণ্ডের উপর তৈরি হওয়া নিম্নচাপের জেরে বিগত ক’দিন ধরে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে...