খেলাধুলো এবং লেখাপড়া—দুটো নিয়েই গভীর সমস্যায়, চিন্তায় শুক্লা বিশ্বাস। করোনা-লকডাউনে আপাতত খেলাধুলো বন্ধ। বাড়ির সামনের ছোট মাঠে সরকারি বিধি মেনে একটু গা ঘামিয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন। কবে ফিরতে পারবে মাঠে, তা জানা নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার ওর বাবা জানিয়ে দিয়েছেন। যা ওকে আরও বিমর্ষ করে তুলেছে। সেটা হল লকডাউনের জেরে আর্থিক অনটন যেখানে পৌঁছেছে তাতে মেয়েকে লেখাপড়া আর করাতে পারবেন না। কিছুদিন আগেই উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হয়েছে। পাস করেছে শুক্লা। কিন্তু স্কুলের বন্ধুরা যখন কলেজে ভর্তির ফর্ম ফিলাপ করা নিয়ে ব্যস্ত, বাংলার এই অ্যাথলিট তখন বাদকুল্লার বেলতলা গ্রামের বাড়িতে বসে চোখের জল ফেলছে।
শুক্লার বাবা সুনীল বিশ্বাস ভ্যান চালক। মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রায় ঘরে বসে। লকডাউন থেকে আনলক, নিয়ম একটু শিথিল হতে মাঝেমধ্যে ভ্যান নিয়ে রাস্তায় বের হলেও প্যাসেঞ্জার বিশেষ পাচ্ছেন না। এখন আবার মাঝেমধ্যে লকডাউন, কখনও কিছুটা শিথিল। নাজেহাল অবস্থা। কোনও আয় নেই বললেই চলে। স্ত্রী, সন্তানদের মুখে ঠিক মতো খাবারই তুলে দিতে পারছেন না। সেখানে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করার টাকা পাবেন কোথায়! ২০১৯-এ রাজ্য স্কুল অ্যাথলেটিক্সে ৩ কিলেমিটার হাঁটায় সোনাজয়ী মেয়েকে বাবা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছেন কলেজে পড়াতে পারবেন না। শুক্লার মন খারাপ হলেও বাবার সমস্যাটাও বুঝছে। শুক্লা বলছিল, ‘সাড়ে চার মাস হয়ে গেল বাবার আয় নেই। আমাকে কলেজে ভর্তি করানোর ইচ্ছে থাকলেও, বুঝতে পারছি বাবার ক্ষমতা নেই। সংসারই তো চালাতে পারছেন না! কলেজে লেখাপড়া করাটা এখন আমাদের পরিবারের কাছে বিলাসিতার মতো। কলেজে ভর্তি হতে পারছি না, এটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু ফ্যামিলির অবস্থাটাও বুঝতে হচ্ছে। বন্ধুরা অনেকে জিজ্ঞেস করছে, কোন কলেজে ভর্তি হচ্ছি, কোনও উত্তর দিতে পারছি না!’ করোনা-লকডাউনের পাশাপাশি আমফানের ধাক্কাও সামলাতে হয়েছে। শুক্লা বলল, ‘আমাদের ঘরের টিনের চাল ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল। কোনওভাবে জোড়াতালি দিয়ে আবার থাকার মতো করা হয়েছে।’
নদীয়া জেলার বাদকুল্লার অনামী ক্লাব। নাম ‘অনামী’ হলেও ওই ক্লাব বাংলাকে উপহার দিয়েছে অনেক ‘নামী’ অ্যাথলিট। গ্রামের বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের ওই ক্লাবেই সাড়ে তিন বছর আগে কোচ রঞ্জন দত্তর কাছে অ্যাথলেটিক্স শুরু করেছিল শুক্লা। ২০১৮ ও ২০১৯, পরপর দু’বার রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে অনূর্ধ্ব ১৮ বিভাগে ৫ কিলোমিটার হাঁটায় নদীয়ার হয়ে রুপো জিতেছে। ২০১৮ রাজ্য স্কুলে মিটেও ৩ কিলোমিটার হাঁটায় রুপো। আর গত বছর জিতেছিল সোনা। জাতীয় স্কুল গেমসে, পূর্বাঞ্চল অ্যাথলেটিক্সে বাংলার হয়ে অংশ নিয়েছে। করোনা-লকডাউনে এখন ক্লাবে যাওয়া বন্ধ। তবে ক্লাবের সচিব সমীর দাস, কোচ রঞ্জন দত্ত নিয়মিত ওর খোঁজ রাখছেন। শুক্লা বলল, ‘ফ্রি রেশন আর ওঁরা সাহায্য করছেন, তাতেই খেতে পাচ্ছি। সেজন্যই না খেয়ে থাকতে হচ্ছে না।’