অ্যাথলেটিক্সে ‘দরিদ্র’ আমাদের দেশে তিনিই প্রথম এনে দিয়েছিলেন কমনওয়েলথ গেমসের সোনার পদক। উঠেছিলেন অলিম্পিকের ফাইনালে। অল্পের জন্য অলিম্পিক পদক না পেলেও ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সকে পৌঁছে দিয়েছিলেন অন্য এক উচ্চতায়। তিনি মিলখা সিং। সারা বিশ্বে যিনি পরিচিত ‘উড়ন্ত শিখ’ নামে।
মিলখার জন্ম অবিভক্ত ভারতের মুজাফ্ফরগড় জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে, যা এখন পাকিস্তানে। কবে জন্ম? মিলখা সিং আত্মজীবনী ‘দ্য রেস অফ মাই লাইফ’–এ লিখেছেন, ‘তখন আমাদের মতো গ্রামীণ পরিবারে অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় কারও ছিল না। আসল ব্যাপার ছিল, প্রতিদিন কোনওভাবে বেঁচে থাকাটাই।’ পরিবারের কেউ মনে রাখেননি মিলখার জন্ম তারিখ। মিলখা লিখেছেন, ‘পরে বুঝেছি, জন্ম তারিখটা কত গুরুত্বপূর্ম। পাসপোর্টে একটা তারিখ দেওয়া আছে ২০ নভেম্বর ১৯৩২। ওঠাই এখন আমার জন্মদিন হিসেবে চিহ্নিত।’ মিলখার বাবার নাম সম্পূরণ সিং। মা চাওয়ালি কৌর। বাবা ছিলেন নিরক্ষর চাষী। কিন্তু তিনি ও তাঁর স্ত্রী চাইতেন, তাঁদের সন্তানরা যেন শিক্ষিত হয়ে ওঠে।


কয়েক বছর আগে সিনেমার পর্দায় সাড়া পেলে দিয়েছিল ‘ভাগ মিলখা ভাগ’। মিলখা সিংয়ের বায়োপিক। কেন বায়োপিকের ওই নাম? সেটা ভারত ভাগের সময়। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি এসে সম্পূরণ সিং ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ বলেই শিশুপুত্রকে বাঁচার জন্য দৌড়ে কোথাও চলে যেতে বলেছিলেন। সত্যি, সেদিন দৌড়েই প্রাণে বেঁচেছিলেন মিলখা। তারপর কিছুটা দৌড়ে, কিছুটা মিলিটারি ট্রাকে, কিছুটা ট্রেনে, পাক সীমানা পেরিয়ে চলে আসা ভারতে। এপারে এসেও কি শান্তি? এক্কেবারেই না। শুরু নতুন লড়াই। দিল্লিতে প্রথমে রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা। তখনও মিলখার জানা নেই পরিবারের বাকিরা কে কোথায়! একদিন দিল্লিতে হঠাৎই খুঁজে পাওয়া বোন ইশারকে। বোনের শ্বশুরবাড়ি হয় মিলখার নতুন আস্তানা। সেই অভিজ্ঞতাও মিলখার কাছে সুখের ছিল না। মিলখার মনে হয়েছিল, ‘ওটা তো বাড়ি নয়, যেন জেলখানা!’ আসলে ওই বাড়িতে ইশারের নিজেরই কোনও স্বাধীনতা ছিল না। সেখানে কে মিলখা! ফলে একদিন চলে আসা সেই বাড়ি ছেড়েও।


পেটের দায়ে এবার অন্য শিশুদের সঙ্গে রেলের ওয়াগান থেকে মাল চুরি করা শুরু। একবার সেই মাল চুরি করতে গিয়েই ধরা পড়ে যেতে হয়। সেই শৈশবেই যেতে হয় তিহার জেলে। ১০ দিন জেলে থাকার পর ইশারই কানের দুল বেচে মিলখাকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। তারকা হয়ে ওঠার পরও মিলখা মনে রেখেছিলেন সেটা। দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে ইশারকে কানের দুল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মিলখা। ভারতের ব্লেজারের দুই পকেটে দুটো কানের দুল রেখে দিয়েছিলেন। ইশারকে ডেকে মিলখা বলেছিলেন পকেটে হাত দিয়ে দেখতে। ইশারের দু’হাতে উঠে এসেছিল দুটো কানের দুল।


গল্পের শেষ নেই মিলখাকে ঘিরে। দিল্লিতে একসময় ১০ টাকা মাস মাইনেতে এক দোকান পরিষ্কারের কাজও করেছেন। এরকম যাঁর শৈশব, তাঁর অ্যাথলেটিক্স শুরু একটু দেরিতেই। ওই দোকান পরিষ্কারের কাজ করার পর সেনাবাহিনীতে চাকরি পান। অ্যাথলেটিক্সের শুরু সেখানেই। মিলখা এজন্য এখনও কৃতিত্ব দেন ‘গুরু’ গুরদেব সিংকে। সেনাবাহিনীতেও যে চক্রান্তের শিকার হতে হয়নি, তা নয়। একটা প্রতিযোগিতার আগের রাতে কয়েকজন কম্বল চাপা দিয়ে মিলখার পা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এরকম আরও কিছু। তবু মিলখা হার মানেননি। সারাজীবন ধরেই তাঁর আস্থা সেনাবাহিনীতে। কতবার যে বলেছেন, এখনও বলেন, ভারতের খেলাধুলোর ভার সেনাবাহিনীর হাতে দিয়ে দিলে বিশ্ব আসরে আমরা অনেক বড় জায়গায় পৌঁছে যেতে পারতাম।


সেনা বাহিনীর দিনে


সস্ত্রীক মিলখা সিং
মিলখার জন্ম পাকিস্তানে। সেই পাকিস্তানই একদিন তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল মা–বাবা–দাদা–দিদিদের থেকে। সব ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল ভারতে। আরও অনেক পরে সেই পাকিস্তান থেকেই মিলখা পেয়েছিলেন ‘উড়ন্ত শিখ’ নামটি। নামটা দিয়েছিলেন পাকিস্তানেরই এক রাজনীতিক। তিনি আয়ুব খান। সেটা ১৯৬০ সাল। পাকিস্তানের তখনকার সেরা রানার আব্দুল খালেককে পাকিস্তানের মাটিতেই হারিয়েছিলেন মিলখা। সেই দৌড়ের পর মুগ্ধ হয়ে আয়ুব খান মিলখাকে ডেকেছিলেন ‘দ্য ফ্লাইং শিখ’ নামে। আজ জন্মদিনে ‘উড়ন্ত শিখ’-কে প্রণাম।